Views Bangladesh

Views Bangladesh Logo

জাস্টিন ট্রুডোর রাজনৈতিক উত্থান ও পতন

Simon Mohsin

সাইমন মোহসিন

শুক্রবার, ১০ জানুয়ারি ২০২৫

দোলনায় দুলতে দুলতেই রাজনৈতিক জীবন শুরু হয়েছিল জাস্টিন ট্রুডোর। ১৯৭১ সালের ক্রিস্টমাস ডে-তে জন্ম তার। পিতা এলিয়ট ট্রুডো ছিলেন কানাডার ১৫তম প্রধানমন্ত্রী। মা মার্গারেটও ছিলেন রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। বাবা-মার কল্যাণে ছোটবেলা থেকেই জাস্টিন ট্রুডোর ওপর এসে পড়েছিল রাজনীতির আলো। রাজনৈতিক পরিবেশেই বেড়ে উঠেছেন তিনি; কিন্তু এখন তার সময়টা খুব একটা ভালো যাচ্ছে না। কাছের মিত্রদের কাছ থেকেই পরিত্যক্ত। বিশ্বব্যাপী ক্ষমতাচক্রের যে বলয় পরিবর্তন হচ্ছে তাতেও কানাডা যোগ দিতে পারছে না।

অথচ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে জাস্টিন ট্রুডোর জীবন শুরু হয়েছিল অজস্র উচ্চাভিলাষী প্রতিশ্রুতি দিয়ে। যার মধ্যে ছিল জলবায়ু ব্যবস্থার উন্নতি, আদিবাসীদের সঙ্গে পুনর্মিলন, নির্বাচনী সংস্কার এবং কানাডার বৈশ্বিক ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধার করা। তিনি কানাডায় চাইল্ড বেনিফিট বাড়িয়েছিলেন, মধ্যবিত্তের ট্যাক্স কমিয়েছিলেন। কানাডায় গাঁজা বৈধ করার মতো ব্যবস্থা করেছিলেন। আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও তার ভূমিকা ছিল প্রবল। বহুপাক্ষিকতার ওপর জোর দিয়েছিলেন তিনি। মুক্তবাণিজ্যের পক্ষে ছিলেন। নারীদের অধিকার বিষয়ে সুদূরপ্রসারী দৃষ্টি দিয়েছিলেন। বারাক ওবামার মতো নিজের একটা অবস্থান তৈরি করেছিলেন তিনি।

২০১৫ সালের নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে ভোট পেয়ে নির্বাচিত হলেও ২০১৯ সালে ট্রুডোর লিবারাল পার্টি সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারায়। ২০২১ সালে আগাম নির্বাচন দিয়েও দলের ভাগ্য আর ফেরেনি। সম্প্রতি মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয়বৃদ্ধি এবং মূল্যস্ফীতির কারণে ট্রুডোর জনপ্রিয়তা আরও কমে যায়। এই জনপ্রিয়তা কমে যাওয়ার কারণ হিসেবে বলা হয়েছে তিনি প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেছেন। কিছু অনৈতিক কাজও তিনি করেছেন।


যার মধ্যে আছে নির্বাচনী সংস্কার বাস্তবায়নে ব্যর্থ হওয়া এবং এর ঘাটতিগুলো পূরণ করতে না পারা, যা তার রাজনৈতিক ভিত্তিকে অনেকটাই টালমাটাল করে দিয়েছে। এসএনসি-লাভালিন কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে পড়া, তার বিলাসবহুল অবকাশের ছবি প্রকাশও তার ব্যক্তিত্বকে অনেকটা হেয় করেছে। যার ফলে তার প্রতি জনগণের বিশ্বাসযোগ্যতা অনেক কমে গেছে। আদিবাসী নেতারাও ট্রুডোর সঙ্গে এক প্রকার সমঝোতা করতে চেয়েছিলেন, সেখানেও কোনো অগ্রগতি হয়নি। এতে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মাঝেও তার জনপ্রিয়তা কমেছে। এর সঙ্গে আছে মুদ্রাস্ফীতি, আবাসন ব্যয় এবং স্বাস্থ্যসেবা সংক্রান্ত সমস্যা। যেসব কারণে জনসাধারণের হতাশা বেড়েছে।


ট্রুডোর অভিবাসন নীতিও অত্যন্ত বাজে মনে করেন জনসাধারণ। যার কারণে অভিবাসীদের চাপে স্থানীয়রাই এখন আবাসন সমস্যায় ভুগছেন। হুয়াওয়ের মেং ওয়ানঝোকে গ্রেপ্তারের পর চীনের সঙ্গেও কানাডার সম্পর্ক খারাপ হয়েছে। মানে আন্তর্জাতিক নীতিতেও তিনি ব্যর্থ। কানাডায় সন্ত্রাসী হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার জন্য মোদি সরকারকে অভিযুক্ত করেছেন জাস্টিন ট্রুডো। যার ফলে ভারতের সঙ্গে কানাডার সম্পর্কের অবনিত হয়েছে। কানাডার নির্বাচনে বিদেশি হস্তক্ষেপ বিষয়ে একটি সরকারি তদন্ত হাইলাইট করেছে এবং এমপিদের সম্পর্কে সমালোচনা থাকা সত্ত্বেও ট্রুডো তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি, এটাও ট্রুডোর নিষ্ক্রিয়তা তুলে ধরেছে।

অন্যান্য বিষয় থেকে চোখ সরিয়ে ভারতের সঙ্গে ট্রুডোর সম্পর্ক বিষয়ে একটু নজর দেয়া যাক। ভারতের সঙ্গে কানাডার সম্পর্ক, বিশেষ করে ট্রুডোর জন্য বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। ১৯৮৪ সালের শিখ-বিরোধী দাঙ্গাকে ‘গণহত্যা’ হিসেবে ঘোষণা করার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে কানাডার পার্লামেন্ট, অন্টারিওর হরিন্দর মালহির একটি প্রস্তাবের পর ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য সম্প্রসারণের পথ ট্রুডোর জন্য অনেকটা আশার আলো হিসেবে প্রকাশিত হয়েছিল। এর মধ্যে ট্রুডো আবার খালসা দিবস উদযাপন করতে গিয়ে খালিস্তানপন্থিদের সমর্থন দেন। ২০২৩ সালের জুন মাসে খালিস্তানি নেতা হরদীপ সিং নিজ্জরকে গুলি করে হত্যার ঘটনায় জাস্টিন ট্রুডো ভারতীয় এজেন্টদের জড়িত থাকার অভিযোগ আনেন। এতে অনেক কানাডিয়ান পর্যন্ত বিস্মিত হন। ভারতের বিরুদ্ধে ট্রুডোর এই অভিযোগকে অভ্যন্তরীণ চ্যালেঞ্জ থেকে সরে যাওয়ার রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে দেখেন অনেক কানাডিয়ান। সমালোচকরা যুক্তি দেন, তার উদ্দেশ্য ছিল দ্বিমুখী: খালিস্তানি শিখ ভোটারদের আকৃষ্ট করা এবং তার নিজের লিবারেল পার্টি ককাসের মধ্যে সম্ভাব্য ভিন্নমতসহ অভ্যন্তরীণ বিভ্রান্তি তৈরি।

এটা ছিল এক কাঁচাবুদ্ধি। ট্রুডোর বয়স এখন ৫৩, এর তুলনায় এক দশক আগে যখন তার বয়স ৪৩ ছিল তখন অনেক বেশি পরিপক্বতার পরিচয় দিয়েছিলেন। অনেকে প্রশ্ন তুলতে পারে, দলীয় সংশ্লিষ্টতা কাটিয়ে তিনি হয়তো সর্বোত্তম প্রধানমন্ত্রী হয়ে ওঠার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু এই আদর্শবাদী মনোভাব আসলে নির্বুদ্ধিতার পরিচয় বলেই মনে করেন অনেকে। এটি ছিল একটা রাজনৈতিক ভুল। অন্যান্য ব্যর্থতার সঙ্গে যুক্ত হয়ে এসবই এখন তার বিরুদ্ধে বিষফোঁড়া হয়ে উঠেছে।

কানাডার নির্বাচনী আইন অনুসারে, প্রতি চার বছরের মাথায় অক্টোবরের তৃতীয় সোমবারের মধ্যে কানাডিয়ানদের ভোটে যাওয়ার কথা। তাই ২০২৫ সালে একটি নির্বাচনের আশা করছে কানাডিয়ার নাগরিকরা। লিবারেল পার্টির নেতা হিসেবে পদত্যাগ করার ঘোষণা দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে নতুন নেতৃত্বের জন্য প্রতিযোগিাতায় নেমেছিলেন এবং স্বয়ংক্রিয়ভাবে নতুন প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আগ পর্যন্ত সংসদের সমাপ্তি না টেনে তাকে স্থগিত করেছিলেন।


জাস্টিন ট্রুডোর বর্তমান রাজনৈতিক বক্তৃতা পুরো দেশের ওপর দৃষ্টিনিবন্ধন না করে তার নিজের ওপরই বেশি আলো ফেলেছে, যাতে তার আত্মরতিমূলক আচরণকেই প্রতিফলিত করে। এতে বোঝা যায় যে করেই হোক, তিনি নিজেই সবসময় আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকতে চান। অন্যসব বিষয় নিয়ে তার তেমন মাথাব্যথা নেই। ফলে আঞ্চলিক গোষ্ঠীগুলো থেকে প্রধানমন্ত্রী ট্রুডোর জনপ্রিয়তা অনেক কমে গেছে। এই জটিল পরিস্থিতি সামাল দিতে লিবারেল দল নানাভাবে চেষ্টা করছে।

কানাডায় বর্তমানে যে ধরনের ভাবাবেগ বিরাজ করছে তাতে এটাই বোঝা যায় যে, রাজনৈতিক চমক বন্ধ করে সমস্যা সমাধানে মন দিতে হবে। প্রায় ১০ শতাংশ কানাডিয়ান খাদ্য ব্যাঙ্কের ওপর নির্ভর করে। এই খাদ্যনিরাপত্তাহীনতাও কানাডার একটি উল্লেখযোগ্য সমস্যা। বেকারত্ব এবং গৃহহীন মানুষের সংখ্যাও বাড়তে চলেছে। ২০ জানুয়ারি দ্বিতীয়বারের মতো প্রেসিডেন্ট হিসেবে অফিসে বসতে যাচ্ছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। তিনি কানাডার সব রপ্তানির ওপর ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, যা কানাডার অর্থনীতিকে আরও অস্থিতিশীল করতে পারে। ১০ মিলিয়ন অনথিভুক্ত অভিবাসীর গণনির্বাসনের হুমকি কানাডার সীমান্তে উদ্বাস্তুদের ভিড় বাড়াতে পারে। এই আসন্ন চ্যালেঞ্জগুলো কার্যকরভাবে মোকাবিলা করার জন্য ফেডারেল সরকারের কৌশলগত পরিকল্পনার অভাব রয়েছে। বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর ওপর গণভোট না করে বৈচিত্র্যময় রাজনৈতিক মতাদর্শের মধ্যে নেতৃত্ব প্রদানের জন্য একটি নির্বাচনী প্রক্রিয়া প্রয়োজন। জাস্টিন ট্রুডো পদত্যাগ করেছেন, লিবারেল পার্টির নতুন নেতৃত্ব প্রয়োজন এবং নির্বাচকদের তাদের পছন্দের কথা বলার অনুমতি দিতে হবে। এটি করার মাধ্যমেই কানাডার সমাজ আরও স্থিতিশীল এবং অনুমানযোগ্য শাসন কাঠামোতে ফিরে আসতে পারে। এটা অবশ্যই স্বীকার করতে হবে যে, ২০১২-১৩ সালে বব রে যে উদারতা দেখিয়েছিলেন, নেতৃত্বের জায়গা থেকে সরে জাস্টিন ট্রুডোর নেতৃত্বের পথ তৈরি করে দিয়ছিলেন, জাস্টিন ট্রুডোও এখন তা-ই করছেন।

কানাডার বর্তমান পরিস্থিতি এসব জরিপের মধ্যে প্রতিফলিত: ১৯ শতাংশ কানাডিয়ান মনে করেন দেশ ঠিক পথেই আছে। সরকারের কাজে অনুমোদন রয়েছে ২২ শতাংশ নাগরিকের। ১১ শতাংশ জনগণ মনে করেন পুনর্নির্বাচিত সরকার দরকার, তাদের মধ্যে ২৭ শতাংশই লিবারেল ভোটার। লিবারেল ভোট শেয়ার ২০ শতাংশে নেমে এসেছে যা ২৫ শতাংশ কমেছে। জরিপের এই ফলাফল ২০২৪ সালের ডিসেম্বরের জনমত জরিপ থেকে পাওয়া। একটি অবক্ষীয় সরকারের অবস্থা বোঝার জন্য এই জরিপই যথেষ্ট।

সাইমন মোহসিন: রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিকবিষয়ক বিশ্লেষক।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ