Views Bangladesh

Views Bangladesh Logo

ক্রিকেটে ঘোরতর পেশাদারিত্বের জয়

Dulal Mahmud

দুলাল মাহমুদ

বুধবার, ২২ নভেম্বর ২০২৩

শেষ ভালো যার, সব ভালো তার। এটা অস্ট্রেলিয়ানদের চেয়ে কে আর ভালো জানে? যে কারণে এবারের ক্রিকেট বিশ্বকাপে শুরুটা খারাপ হলেও তা নিয়ে তারা মোটেও ভাবিত ছিল না। লক্ষ্যমাত্রা যতই কঠিন বা দুরূহ হোক না কেন, তা পরিপূরণে অসম্ভব বলে কোনো শব্দ তাদের অভিধানে নেই। ‘মেঘ দেখে কেউ করিস নে ভয়, আড়ালে তার সূর্য হাসে’, এটা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন অস্ট্রেলিয়ানরা। প্রতিকূল পরিস্থিতিতে তারা কখনো ভেঙে পড়েন না। এবার ভারতের মাটিতে যেভাবে শিরোপার ‘ছক্কা’ হাঁকিয়েছেন, তার তুলনা মেলা ভার।

যদিও ক্রিকেট বিশ্বকাপ শুরুর আগে থেকেই দলে বিভিন্ন সংকট দেখা দেয়। ইনজুরির কারণে দল গড়াই বেশ কঠিন হয়ে পড়ে। তার প্রতিফলন দেখা যায় প্রথম দুই ম্যাচে। হারতে হয় ভারত এবং দক্ষিণ আফ্রিকার কাছে। এমনটা অজিদের সঙ্গে যায় না। এ পরাজয় তাদের অহমকে আঘাত না করে পারে না। এরপর ধীরে ধীরে নিজেদের গুছিয়ে নিতে থাকে। তবে হুট করে তারা ফুঁসে ওঠে না, যা করার করে ঠান্ডা মাথায়। অনেক ভেবেচিন্তে। প্রতিটি ধাপ এগিয়ে যায় মেপে মেপে। আপাতদৃষ্টিতে তাদের খেলা অনুজ্জ্বল মনে হলেও তাতে থাকে ঘোরতর পেশাদারিত্ব। এটা অর্জিত হয়েছে তাদের জাতিগত, ভৌগোলিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে। অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেটে রয়েছে সমৃদ্ধ ইতিহাস। রয়েছে আঞ্চলিক ক্রিকেটের শক্তিশালী, প্রতিযোগিতামূলক ও প্রতিষ্ঠিত ব্যবস্থা, যা বিশ্বমানের ক্রিকেটার তৈরি করে।

অস্ট্রেলিয়ার ক্রীড়া সংস্কৃতি দেশের নাগরিকদের ক্রীড়ামুখী করে তোলে। ক্রীড়া সংস্কৃতি কার্যকর করার ক্ষেত্রে কঠোর ব্যবস্থা অনুসরণ করা হয়। এর কারণ, ক্রীড়া সুবিধা বিকাশে বিনিয়োগ করা হয় বিপুল পরিমাণ অর্থ। তাদের জলবায়ু আউটডোর খেলাধুলার জন্য খুবই উপযোগী। দেশের সীমানার অনুপাতে জনসংখ্যাও বেশি নয়। এ কারণে রাগবি, হকি, সাঁতারের মতো খেলায় তাদের সাফল্য রয়েছে। তবে ক্রিকেট জাতীয় খেলা হওয়ায় এর জনপ্রিয়তা অত্যন্ত বেশি। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে যথেষ্ট সাফল্য এসেছে। এ সাফল্যের পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট প্রতিযোগিতা ‘শেফিল্ড শিল্ড’। সবচেয়ে শক্তিশালী ঘরোয়া এ প্রতিযোগিতায় অংশ নেয় মাত্র ছয়টি রাজ্য দল। ডাবল রাউন্ড রবিন লিগ ভিত্তিতে খেলা হওয়ায় ম্যাচগুলো তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হয়। বিভিন্ন দল এবং খেলোয়াড়দের মধ্যে তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বিতা, স্নায়ুযুদ্ধ ও সুদৃঢ় ব্যবস্থাপনার মধ্যে যেসব খেলোয়াড় উঠে আসেন, আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তাদের খুব বেশি বেগ পেতে হয় না।

আশির দশকের শেষ দিকে গড়ে তোলা হয় অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেট একাডেমি। এ একাডেমির মাধ্যমেও অনেক ক্রিকেটার উঠে আসেন। এর প্রথম পরিচালক ছিলেন সাবেক আন্তর্জাতিক ক্রিকেটার রডনি মার্শ। প্রতিভাবান ক্রিকেটার শনাক্ত ও পরিচর্যা করার কাজে তিনি অত্যন্ত দক্ষতার স্বাক্ষর রাখেন। তার মাধ্যমে উঠে আসা উল্লেখযোগ্যরা হলেন অ্যাডাম গিলক্রিস্ট, জ্যাসন গিলেস্পি, ব্রেট লির মতো খ্যাতিমান ক্রিকেটাররা। তবে এ একাডেমির ক্রিকেটারদের মধ্যে আছেন শেন ওয়ার্ন, রিকি পন্টিং, মাইকেল বিভান, গ্লেন ম্যাকগ্রা, মাইকেল ক্লার্ক, মাইকেল হাসি, মাইকেল স্ল্যাটার, অ্যান্ড্রু সাইমন্ডস, শেন ওয়াটসনের মতো অসংখ্য ক্রিকেটার, যারা দীর্ঘদিন উজ্জ্বল করেছেন দেশের মুখ। এখনো উঠে আসছেন ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ক্রিকেটাররা।

প্রকৃতপক্ষে জাতীয় দলের খেলোয়াড় তৈরির সূতিকাগার হিসেবে সাজানো হয় অস্ট্রেলিয়ার ঘরোয়া ক্রিকেট। প্রথম দেশ হিসেবে অস্ট্রেলিয়া খেলোয়াড়দের জন্য প্রবর্তন করে কেন্দ্রীয় চুক্তি। ফলে অর্থ উপার্জনের জন্য ক্রিকেটাররা আর প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটের ওপর নির্ভরশীল নন। ফাস্ট বোলারদের যাতে অতিরিক্ত কাজের লোড নিতে না হয়, সে কারণে কাউন্টি ক্রিকেট খেলার অনুমতি দেওয়া হয় না; কিন্তু অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের জন্য ব্যাটসম্যানদের কাউন্টি ক্রিকেট খেলার জন্য উৎসাহিত করা হয়। সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে তারা অত্যন্ত কৌশলী।

অস্ট্রেলিয়ার হয়ে ‘ব্যাগি গ্রিন’ ক্যাপ পরা অত্যন্ত গৌরবজনক মনে করা হয়। জাতীয় দলে স্থান করে নেওয়া খুব কঠিন। ক্যাপ সহজে দেওয়া হয় না। খেলোয়াড় নির্বাচনি নীতির প্রশ্নে অত্যন্ত আপোষহীন এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে নির্মমও বলা যায়। কখনোই ঐতিহাসিক পারফরম্যান্স বা অনুভূতির ভিত্তিতে খেলোয়াড় বা দল নির্বাচন করা হয় না। প্রথম ও শেষ কথা খেলোয়াড়ের ফর্ম। এ কারণে সব সময় ক্রিকেট মাঠে দেখা যায় যোগ্যতম অজি একাদশ।

অস্ট্রেলিয়াতে ক্রিকেটের জন্য অন্যান্য কিছু দেশের মতো খুব বড় প্রতিভা পুল নেই। তাই তাদের প্রতিভা নষ্ট না করার জন্য সতর্ক থাকতে হয়। অস্ট্রেলিয়ান নির্বাচক এবং কোচিং স্টাফরা সংক্ষিপ্ত তালিকায় থাকা ক্রিকেটারদের সফল হওয়ার জন্য যা যা লাগে, তা নিশ্চিত করার জন্য যত্নবান হতে মোটেও দ্বিধা করেন না। চিহ্নিত ক্রিকেটাররা যাতে সফল হন, তা নিশ্চিত করার জন্য নির্বাচকরা সতর্কতার সঙ্গে কাজ করেন। এ ক্রিকেটাররা পারফর্ম না করলে তাদের দল থেকে বাদ দেওয়া হয়। তবে তারা কী ভুল করছেন এবং কীভাবে তা সংশোধন করতে হবে, সে সম্পর্কে স্পষ্ট বার্তা দেওয়া হয়, যাতে তারা দলে ফিরে আসতে পারেন। অন্তত এটা নিশ্চিত করা হয় যে, অস্ট্রেলিয়া দলে অভিজ্ঞ খেলোয়াড়দের মূল্য রয়েছে।

নির্বাচকরা খেলোয়াড়দের মধ্যে নিরাপত্তাহীনতা দূর করতে এবং একটি সত্যিকারের দলের মনোভাব গড়ে তুলতে জাতীয় পর্যায়ে একটি সুস্থির দল রাখার চেষ্টা করেন। এ কারণে বয়স হলেও তাদের সহসা বাদ দেওয়া হয় না। এবারের ১৬ সদস্যের অস্ট্রেলিয়া দলের ১১ জনই ত্রিশের সীমানা পেরিয়ে এসেছেন। সবচেয়ে সিনিয়র সদস্য ডেভিড ওয়ার্নার বিশ্বকাপে দলের পক্ষে সর্বাধিক রান সংগ্রহ করেছেন। সফল ব্যাটসম্যানদের মধ্যে ছিলেন মিচেল মার্শ, গ্লেন ম্যাক্সওয়েল, স্টিফেন স্মিথরা। সাফল্য পেয়েছেন সিনিয়র বোলাররাও। তার মানে এই নয়, অভিজ্ঞ বা সিনিয়র হলেই অস্ট্রেলিয়া দলে থাকার নিশ্চয়তা পাওয়া যাবে। এ ক্ষেত্রেও নির্বাচকরা কোনো ছাড় দিতে রাজি নন।

১৯৯৯ সালের বিশ্বকাপে অস্ট্রেলিয়ার সবচেয়ে সফল দুই ব্যাটসম্যান ছিলেন স্টিভ এবং মার্ক ওয়াহ। স্টিভ ওয়াহর অধিনায়কত্বে চ্যাম্পিয়ন হয় অজিরা। ব্যাটসম্যান হিসেবেও অসাধারণ পারফরম্যান্স দেখিয়েছেন। বিশ্বকাপে সর্বাধিক রান সংগ্রহকারী চার ব্যাটসম্যানের মধ্যে দুজন ছিলেন ওয়াহ জমজদ্বয়। দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে শ্বাসরুদ্ধকর ম্যাচে তার নেতৃত্ব স্মরণীয় হয়ে আছে; তা সত্ত্বেও ওয়াহ ভ্রাতৃদ্বয়কে ২০০৩ সালের বিশ্বকাপের জন্য অস্ট্রেলিয়ার পরিকল্পনার অংশ নয় বলে বাদ দেওয়া হয়। অর্থাৎ এ বিষয়ে কোনো আবেগপ্রবণতা কাজ করেনি। নির্মম বাস্তবতাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। ব্যক্তির চেয়ে দল বড়, এ নীতিতে বিশ্বাস করে অস্ট্রেলিয়া। তবে যখন একজন খেলোয়াড় অবসর নেন, তখন তার জন্য আরও ভালো বিকল্প খুঁজে বের করার চেষ্টা করা হয়। আর এ কারণে শিরোপা জয়ের সব উপচার অনুকূলে থাকা সত্ত্বেও পেশাদারিত্বের কাছে হার মানতে হয় ফেবারিট ও স্বাগতিক দল ভারতকে।

এবারের অস্ট্রেলিয়ান দলে তুলনামূলকভাবে তারকাদ্যুতিসম্পন্ন ক্রিকেটার তেমন একটা ছিলেন না। অন্তত ভারতীয় দলের তুলনায় তো বটেই। একজন বিরাট কোহলি কিংবা মোহাম্মদ শামি না থাকলেও শ্রেষ্ঠত্বের সিংহাসনে আসন করে নিতে সমস্যা হয়নি। মহাতারকা না হয়েও দলের সাফল্যে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই চমকপ্রদ অবদান রেখেছেন অনামীরা। বিভিন্ন ম্যাচে সেরা অ্যাডাম জাম্পা, ডেভিড ওয়ার্নার, গ্লেন ম্যাক্সওয়েল, ট্র্যাভিস হেড, মিচেল মার্শদের পাশাপাশি জোশ হ্যাজেলউড, মিচেল স্টার্ক, জেমস কামিন্স, মারনাস লাবুশেন, স্টিভ স্মিথরাও কার্যকর অবদান রাখেন। দলে মাঝারি মাপের একাধিক অলরাউন্ডার থাকার কারণে বিশ্বকাপ জেতা খুব সহজ হয়ে যায়। বোলাররাও ব্যাট হাতে কিছু না কিছু ভূমিকা রেখেছেন।

অস্ট্রেলিয়ানদের শারীরিক সক্ষমতা ও মানসিক দৃঢ়তা ঐতিহ্যগতভাবে খেলোয়াড়দের মধ্যে দেখতে পাওয়া যায়। কঠিন পরিস্থিতিতে শক্তিশালী হয়ে বেরিয়ে আসার তাদের এক অদ্ভুত ক্ষমতা রয়েছে। অস্ট্রেলিয়ানরা কখনই লড়াকু মনোভাব ত্যাগ করে না এবং মাঠে সর্বদা আক্রমণাত্মক থাকাটা তাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের অংশ। যে কারণে ক্রিকেট সাম্রাজ্যে আধিপত্য বিস্তার করে আছে দলটি। এমনটা সম্ভব হয়েছে অনেক দিনের চেষ্টা ও সাধনায়। ক্রিকেটে নিজেদের অবস্থান সুদৃঢ় করতে হলে বাংলাদেশকেও একই দীক্ষায় দীক্ষিত হওয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই।

লেখক: সম্পাদক, পাক্ষিক ক্রীড়াজগত

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ