পর্যটক ও পানির অভাবে ভালো নেই পরিচ্ছন্ন গ্রাম মুনলাইপাড়াবাসী
বান্দরবানের রুমা উপজেলায় সাজানো-গোছানো পরিপাটি পাহাড়ি গ্রাম মুনলাইপাড়া। প্রতিটি মাচাং ঘরের আঙিনায় লাগানো জবাসহ হরেকরকম ফুলের গাছ সৌন্দর্য বাড়িয়ে তুলেছে আরও বহুগুণে। সাঙ্গু নদীর পাশ ঘেঁষে গড়ে তোলা পাড়াগ্রামটি দর্শনার্থীদের স্বাগত জানায় ইকো সিস্টেমের হোম স্টে ও পাহাড়ি রান্না, রোমাঞ্চকর ট্রেকিং, কায়াকিং, দেশের দীর্ঘতম জিপ লাইন ও বিভিন্ন ইভেন্ট দিয়ে।
পর্যটনস্পট বগালেক যাওয়ার পথে সড়কের দুপাশে পাহাড়ের ঢালুতে সাজানো গোছানো পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন পরিপাটি মুনলাইপাড়া গ্রামটি স্থানীয় দর্শণার্থী ও ভ্রমণপিপাসু পর্যটকদের আকর্ষণে পরিণত হয়েছে। তবে পর্যটক এবং পানির অভাবে ভালো নেই দেশের সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন একমাত্র গ্রামের খ্যাতি পাওয়া পাড়াটির বাসিন্দারা।
সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, দর্শণার্থী ও ভ্রমণকারী পর্যটক না আসায় অর্থনৈতিক কষ্টে পর্যটননির্ভর পাড়াবাসী। ইকো-ট্যুরিজম ঘিরে গড়ে ওঠা কিছুক্ষণ ও চুংচুং নামক দুটি রেস্টুরেন্টই বন্ধ রয়েছে। রিসোর্টগুলোর অবস্থাও জরাজীর্ণ। তীব্র পানির সংকট দুর্ভোগ বাড়িয়েছে আরও। পানির অভাবে শতভাগ স্বাস্থ্যসম্মত স্যানিটেশন ব্যবস্থা পুরোপুরি সফলতা আসেনি। প্রতিটি বাড়ির আঙিনায় সৌন্দর্য বর্ধনে লাগানো ফুলের গাছগুলো মরে যাচ্ছে, রুক্ষ হয়ে পড়ছে অন্য গাছপালাও।
স্থানীয়রা জানান, ১৯৮৩ সালে সীমান্তবর্তী চুংচুংপাড়া থেকে আসা বম জনগোষ্ঠীর ৩০টি পরিবার নিয়ে গড়ে ওঠা মুনলাই পাড়ায় এখন ৭০টি পরিবারের বসবাস। জনপ্রতি পাঁচ একর জায়গার মালিক পরিবারগুলো। শুরু থেকেই সৌন্দর্যবর্ধন, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার দিকে বাড়তি নজর ছিল তাদের। সম্মিলিতভাবে সালিশ বিচারও করেন তারা। ঐক্যবদ্ধ হওয়ায় দেশের সবচেয়ে সুন্দর গ্রামেরও তকমা পেয়েছে মুনলাইপাড়া।
বান্দরবান জেলা শহর থেকে রুমা উপজেলার দূরত্ব ৪২ কিলোমিটার। রুমা বাসস্ট্যান্ড থেকে মুনলাইপাড়ার দূরত্ব ছয় কিলোমিটার। পাহাড়ের আঁকাবাঁকা পথে দুই থেকে আড়াই ঘণ্টায় পৌঁছে যাওয়া যায় ছোট্ট আদর্শ গ্রামটিতে। ইকো ট্যুরিজমের উদ্যোক্তা জিংসম বম বলেন, বম জনগোষ্ঠী সুন্দরের পূজারি, এটি ঐতিহ্যেরও অংশ।
গ্রামের প্রতিটি ঘরের সামনে আছে ময়লা ফেলার ঝুড়ি (ডাস্টবিন)। সৌন্দর্য রক্ষা এবং বাড়ির আঙিনাসহ আশপাশের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতায় প্রতিদিন কমপক্ষে ৩০ মিনিট সময় দেন গ্রামের প্রত্যেকে। পাড়ার কেউ অসুস্থ বা বাইরে থাকলে প্রতিবেশীরাই নিজ দায়িত্বে ওই বাড়ির আঙিনা পরিষ্কার করে দেন। বর্ষা মৌসুমে বাড়ির আশপাশে অন্তত ১০টি ফুলের গাছ লাগানোর লক্ষ্য থাকে গ্রামবাসীর। এগুলো হলো মুনলাইপাড়া বম কমিউনিটির সম্মিলিত সিদ্ধান্ত এবং সামাজিক একতার বৈশিষ্ট্য।
গৃহিণী লালনুন জির বম বলেন, ‘সংসারের কাজ-কর্মের ফাঁকে গ্রামের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতায় দুবেলা কমপক্ষে ৩০ মিনিট সময় দিতে হয়। বাবা-মায়েদের আমল থেকেই বংশপরম্পরায় চলে আসছে এ প্রথা। আমরাও তাদের অনুসরণ করে মুনলাইপাড়ার সৌন্দর্য-সুনাম ধরে রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম নিজেদের সন্তানদের মাসে-বছরে দু-একবার গোটা পাড়াটি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে পরিচ্ছন্নতায় উদ্বুদ্ধ করি, ময়লা-আবর্জনা পরিষ্কারের শিক্ষা দেই।’
শিক্ষক কালেব বম বলেন, নিজেদের একই পরিবারের সদস্য হিসেবেই ভাবেন গ্রামের বাসিন্দারা। চুরি হওয়ার ভয় না থাকায় ঘরে কখনো তালা লাগায় না কেউই। ঘর খোলা রেখে কেউ বাইরে গেলে নিজের মনে করেই বাড়িটি পাহারা দেন প্রতিবেশীরা, যা বর্তমান সময়ে দৃষ্টান্তমূলক। মুনলাইপাড়া বম কমিউনিটি ম্যানেজমেন্ট কমিটির সাধারণ সম্পাদক রবিন বম বলেন, ‘পানি সমস্যায় খুবই কষ্টে দিন কাটাচ্ছেন পাড়াবাসী। ঐতিহ্যগত পাহাড়ি গ্রামটির সৌন্দর্যও ঠিকঠাক ধরে রাখতে পারছি না পানির অভাবেই। সরকারি-বেসরকারি সংস্থাগুলোর কাছে ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানাচ্ছি।’
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আদনান চৌধুরী বলেন, সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় মুনলাইপাড়া খ্যাতি ছড়ানো পাহাড়ি গ্রাম। সামাজিকভাবে ঐক্যবদ্ধ একটি পরিবার পাড়াবাসী। সৌন্দর্য রক্ষায় প্রত্যেকেই প্রতিদিনই আলাদাভাবে সময় দেন, এটি মহত্বের লক্ষণ। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন সমাজ-দেশ গড়ে তোলার উদাহারণও গ্রামটি। ‘অবসর কাটাতে আমিও মুনলাইপাড়ায় ছুটে যাই, মনে প্রশান্তি দেয় চারদিকে পাহাড়বেষ্টিত পরিবেশবান্ধব গ্রামটি।’
‘তবে এ গ্রামে পানির সংকটের বিষয়টি আমাকে গ্রাম কমিটি অবগত করেনি’ বলে মন্তব্য করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়ারও আশ্বাস দেন ইউএনও।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে