বিষাক্ত বাতাস ঢাকাবাসীকে ফেলেছে মৃত্যুঝুঁকিতে
গত কয়েক বছর ধরে শুষ্ক মৌসুমে বিশ্বের দূষিত বায়ুর শহরগুলোর মধ্যে রাজধানী ঢাকার অবস্থান শীর্ষ পাঁচের মধ্যেই অবস্থান করছে। এর মধ্যে বেশিরভাগ সময় থাকছে শীর্ষ স্থানে। আইকিউএয়ার অনুযায়ী থাকছে ‘খুবই অস্বাস্থ্যকর’ হিসেবে। চিকিৎসকদের মতে, ঢাকার এমন অব্যাহত বায়ুদূষণ তৈরি করছে গুরুতর স্বাস্থ্যঝুঁকি। এ ধরনের বিষাক্ত বাতাস সব বয়সী মানুষের জন্যই মারাত্মক ক্ষতিকর। এই ক্ষতির মাত্রা এতটাই যে, মানুষকে মৃত্যুঝুঁকিতে ফেলে দিচ্ছে।
২০২৪ সালের ঢাকার বায়ুদূষণ নিয়ে বুয়েটের একটি গবেষণায় বলা হয়েছে, ‘২০২৪ সালের জানুয়ারির প্রথম দিন থেকে ডিসেম্বরের শেষ দিন পর্যন্ত ঢাকার বাতাস আইকিউএয়ার অনুযায়ী গড় স্কোর ছিল ২১০। যা খুবই অস্বাস্থ্যকর হিসেবে বিবেচিত।’ এই ধারা অব্যাহত আছে ২০২৫ সালেও। চলতি বছরের ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত বিশ্বের দূষিত বায়ুর শহরগুলোর মধ্যে ঢাকার অবস্থান ছিল এক থেকে তিনের মধ্যে। আইকিউএয়ার অনুযায়ী, স্কোর শূন্য থেকে ৫০-এর মধ্যে থাকলে বায়ুর মান ভালো বলে বিবেচিত হয়। ৫১ থেকে ১০০ হলে মাঝারি বা সহনীয় ধরা হয় বায়ুর মান। সংবেদনশীল গোষ্ঠীর জন্য অস্বাস্থ্যকর হিসেবে বিবেচিত হয় ১০১ থেকে ১৫০ স্কোর। ১৫১ থেকে ২০০ পর্যন্ত অস্বাস্থ্যকর হিসেবে বিবেচিত হয়। স্কোর ২০১ থেকে ৩০০ হলে খুবই অস্বাস্থ্যকর বলে বিবেচনা করা হয়। এছাড়া ৩০১-এর বেশি হলে তা দুর্যোগপূর্ণ বলে বিবেচিত হয়।
বায়ুদূষণে গুরুতর স্বাস্থ্যঝুঁকি চিকিৎসকদের বক্তব্য:
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) নিউরো সার্জারি বিভাগের অধ্যাপক এটিএম মোশারফ হোসেন ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন, ‘বায়ুদূষণের কারণে মানুষের ফুসফুস ও মস্তিষ্কে মারাত্মক ক্ষতির সম্ভাবনা থাকে। ধূলিকনা নিঃশ্বাসের মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করে তা রক্তে মিশে যায়। এতে করে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হতে শুরু করে বিভিন্ন ধরনের স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ে। যা মানুষের মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ায়।’
বিএসএমএমইউর কার্ডিওলজি বিভাগের অধ্যাপক ডা. এসএম মোস্তফা জামান ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন, ‘ঢাকার মারাত্মক বায়ুদূষণ এই শহরের মানুষের হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকিকে বাড়িয়ে দিয়েছে বহুগুণ। যা রাজধানীবাসীর মৃত্যুর অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘দূষিত বায়ু নিঃশ্বাসের মাধ্যমে সরাসরি মানুষের হার্টে চলে যায়। এতে করে হার্টে ব্লকের সৃষ্টি হয় যা পরে হার্ট অ্যাটাকের কারণ হয়ে যাচ্ছে। বায়ুদূষণ কমানো ছাড়া এর কোনো সমাধান নেই।’
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. রূপম বলেন, ‘বায়ুদূষণ রাজধানীবাসীর জন্য নীরব ঘাতক হিসেবে কাজ করছে। দীর্ঘদিন ধরে দূষিত বায়ু গ্রহণের ফলে ঢাকার বাসিন্দারা বিভিন্ন জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। কেউ হয়তো বুঝতেই পারছেন না শুধু বাযুদূষণের কারণে তারা জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন।’ তিনি আরও বলেন, ‘মধ্য শীতেও আমাদের কাছে প্রচুর মানুষ আসছেন বিভিন্ন ধরনের ঠান্ডাজনিত সমস্যা নিয়ে। এটা সাধারণত হয় শীত আসার ঠিক আগ মুহূর্তে ও শীত শেষ হলেই। কিন্তু এমন স্বাভাবিক শীতে ঠান্ডাজনিত রোগ ব্যাপক ছড়িয়ে পড়াটা স্বাভাবিক নয়। মূলত মাত্রাতিরিক্ত আর্দ্রতার মাঝে চরম বায়ুদূষণই এর জন্য দায়ী।’
বিএসএমএমইউর অবস্ অ্যান্ড গাইনি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. তৃপ্তি রাণী দাস ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন, ‘গর্ভবতীরা বায়ুদূষণের কারণে সবচেয়ে বেশি জটিল পরিস্থিতিতে পড়ছেন। দূষিত বাতাস গ্রহণের কারণে গর্ভবতীরা অসময়ে সন্তান প্রসব, রক্তক্ষরণ ও সন্তান প্রসবের সময় জটিলতা হতে পারে।’ তিনি বলেন, ‘একটি শিশু মাতৃগর্ভ থেকে যেসব সমস্যা বা প্রতিবন্ধকতা নিয়ে জন্মগ্রহণ করে তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে অটিজম। মূলত অটিজমে আক্রান্ত শিশু বা ব্যক্তি মাতৃগর্ভ থেকে মস্তিষ্কের বিকাশগত অসম্পূর্ণতাজনিত ত্রুটি নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। মায়ের প্রতিনিয়ত দূষিত বায়ু গ্রহণ এর অন্যতম কারণ।’
বিএসএমএমইউর মনোরোগবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ডা. মো. মহসিন আলী শাহ ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন, ‘বায়ুদূষণের কারণে সিজোফ্রেনিয়া বাইপোলার মুড ডিসঅর্ডার রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। এটা মূলত মস্তিষ্কের রোগ। এছাড়া, বায়ুদূষণ মানুষের মস্তিষ্কে এমন কিছু প্রভাব ফেলে যার কারণে হতাশা, দুশ্চিন্তা, ক্লান্তি, স্মৃতিভ্রম, মানসিক বিক্ষিপ্ততা, উত্তেজনাসহ আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়িয়ে তোলে। এটা নিজের অজান্তেই হয়ে থাকে। তাই শুধু চিকিৎসা করলেই এর স্থায়ী সমাধান হবে না। এর জন্য নীরব ঘাতক দূষিত বায়ুমুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে।’
বিএসএমএমইউর শিশু বিভাগের অধ্যাপক ডা. মানিক কুমার তালুকদার ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন, ‘ঢাকার দূষিত বাতাসে নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইড, সালফার ডাই-অক্সাইড, কার্বন মনোক্সাইডসহ ভাসমান কণার পরিমাণ এতটাই বেশি যে, শিশুর সংবেদনশীল শ্বাসতন্ত্রের ক্ষতির ঝুঁকি বাড়ছে। ফলে শিশুদের বুদ্ধিমত্তা বিকাশে ও স্নায়ুবিক ক্ষতি হতে পারে। ফুসফুসে থাকা সারফেকট্যান্ট নামে তরল পদার্থ ফুসফুসের দুটি অংশকে একসঙ্গে আটকে যেতে বা সংকুচিত হয়ে যেতে বাধা দেয়। সারফেকট্যান্ট না থাকলে শ্বাসকষ্ট হবে। দূষিত বায়ু ফুসফুসের এই তরল পদার্থ নষ্ট করে ফেলে। দূষিত বাতাসে বেড়ে ওঠার কারণে শিশুরা তাৎক্ষণিক শ্বাসতন্ত্রের প্রদাহ যেমন নিউমোনিয়া, ব্রংকিওলাইটিসে ভোগে। আবার বায়ুদূষণের কারণে অ্যাজমা, ব্রংকাইটিসসহ বিভিন্ন দীর্ঘমেয়াদি রোগেও আক্রান্ত হয়।’
বিএসএমএমইউর চর্ম ও যৌন রোগ বিভাগের অধ্যাপক মুহাম্মদ মুনীর রশীদ ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন, ‘বায়ুদূষণের কারণে সৃষ্ট ধোঁয়াশে আবহাওয়ার কারণে বাতাসে অক্সিজেনের পরিমাণ কমে যায় এবং কার্বন মনোক্সাইডের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। অক্সিজেনের পরিমাণ স্বাভাবিক রাখতে শরীরবৃত্তীয় প্রতিক্রিয়ার ফলে ত্বকে প্রদাহ সৃষ্টি হয়। ত্বকের প্রদাহের কারণে একজিমা, ডার্মাটাইটিস, এলার্জি, ব্রণসহ বিভন্ন চর্ম রোগের তীব্রতাও বেড়ে যায়। এছাড়া নারী-পুরুষ উভয়েরই প্রজনন ক্ষমতা হ্রাস, শারীরিক টেস্টিকুলার সমস্যা, হরমোনের সমস্যা, শুক্রাণু নালি বন্ধ হয়ে যাওয়াসহ বিভিন্ন যৌন রোগের অন্যতম কারণ বায়ুদূষণ।’
বায়ুদূষণ রোধে এখনো উপেক্ষিত হাইকোর্টের নির্দেশ:
২০২০ সালে বায়ুদূষণ রোধে ৯ দফা নির্দেশনা দিয়ে রায় দিয়েছেন হাইকোর্ট। সেগুলো ছিল- ১. যেসব গাড়ি কালো ধোঁয়া নির্গমন করে সেগুলোকে জব্দ করতে হবে। ২. ঢাকার সড়কগুলোতে নিয়মিত পানি ছিটানোর ব্যবস্থা নিতে হবে। ৩. ঢাকা শহরের মধ্যে বর্জ্য, বালি ও মাটি বহনকারী ট্রাকগুলোকে ঢেকে পরিবহন করতে হবে। ৪. যেসব ইটভাটা লাইসেন্সবিহীন চলছে সেগুলো স্থায়ীভাবে বন্ধ করতে হবে। ৫. যেসব জায়গায় নির্মাণকাজ চলছে সেসব জায়গার কন্ট্রাক্টররা তা ঢেকে রাখবেন। ৬. সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮ অনুযায়ী রাস্তায় চলাচলকারী গাড়ির ইকোনমিক লাইফ নির্ধারণ করতে হবে এবং যেসব গাড়ি পুরাতন হয়ে গেছে সেগুলো চলাচলের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে হবে। ৭. সড়কের মেগা প্রজেক্টের নির্মাণকাজ এবং কার্পেটিংসহ যেসব কাজ চলছে, সেসব কাজ যেন আইনকানুন এবং চুক্তির টার্মস অ্যান্ড কন্ডিশন মেনে করা হয় সেটা নিশ্চিত করতে হবে। ৮. মার্কেট এবং দোকানের বর্জ্য প্যাকেট করে রাখতে হবে। এরপর মার্কেট ও দোকান বন্ধ হলে সিটি করপোরেশন ওই বর্জ্য অপসারণ করবে। ৯. পরিবেশ অধিদপ্তরের অনুমতি ছাড়া টায়ার পোড়ানো এবং ব্যাটারি রিসাইক্লিং বন্ধ করতে হবে।
হাইকোর্টের এসব নির্দেশনা এখনো বাস্তবায়ন হয়নি। কেন হয়নি তা জানতে গত ১২ জানুয়ারি পরিবেশবাদী সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ (এইচআরপিবি) হাইকোর্টে একটি সম্পূরক আবেদন করেন। ওই আবেদন শুনানি নিয়ে ওই দিন বিচারপতি ফারাহ মাহবুব ও বিচারপতি দেবাশীষ রায় চৌধুরীর হাইকোর্ট বেঞ্চ বর্তমানে ঢাকার বায়ুদূষণের পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। একইসঙ্গে ২০২৫ সালের ৩১ জানুয়ারির মধ্যে বিবাদীদের বায়ুদূষণ বন্ধের কার্যকর পদক্ষেপ নিতে এবং ৯ দফা নির্দেশনা বাস্তবায়িত করে ৫ ফেব্রুয়ারির মধ্যে আদালতে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেন।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে