রানা প্লাজা হত্যা মামলা
১১ বছরেও শেষ হয়নি বিচার, রানা বাদে সব আসামি জামিনে মুক্ত
সাভারে রানা প্লাজা ধসের ১১ বছর অতিবাহিত হলেও এখন পর্যন্ত এই ঘটনায় হত্যা মামলার বিচার শেষ হয়নি; উপরন্তু এ মামলায় ভবন মালিক সোহেল রানা ছাড়া বাকি সব আসামি জামিনে আছেন। আবার ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়া সেই ভবন নির্মাণে ত্রুটি থাকার অভিযোগে করা ইমারত নির্মাণ বিধিমালা আইনের মামলাটির বিচারেও অগ্রগতি নেই। প্রতি বছর ২৪ এপ্রিল হলেই বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ওই ঘটনায় নিহত শ্রমিকদের স্মরণ করা হয়। দেশের বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠন, নিহত শ্রমিকদের স্বজনরা দাবি তোলেন ন্যায় বিচারের; কিন্তু দিন যায়, মাস যায়, বছর যায় বিচার আর মেলে না।
অথচ দেশ-বিদেশে বহুল আলোচিত এই ঘটনায় করা হত্যা মামলাটির রায় গত ১১ বছরেও ঘোষণা করা সম্ভব হয়নি। সাক্ষ্যগ্রহণে ধীরগতি ও দীর্ঘসূত্রতার কারণে মামলাটি এখনো নিষ্পত্তি হয়নি বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। এর পরিপ্রেক্ষিতে গত ১৫ ফেব্রুয়ারি সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ এই হত্যা মামলাটি আগামী ছয় মাসের মধ্যে নিষ্পত্তির নির্দেশ দিয়েছেন বিচারিক আদালতকে। সেইসঙ্গে ভবন মালিক সোহেল রানার জামিন ওই সময় পর্যন্ত স্থগিত রাখার আদেশ দিয়েছেন সর্বোচ্চ আদালত।
রানা প্লাজা ভবনটির মালিক সোহেল রানাকে ভবন ধসের ঘটনায় ২০১৩ সালের ২৯ এপ্রিল বেনাপোল থেকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। এরপর থেকে তিনি কারাগারে আছেন।
ওই ঘটনায় অবহেলাজনিত মৃত্যুর অভিযোগে হত্যা মামলা করে পুলিশ। ইমারত নির্মাণ আইন লঙ্ঘন করে ভবন নির্মাণের অভিযোগে একটি মামলা করে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ-রাজউক। এ ছাড়া দুর্নীতি দমন কমিশন-দুদক ভবন নির্মাণ-সংক্রান্ত দুর্নীতি নিয়ে আরেকটি মামলা করে।
হত্যা মামলায় গত বছরের ৬ এপ্রিল হাইকোর্ট সোহেল রানার জামিন মঞ্জুর করে। রাষ্ট্রপক্ষ এর বিরুদ্ধে আবেদন করলে ওই বছরের ৯ এপ্রিল চেম্বার জজ আদালত সোহেল রানাকে দেয়া হাইকোর্টের জামিন স্থগিত করেন। সেইসঙ্গে রাষ্ট্রপক্ষের করা আপিল আবেদনটি আপিল বিভাগের নিয়মিত বেঞ্চে শুনানির জন্য পাঠানো হয়। গত বছরের ১০ জুলাই আবার শুনানি শেষে রানার জামিন আবেদন মুলতবি রাখা হয়। এর ধারাবাহিকতায় গত ১৫ ফেব্রুয়ারি বিষয়টি আবার আদালতে ওঠে এবং আপিল বিভাগ মামলা নিষ্পত্তির জন্য ছয় মাস সময় বেঁধে দেয়। মামলাটি এখন সাক্ষ্য গ্রহণ পর্যায়ে রয়েছে। ঢাকার অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ সৈয়দা মিনহাজ উম মুনীরার আদালতে সাক্ষ্য গ্রহণ চলছে।
রানা প্লাজা ধসের ঘটনায় করা হত্যা মামলা উচ্চ আদালতের আদেশে প্রায় ছয় বছর স্থগিত থাকার পর ২০২২ সালে সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয়। তবে ইমারত বিধি না মেনে ভবন তৈরির মামলার কার্যক্রম উচ্চ আদালতের আদেশে স্থগিত রয়েছে। রানা প্লাজা ধসের পরপর বেশ কয়েকটি মামলা হলেও এ দুটিই মূল মামলা। দুই মামলায় ভবন মালিক সোহেল রানা কারাগারে থাকলেও অধিকাংশ আসামি জামিনে বা পলাতক রয়েছেন।
রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী বিমল সমাদ্দার বলেন, ‘রানা প্লাজা ধসের ঘটনায় করা হত্যা মামলার গতি ফেরাতে আগামী মে মাস থেকে প্রতি সপ্তাহে তিনটি করে তারিখ রাখা হবে সাক্ষ্য নেয়ার জন্য। কারণ সর্বোচ্চ আদালত ছয় মাসের মধ্যে এই মামলা নিষ্পত্তির নির্দেশ দিয়েছেন।’ তিনি বলেন, ‘সকল সাক্ষীদের আমরা পাবো না। আর সব সাক্ষীর সাক্ষ্য দরকারও নেই। দ্রুত মামলার বিচার শেষ করতে চেষ্টা থাকবে। দেখা যাক কতদূর সফল হই।’
২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল সাভার বাসস্ট্যান্ড-সংলগ্ন ১০ তলা রানা প্লাজা ভবন ধসে পড়ে। ওই ভবনে থাকা কয়েকটি পোশাক কারখানার ৫ হাজারের মতো শ্রমিক তার নিচে চাপা পড়েন। কয়েক দিনের উদ্ধার তৎপরতায় ১ হাজার ১৩২ জনের লাশ পাওয়া যায়। ধ্বংসস্তূপের নিচ থেকে ২ হাজার ৪৩৮ জনকে জীবিত উদ্ধার করা হয়। তার মধ্যে প্রায় ২ হাজার শ্রমিক আহত ও পঙ্গু হন। ঘটনার ৫ দিন পর ২৯ এপ্রিল ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পথে সোহেল রানাকে যশোরের বেনাপোল থেকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। মামলা দায়েরের দুই বছরের বেশি সময় পর ২০১৫ সালের ১ জুন তদন্ত শেষে দুটি অভিযোগপত্র জমা দেন তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডির সহকারী পুলিশ সুপার বিজয় কৃষ্ণ কর। এর একটিতে পরিকল্পিত হত্যার অভিযোগে ভবন মালিক সোহেল রানা, তার বাবা-মা এবং তৎকালীন সাভার পৌরসভার মেয়র ও কমিশনারসহ ৪১ জনকে আসামি করা হয়। আর ইমারত বিধি না মেনে রানা প্লাজা নির্মাণের অভিযোগে অপর অভিযোগপত্রে সোহেল রানাসহ ১৮ জনকে আসামি করা হয়। দুই অভিযোগপত্রে মোট আসামি ছিলেন ৪২ জন। এর মধ্যে সোহেল রানাসহ ১৭ জন দুটি মামলারই আসামি।
২০১৬ সালের ১৮ জুলাই ঢাকার তৎকালীন জেলা ও দায়রা জজ এস এম কুদ্দুস জামান ৪১ আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের মাধ্যমে হত্যা মামলার বিচার শুরুর আদেশ দিয়েছিলেন। এ মামলায় অভিযুক্ত ৪১ আসামির মধ্যে বর্তমানে কারাগারে আছেন কেবল ভবন মালিক সোহেল রানা। আসামিদের মধ্যে রানার বাবা আব্দুল খালেক ওরফে কলু খালেক, আবু বক্কর সিদ্দিক ও আবুল হোসেন এরই মধ্যে মারা গেছেন। অভিযোগ গঠনের পরপর সাভার পৌরসভার তৎকালীন মেয়র রেফায়েত উল্লাহ এবং তৎকালীন কাউন্সিলর মোহাম্মদ আলী খানসহ আটজন মামলা বাতিল চেয়ে হাইকোর্টে আবেদন করেন। তাদের আবেদনে হাইকোর্ট মামলার কার্যক্রম স্থগিত করে রুল জারি করে। এতে করে আটকে যায় মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ প্রক্রিয়া। পরে মোহাম্মদ আলী খান বাদে অন্য আসামিদের স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার হয়। অভিযোগ গঠনের সাড়ে পাঁচ বছর পর ২০২২ সালের ৩১ জানুয়ারি ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ এ এইচ এম হাবিবুর রহমান ভূঁইয়ার আদালতে এ মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়। বর্তমানে তা চলমান আছে।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে