Views Bangladesh

Views Bangladesh Logo

ইসমাইল হানিয়ের করুণ মৃত্যু

Zeauddin Ahmed

জিয়াউদ্দীন আহমেদ

শনিবার, ১০ আগস্ট ২০২৪

রানের তেহরানে হামলায় নিহত হয়েছেন হামাসের শীর্ষ রাজনৈতিক নেতা ইসমাইল হানিয়ে। হামলায় হানিয়ে ছাড়াও তার একজন দেহরক্ষী নিহত হয়েছেন। হানিয়ে হত্যাকাণ্ডে ইসরায়েলকে দায়ী করেছে হামাস ও ইরান।

মিশরের এক শরণার্থী শিবিরে ১৯৬২ সালে ইসমাইল হানিয়ের জন্ম। ১৯৮৭ সালে স্নাতক ডিগ্রি নিয়ে তিনি হামাসের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হন, ১৯৯৭ সালে তাকে হামাস অফিসের প্রধান করা হয়। ফিলিস্তিনের দুটি অংশ- পশ্চিম তীর এবং গাজা; প্রধান দুইটি রাজনৈতিক দল ফাতাহ এবং হামাস। ১৯৯৪ সালে ইসরায়েলের সঙ্গে ফিলিস্তিনের এক চুক্তি বলে ‘ফিলিস্তিন জাতীয় কর্তৃপক্ষ’ গঠিত হয় এবং এর মাধ্যমে ফিলিস্তিনিরা কিছু কিছু ক্ষেত্রে নিজেদের পরিচালনা করার স্বাধীনতা লাভ করে। ফিলিস্তিন জাতীয় কর্তৃপক্ষ এখন আর নেই, এখন বলা হয় ফিলিস্তিন রাষ্ট্র, এই রাষ্ট্রের বর্তমান প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস। মাহমুদ আব্বাসের অবস্থান গাজায় নয়, তিনি থাকেন পশ্চিম তীরের রামাল্লায়। ২০০৬ সালে ফিলিস্তিন আইন সভার নির্বাচনে হামাস বেশির ভাগ আসালে জয় পাওয়ার পর ইসমাইল হানিয়েকে প্রধানমন্ত্রী পদে নিয়োগ দেন প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস।

মাহমুদ আব্বাস ইসরায়েলের বিরুদ্ধে অস্ত্রের ব্যবহার বন্ধ করার পক্ষের লোক এবং বহুবার ফিলিস্তিনি দলগুলোর প্রতি অস্ত্রের ব্যবহার বন্ধ করার আহবান জানিয়েছেন; কিন্তু হামাসসহ কয়েকটি সশস্ত্র গোষ্ঠী তার কথায় কান দেয়নি। হানিয়ের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার কিছুদিন পর ফাতাহ এবং হামাসের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘাত শুরু হলে গাজায় মাহমুদ আব্বাসের রাজনৈতিক পার্টি ফাতাহার কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়া হয়। প্রধানমন্ত্রী হানিয়ের এই সিদ্ধান্ত কর্তৃত্বের প্রশ্নে প্রেসিডেন্ট আব্বাসের প্রতি সরাসরি চ্যালেঞ্জ ছিল; তাই তিনি প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে হানিয়েকে বরখাস্ত করে সালাম ফায়াদকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেন। প্রেসিডেন্টের আব্বাসের এই সিদ্ধান্ত হামাস পরিপালন করেনি, ফলে গাজা এবং পশ্চিম তীরে দুটি পৃথক সরকার গঠিত হয়। এর পর থেকে গাজা শাসন করছে হামাস এবং পশ্চিম তীর করছে ফাতাহ। পরবর্তীকালে সরকার দুটিকে এক করার জন্য বহুবার চেষ্টা করা হয়েছে; কিন্তু হয়নি।

ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজা ভূখণ্ডে অবিরাম হামলা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরায়েল। টানা ১০ মাসেরও বেশি সময় ধরে চালানো এই হামলায় এখন পর্যন্ত নিহত হয়েছে ৪০ হাজারেরও বেশি ফিলিস্তিনি। বিগত এপ্রিল মাসে ইদের দিন গাজায় একটি শরণার্থী শিবিরে ইসরায়েলের বিমান হামলায় ইসমাইল হানিয়ের তিন ছেলে ও বেশ কয়েকজন নাতি-নাতনি প্রাণ হারিয়েছে। ইসরায়েলের হামলায় হানিয়ের পরিবারের সদস্যদের মৃত্যুর ঘটনা এটাই প্রথম নয়; ফেব্রুয়ারিতে নিহত হয় তার আরেক ছেলে, অক্টোবরে প্রাণ হারায় তার ভাই ও ভাতিজা, নভেম্বরে তারএক নাতি নিহত হয়। হানিয়ে জানিয়েছেন, চলমান যুদ্ধে তার পরিবারের ৬০ সদস্য নিহত হয়েছে। হামাস প্রধান আরও জানিয়েছেন, তার ছেলেদের হত্যার মাধ্যমে যুদ্ধের গতিপথ বদলানো যাবে না এবং হামাস যুদ্ধবিরতির দাবি থেকে একটুও সরে আসবে না। ইসরায়েলের সঙ্গে চলমান যুদ্ধবিরতির আলোচনায় হামাসের পক্ষে ইসমাইল হানিয়া মুখ্য ভূমিকা পালন করে যাচ্ছিলেন।

হানিয়ার মৃত্যুর কয়েক ঘণ্টা পূর্বে বৈরুতের দক্ষিণ উপকণ্ঠে ইসরায়েলের আরেকটি হামলায় লেবাননের সশস্ত্র গোষ্ঠী হিজবুল্লাহর কমাণ্ডার ফুয়াদ শোকর নিহত হন। ফুয়াদ শোকরকে হত্যা করার কয়েকদিন পূর্বে ইসরায়েল-অধিকৃত গোলান মালভূমিতে হিজবুল্লাহর রকেট হামলায় ১২ জন ইহুদি নিহত হয় এবং এর জন্য ইসরায়েল ফুয়াদকে দায়ী মনে করে। ১৯৮৩ সালে লেবাননের রাজধানী বৈরুতে যুক্তরাষ্ট্রের মেরিন সেনাদের ব্যারাকে বোমা হামলার মূল পরিকল্পনাও নাকি তিনি করেছিলেন, ওই হামলায় ২৪১ জন মার্কিন সেনা নিহত হন। এই হামলায় হেজবুল্লাহ নেতা আব্বাস আল-মুসাভিও জড়িত থাকায় ইসরায়েল ১৯৯২ সালে মুসাভির মোটরকেডের উপর তাদের অ্যাপাচি হেলিকপ্টার থেকে বোমা বর্ষণ করে, এতে মুসাভি, তার স্ত্রী, সন্তানসহ ৭ জনের মৃত্যু হয়।

ইসরায়েল এভাবে তাদের শত্রুদের হত্যা করে থাকে। ইসরাইলের ‘মোসাদ’ পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়ঙ্কর গোয়েন্দা সংস্থা। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে যারা ইহুদিদের হত্যা করেছিল তাদের এখনো খুঁজে খুঁজে বের করে মোসাদ খুন করেছে। হিটলারের নাৎসি বাহিনীর লেফটেন্যান্ট কর্নেল অ্যাডলফ আইকম্যান নির্বিচারে ইহুদি হত্যার জন্য দায়ী। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর তিনি বাঁচার জন্য এক দেশ থেকে আরেক দেশে পালিয়ে বেড়াতে থাকেন। ১৯৬০ সালে ইসরাইলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ তাকে আর্জেন্টিনা থেকে অপহরণ করে ইসরায়েলে নিয়ে যায় এবং বিচার করে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করে। ১৯৭২ সালের মিউনিখ অলিম্পিকে ইসরায়েলি খেলোয়াড়দের ওপর গুলি চালানোর সঙ্গে জড়িত ফিলিস্তিনিদের এখনো খুঁজে খুঁজে বের করে মোসাদ হত্যা করছে। ইরাকের দূরপাল্লার কামানের গবেষক জেরাল্ড বুল, হামাসের ড্রোন প্রজেক্টের দলনেতা মোহাম্মদ জাওয়ারি, রকেট আধুনিকায়নের ফিলিস্তিনি গবেষক ফাদি আল বাৎশ, ফিলিস্তিনের ফাতাহ আন্দোলনের উপপ্রধান আবু জিহাদ, ফিলিস্তিনের ইসলামিক জিহাদ আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা ফাতহি শাকিকীসহ আবাবিল ড্রোনের আবিষ্কারক মোহাম্মদ আল-জাওয়ারিকে ইসরাইলের মোসাদ এত নিখুঁতভাবে হত্যা করেছে যে, হত্যার পর গবেষণা করে শুধু ধারণা করা হয়েছে, মোসাদ ছাড়া এমন গুপ্তহত্যা আর কারো পক্ষে করা সম্ভব নয়।

ইরানের মাটিতে ইসমাইল হানিয়েকে হত্যার পর ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি ক্ষেপেছেন এবং হানিয়ে হত্যার যথাযথ জবাব দেওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। কিন্তু ইসরায়েলের সঙ্গে ইরানের সরাসরি যুদ্ধ করার ক্ষমতা নেই। ইরানের পারমাণবিক স্থাপনা ধ্বংস করার জন্য ইসরায়েল ওৎ পেতে আছে, প্রথম সুযোগেই তাদের পারমাণবিক স্থাপনা ধ্বংস করে দেবে। হানিয়ের হত্যা ঘটনা থেকে ইরানের দুর্বলতা প্রতিপন্ন হয়। হানিয়ে নতুন রাষ্ট্রপতির অভিষেক অনুষ্ঠানে যোগ দিতে ইরানে গিয়েছিলেন, ইরান তার নিরাপত্তার ব্যাপারে সতর্কও ছিল; কিন্তু ইসরায়েলের নজরদারি থেকে হানিয়ের অবস্থানের ভবনটিকে রক্ষা করতে পারেনি। ইরানের স্থানীয় সময় রাত ২টার দিকে বিমান হামলা চালিয়ে তাকে হত্যা করা হয়। ইরানেরও গোয়েন্দা সংস্থা আছে, কিন্তু তারা টেরও পায়নি। ইরানের অভ্যন্তরে ইসরায়েলের বিমান গিয়ে বোমা বর্ষণ করল, অথচ ইরানও টের পেল না। এমন একটি ঘটনা ঘটেছিল ১৯৮০ সালে ইরান-ইরাক যুদ্ধের সময়। যুদ্ধরত অবস্থায় ইরাক ছিল সর্বোচ্চ সতর্কতায়, এই অবস্থায় ইসরায়েল বিমান আক্রমণ করে ইরাকের পারমাণবিক স্থাপনা ধ্বংস করে দেয়, ইরাক টেরও পায়নি।

ইরানের অভ্যন্তরে ঢুকে ইসরায়েল শুধু হানিয়েকে হত্যা করেনি, হানিয়ের আগে হত্যা করেছে ইরানের বহু পারমাণবিক বিজ্ঞানীকে। তাদের হত্যা করেছে ইরানের মাটিতেই। তাদের বিজ্ঞানীদের কে মেরেছে তার রহস্য এখনো অনুদঘাটিত। তবে বিজ্ঞানীদের রহস্যজনক মৃত্যুর সঙ্গে মোসাদ জড়িত বলে সবাই ধারণা করছে। ইরান যাতে পরমাণু শক্তির অধিকারি হতে না পারে সেজন্য মোসাদ সক্রিয়; তারা মাটির নিচে ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায়ও কয়েকবার আক্রমণ করেছে। যুদ্ধ করার জন্য ইরানের নতুন প্রজন্মের বিমান নেই, ইসরায়েলের অত্যাধুনিক বিমান ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা মোকাবিলায় ইরানের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাও দুর্বল। ইরান থেকে ইসরায়েলের নিকটতম দূরত্ব ১০০০ কিলোমিটার। কিছুদিন আগে ইরান ঘোষণা দিয়ে ইসরায়েলের ওপর তিন শতাধিক ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করেছিল, কিন্তু ইসরায়েলের মাটিতে পড়েছে নিক্ষিপ্ত বোমা-দ্রোনের মাত্র এক শতাংশ। বাকি দ্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র ইসরায়েলের ভূমিতে আঘাত হানার আগেই আকাশে ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। তাই ইরান মুখোমুখি যুদ্ধে জড়াবে বলে মনে হয় না। হামাস, হিজবুল্লাহ, হুতিরা হচ্ছে গিনিপিগ- এরা অহর্নিশ প্রাণ দিয়ে যাচ্ছে।

মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলোর রয়েছে প্রচুর সম্পদ, অসংখ্য সৈন্য, অগুণতি কেনা সর্বাধুনিক মারণাস্ত্র- এগুলোর ব্যবহার হয় নিজের মধ্যে পারষ্পরিক যুদ্ধে। পশ্চিম পাকিস্তানের সাবেক প্রধান বিচারপতি এম আর কায়ানি তার ‘নট দ্য হোল ট্রুথ’ বইতে লিখেছেন, পাকিস্তানের সৈন্যরা শুধু নিজের দেশ দখল করতে পারে, তাদের অস্ত্র ব্যবহৃত হয় নিজের দেশের জনগণের বিরুদ্ধে। কায়ানির কথাটি সম্ভবত ইরানসহ প্রায় সকল মুসলিম দেশের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।

জিয়াউদ্দীন আহমেদ: সাবেক নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংকের ও সাবেক এমডি, টাকশাল।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ