ট্রাম্প প্রশাসনের নীতিতে আমেরিকা হতে পারে বাংলাদেশের বড় শ্রমবাজার
যুক্তরাষ্ট্রে ডোনাল্ড ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে অভিবাসন নীতি কঠোর হওয়ার মধ্যেই বাংলাদেশের জন্য উন্মোচিত হতে পারে নতুন এক সম্ভাবনার দুয়ার। ট্রাম্প প্রশাসন অবৈধ অভিবাসন প্রতিরোধে অভিযান তীব্র করলেও, বৈধ পন্থায় নিরাপত্তা কর্মী, নির্মাণ শ্রমিক, ড্রাইভার, এবং পরিষেবা খাতের জন্য দক্ষ শ্রমিক পাঠানোর সুযোগ তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূস এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কৌশলগত শ্রম চুক্তির উদ্যোগ নিলে আগামীতে বাংলাদেশের জন্য বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের বিপ্লব ঘটাতে পারে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
ট্রাম্পের নীতি ও শ্রমবাজারের চাহিদা
ট্রাম্প প্রশাসন গত কয়েক সপ্তাহে অভিবাসন ও সীমান্তনীতি কঠোর করেছে, বিশেষত অবৈধ অভিবাসীদের বিতাড়নের লক্ষ্যে আইসিইর কার্যক্রম ত্বরান্বিত করা হয়েছে। এই পদক্ষেপের ফলে যুক্তরাষ্ট্রের নির্মাণ, পরিবহন, সিকিউরিটি সার্ভিস, এবং পরিষেবা খাতে শ্রমিকের সংকট তৈরি হতে পারে, যেখানে প্রায় ১ দশমিক ৪ কোটি অবৈধ অভিবাসী কর্মরত ছিল। এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, শুধু টেক্সাস ও ক্যালিফোর্নিয়াতেই নির্মাণ শ্রমিকের ৩৫ শতাংশ পূরণের জন্য বৈধ শ্রমিকের প্রয়োজন। বিশেজ্ঞরা মনে করেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস সরকারের উচিত এই মুহূর্তে শূন্যস্থান পূরণে বাংলাদেশি শ্রমিকদের জন্য বিশেষ কোটা চুক্তি করা। এর মাধ্যমে নিরাপত্তা কর্মী (সিকিউরিটি গার্ড), লেবার, ড্রাইভার, এবং হাসপাতাল কর্মীসহ বিভিন্ন পেশায় দক্ষ কর্মী পাঠানোর প্রস্তাব যুক্তরাষ্ট্রের কাছে উপস্থাপন করা।
এ খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা বলেন, ইউনূসের প্রতিনিধিরা ইতিমধ্যে মার্কিন শ্রম মন্ত্রণালয় এবং বাণিজ্য প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনা শুরু করেছেন কি না আমরা জানি না, যদি না করে থাকেন, তা হলে যেখানে কর্মী পেরণের জন্য শ্রমিকদের প্রশিক্ষণ, বৈধ ভিসা প্রক্রিয়া এবং মজুরি নিশ্চিতকরণের ওপর জোর দেয়ার কথা বলেন তারা। এই বিষয়ে জানতে চাইলে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের ডেপুটি সচিব গাজী মো. শাহেদ আনোয়ার ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন, আমেরিকার শ্রমবাজারে ফ্রি শ্রমিক পাঠিয়ে ঠিক একটা লাভবান হওয়া যাবে না। সে ক্ষেত্রে দক্ষ শ্রমিক পাঠানোটাই তাদের লক্ষ্য। তবে আমেরিকারে বাংলাদেশে শ্রম উইং না থাকায় এ বিষটি কিছুটা জটিল হবে হবে বলেও তিনি মনে করেন।
কীভাবে কাজ করবে এই পরিকল্পনা
দ্বিপক্ষীয় চুক্তি: যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের বিদ্যমান বাণিজ্য সম্পর্ককে (প্রায় ১২ বিলিয়ন ডলার) কাজে লাগিয়ে শ্রম চুক্তি স্বাক্ষরের উদ্যোগ নেয়ার দরকার বলে মনে করেন অনেকই। এই চুক্তির আওতায় যুক্তরাষ্ট্র প্রতি বছর নির্দিষ্টসংখ্যক শ্রমিকের জন্য বিশেষ ভিসা কোটা বরাদ্দ করবে, যা H-2B (অস্থায়ী অ-কৃষি কর্মী) এবং H-2A (কৃষি কর্মী) ভিসার মডেলে সাজানো হতে পারে। এ ছাড়া, সিকিউরিটি গার্ড ও স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য E-3 ভিসার সম্প্রসারণের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করার কথাও বলেন তারা।
দক্ষতা উন্নয়ন ও প্রশিক্ষণ
বাংলাদেশের শ্রমিকদের যুক্তরাষ্ট্রের মানদণ্ডে উপযোগী করে গড়ে তুলতে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনা এখনি হতে নেয়া দরকার বলে মনে করেন আমেরিকায় কর্মরত প্রবাসীরা। উদাহরণস্বরূপ, ঢাকায় ‘আমেরিকান স্ট্যান্ডার্ড স্কিল ডেভেলপমেন্ট ইনস্টিটিউট’ প্রতিষ্ঠা করা, যেখানে ইংরেজি ভাষা, প্রযুক্তিগত দক্ষতা এবং নিরাপত্তা প্রোটোকল শেখানো।
রিক্রুটমেন্ট প্রক্রিয়ার সংস্কার:
বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্যে শ্রমিক প্রেরণে রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর দৌরাত্ম্য এবং অর্থনৈতিক শোষণের অভিযোগ রয়েছে। ড. ইউনূসের সরকার এই প্রক্রিয়াকে যদি স্বচ্ছ করতে চান, তা হলে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে নিয়ে এসে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে, যেখানে সরাসরি মার্কিন নিয়োগকর্তাদের সঙ্গে শ্রমিকদের সংযুক্ত করা।
মজুরি ও কর্মীদের অধিকার নিশ্চিতকরণ
যুক্তরাষ্ট্রের ন্যূনতম মজুরি (ফেডারেল $১৫/ঘণ্টা) এবং শ্রম আইনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে চুক্তি করা যেতে পারে। যা বাংলাদেশি শ্রমিকদের আয়ের নিশ্চয়তা দেবে। এ ছাড়া, শ্রমিকদের জন্য স্বাস্থ্যবীমা এবং আইনি সহায়তা প্রদানের ব্যবস্থা চুক্তিতে অন্তর্ভুক্ত করার কথা বলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ।
অর্থনৈতিক প্রভাব: মধ্যপ্রাচ্যকে ছাড়িয়ে যাওয়ার স্বপ্ন
বর্তমানে বাংলাদেশের ১ দশমিক ৫ কোটি প্রবাসী শ্রমিকের মধ্যে প্রায় ১ কোটি মধ্যপ্রাচ্য ও মালয়েশিয়ায় কর্মরত। তবে এই অঞ্চলে মজুরি কম, শ্রম অধিকার লঙ্ঘন এবং জীবনযাত্রার মান নিম্ন হওয়ায় প্রবাসী আয় স্থবির হয়ে পড়েছে। অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্রে গড় মজুরি প্রায় ৫-৭ গুণ বেশি, এবং সেখানে পাঠানো প্রতিটি শ্রমিক মাসে গড়ে $২,৫০০-$৩,৫০০ ডলার রেমিট্যান্স পাঠাতে পারবেন বলে মনে করের শ্রম বিশেজ্ঞরা। বিশ্লেষকদের মতে, যদি বছরে ১ লাখ শ্রমিক যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানো যায়, তবে বৈদেশিক মুদ্রা আয় বাড়বে প্রায় ৩-৪ বিলিয়ন ডলার। এটি বাংলাদেশের রেমিট্যান্স আয়কে (বর্তমানে ২৫ বিলিয়ন ডলার) ১৫-২০% বাড়িয়ে দেবে, যা অর্থনীতির জন্য গেমচেঞ্জিং ভূমিকা রাখতে পারে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, ট্রাম্পের অবৈধ অভিবাসী বিতাড়ন এবং তারা উৎপাদনমুখী হওয়া বাংলাদেশের জন্য আশীর্বাদ হতে পারে, যদি বাংলাদেশ সেটাকে ব্যাবহার করতে পারে। তিনি মনে করেন, ট্রাম্প অবৈধ অভিবাসী বিতাড়ন করছেন কিন্তু যারা বৈধ তাদের তো তাড়াচ্ছেন না। আমেরিকায় এই নীতি এ মুহূর্তে বাংলাদেশের জন্য বিশাল একটি মার্কেট তৈরিতে কাজ করতে পারে। এ ছাড়াও তারা সেখানে ইন্ডাস্ট্রি তৈরি করলে তাদের লেবার দরকার হবে, সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশের শ্রমিকদের বিশাল কাজের সুযোগ তৈরি হবে। এক্ষেত্রে মন্ত্রণালয়গুলোকে সমন্বয় করে কাজ করতে হবে বলেও তিনি গুরুত্ব দেন।
চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাব্য ঝুঁকি
যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা: ট্রাম্প প্রশাসন শ্রম ভিসার কোটা কমানোর পক্ষে অবস্থান নিয়েছে অতীতে। তবে, বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে ট্রাম্পের আগ্রহ থাকলে এই নীতি নমনীয় হতে পারে, বিশেষত চীন-যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্যযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশকে বিকল্প উৎপাদন হিসেবে দেখার প্রবণতা কাজে লাগানো যেতে পারে।
প্রতিযোগিতা
ভারত, ফিলিপাইন, এবং মেক্সিকো এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের শ্রমবাজারে বড় ভূমিকা রাখছে। বাংলাদেশকে তাদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে টেকসই অবস্থান নিতে হলে শ্রমিকদের দক্ষতা এবং ভাষাগত যোগ্যতা বাড়ানো জরুরি বলেও মনে করেন বিশেজ্ঞরা।
অভ্যন্তরীণ সংস্কারের অভাব
বাংলাদেশে এখনো প্রশিক্ষিত জনশক্তি তৈরি করতে প্রাতিষ্ঠানিক অবকাঠামো দুর্বল। এ ছাড়া, দুর্নীতিগ্রস্ত রিক্রুটিং প্রক্রিয়া এবং উচ্চ অভিবাসন খরচ (৪-৭ লাখ টাকা) শ্রমিকদের জন্য বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে।
ভূ-রাজনৈতিক প্রাসঙ্গিকতা
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে এই শ্রমচুক্তি করতে পারলে তা শুধু অর্থনৈতিক সুবিধাই নয়, বাংলাদেশের কৌশলগত গুরুত্বও বাড়াবে। ট্রাম্প প্রশাসন চীনের প্রভাব কমাতে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে মিত্র দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করতে চাইছে। বাংলাদেশ যদি যুক্তরাষ্ট্রের শ্রমবাজারে প্রবেশ করে, তবে এটি চীন-সমর্থিত বিআরআই প্রকল্পের ভারসাম্যকারী হিসাবে কাজ করতে পারে। এ ছাড়া, ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রেও বাংলাদেশের অবস্থান শক্তিশালী হবে, কারণ যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত উভয়েই চীনের বিরুদ্ধে কৌশলগত জোট গড়ে তুলতে আগ্রহী হবে।
ড. ইউনূসের ভূমিকা ও আন্তর্জাতিক সমর্থন
ড. মুহাম্মদ ইউনূস তার আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্ক এই উদ্যোগকে এর মধ্যে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ এবং মার্কিন কংগ্রেসের সদস্যদের সঙ্গে আলোচনা করে যদি আমেরিকার সঙ্গে শ্রম চুক্তি করতে পারে, তা দেশের জন্য মাইলফলক হয়ে থাকবে।
বাংলাদেশের জন্য ঐতিহাসিক সুযোগ
ট্রাম্পের নীতির রূঢ়তা যদি বাংলাদেশ কৌশলগতভাবে কাজে লাগাতে পারে, তবে এটি দেশটির অর্থনৈতিক ভাগ্য বদলে দিতে পারে। তবে এর জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক দূরদর্শিতা, প্রশাসনিক দক্ষতা, এবং আন্তর্জাতিক অংশীদারদের সঙ্গে সুসংহত সম্পর্ক। ড. ইউনূসের এই বিষয়ে সঠিক উদ্যোগ নিতে পারলে এবং সফল হলে, বাংলাদেশ শুধু বৈদেশিক মুদ্রাই অর্জন করবে না, বৈশ্বিক শ্রমবাজারে একটি নির্ভরযোগ্য নাম হিসেবেও প্রতিষ্ঠিত হবে।
আমেরিকার মার্কেটে বাংলাদেশের জন্য বড় ধরনের শ্রমবাজার তৈরির ইস্যুতে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. রুহুল আমিন ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন, ইউরোপ এবং আমেরিকার মার্কেটে অদক্ষ শ্রমিক পাঠিয়ে কোনো লাভ হয় না। তাই মন্ত্রণালায় থেকে ইতোমধ্যে ইউরোপে শ্রমিক পাঠানোর জন্য দক্ষ শ্রমিক তৈরিতে মন্ত্রণালয় কাজ করছে। তিনি আরও বলেন, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আমেরিকার মার্কেটে বাংলাদেশি শ্রমিক প্রেরণের বিষয়টি নিশ্চিত করতে পারলে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় তাদের দক্ষ শ্রমিক তৈরিতে কাজ করবে।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে