স্থানীয় প্রশাসনে আস্থার অভাব
উপজেলা নির্বাচনের প্রথম ধাপ অনুষ্ঠিত হয়েছে সম্প্রতি। এই নির্বাচনে আমাদের স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার মৌলিক দুর্বলতা আবারও প্রকট আকারে ফুটে উঠেছে। আমাদের সামগ্রিক শাসন ব্যবস্থাই ব্যাপকভাবে ত্রুটিপূর্ণ। এখানে স্থানীয় সরকারও নানা প্রতিবদ্ধকতা, সীমাবদ্ধতায় আটকানো। এর প্রধান কারণ আমাদের শাসনব্যবস্থার পুরোটাই কেন্দ্রনির্ভর। অর্থের অভাবও প্রকট। প্রাতিষ্ঠানিক কোনো কাঠামো এখানে গড়ে ওঠেনি। নাগরিকদের অংশগ্রহণ নেই বললেই চলে। দীর্ঘকাল ধরে চলমান এই সমস্যা এবারের স্থানীয় নির্বাচনে আরও স্পষ্টভাবে দৃশ্যমান হয়েছে।
গত বুধবার (৮ মে) ১৩৯টি উপজেলায় ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হয় প্রথম ধাপে। নির্বাচন কমিশন জানিয়েছে, ষষ্ঠ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে প্রথম ধাপে গড় ভোট পড়েছে ৩৬ দশমিক ১ শতাংশ। এত কম ভোট পড়ার কারণ হিসেবে অনেকে উল্লেখ করছেন, স্থানীয় সরকার পরিচালনায় কেন্দ্রীয় সরকারের আমলাতান্ত্রিক প্রভাব ছাড়াও স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার রাজনীতিকে জাতীয় রাজনীতি আঁকড়ে ধরেছিল, যার ফলে এই নির্বাচনে খুব কম ভোটার উপস্থিত হয়েছিল।
চলতি বছরের ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হয় সর্বশেষ সাধারণ নির্বাচন, এর পর নির্বাচন কমিশনের বড় চ্যালেঞ্জ ছিল এই উপজেলা নির্বাচনে জাতীয় রাজনীতি ও আমলাতান্ত্রিক প্রভাবমুক্ত রেখে উল্লেখযোগ্যসংখ্যা ভোটার উপস্থিতি নিশ্চিত করা; কিন্তু প্রথম দফায় নির্বাচন কমিশন এই নির্বাচনে ভোটারদের আকৃষ্ট করার জন্য আস্থাশীল পরিবেশ তৈরি করতে ব্যর্থ হয়েছে বলে মনে হচ্ছে।
নির্বাচনের কমিশনের ওপর মানুষের আস্থা হারানোর কারণ প্রতিষ্ঠানটি তার প্রতিশ্রুতিতে অটল থাকতে পারেনি। সাদা চোখেই দেখা গেছে কমিশন অনেক দুর্নীতির আশ্রয় নিয়েছে। জাতীয় রাজনীতির প্রভাব কমিশন ঠেকিয়ে রাখতে পারেনি। দক্ষতা ও যোগ্যতার বদলে অযোগ্য লোকেরাই কর্মী হিসেবে বিবেচিত হয়েছে।
বাংলাদেশে স্থানীয় সরকারের দীর্ঘ ইতিহাস আগে থেকেই খুব একটা ভালো নয়। এর প্রভাব জাতীয় রাজনীতিতেও পড়েছে। জাতীয় রাজনীতির মাঠ বস্তুত ওই প্রান্তিক জনগোষ্ঠী থেকেই তৈরি হয়। ইউনিয়ন পরিষদ স্থানীয় সরকারের সর্বনিম্ন স্তর, সেখানে একটি স্থিতিশীল স্থানীয় সরকার কখনোই ছিল না। দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন এবং গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করার জন্য গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর ভূমিকা অত্যন্ত গুররুত্বপূর্ণ; কিন্তু, দেখা গেছে আমাদের প্রান্তিক জনগোষ্ঠী এবং স্থানীয় সরকার এটি করতে ব্যর্থ হয়েছে, যার ফলে জাতীয় রাজনীতিও দিন দিন কলুষিত হয়েছে। আর এখন কোথাও বিরোধী দলের নামগন্ধ নেই। সব নির্বাচনই তারা পরিত্যাগ করেছে। ফলে স্থানীয় সরকার কার্যালয়গুলো সবই ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের দখলে। একচেটিয়া রাজনীতিই চলছে সর্বত্র।
দেশের এহেন রাজনৈতিক সংস্কৃতিই দেশের রাজনীতিশূন্যতা তৈরি করেছে। এ কারণে বাংলাদেশের স্থানীয় সরকার কাঠামোতে গণতান্ত্রিক পরিবেশ গড়ে ওঠেনি। উপজেলা নির্বাচনের প্রথম ধাপের আগে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) প্রার্থীদের হলফনামা বিশ্লেষণ করে জানা গেছে, আসন্ন উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে প্রথম ধাপে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী প্রার্থীদের প্রায় ৭০ শতাংশই ব্যবসায়ী। তাদের মধ্যে ৯৪ জন কোটিপতি। টিআইবির বিশ্লেষণে স্পষ্ট দেখা গেছে যে, স্থানীয় সরকার নির্বাচনে যারা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন তারা মোটেও স্থানীয় নন।
সহিংসতা, মনোনয়ন সংক্রান্ত অভিযোগ আর দুর্নীতি ইত্যাদির দিকে তাকালে সামগ্রিক ব্যবস্থা সম্পর্কে আমাদের তেমন ভালো ধারণা মনে আসে না। আগে স্থানীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতো নির্দলীয় ভিত্তিতে। ফল অসংখ্য নিরপেক্ষ ও স্থানীয়ভাবে জনপ্রিয় প্রার্থীরা নির্বাচিত হতে পেরেছিলেন; কিন্তু এখন এটি প্রায়ই নেই। এবার ক্ষমতাসীন দল দলীয় প্রতীক ‘নৌকা’ হয়তো কাউকে দেয়নি, কিন্তু ক্ষমতার মাধ্যমে মনোনয়ন প্রক্রিয়া কলঙ্কিত করেছে বলে জানা গেছে। দলের সাধারণ সম্পাদকের বারবার অনুরোধ ও নির্দেশনা সত্ত্বেও ক্ষমতাসীন দলের মন্ত্রী-এমপিরা তাদের কাছের লোকদের নির্বাচনী প্রচার-প্রসারে হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন, নাক ও মাথা গলিয়ে দিয়েছেন। এটা কেন্দ্রীয় নেতাদের কর্তৃত্ববাদী মানসিকতার পরিচয়। কেন্দ্র থেকে তাদের হাত প্রান্ত পর্যন্ত লম্বা হয়ে গেছে।
দলভিত্তিক স্থানীয় নির্বাচন হলেও ক্ষতি ছিল না, যদি স্থানীয় লোকজনই তাদের নেতা বাছাই করতে পারতেন। তাতে তৃণমূলে উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় তাদের অংশগ্রহণ বাড়ানোর সুযোগ দিতে পারতো; কিন্তু, দলভিত্তিক নির্বাচন স্থানীয় প্রতিনিধিদের জাতীয় সরকারের কাছ থেকে সর্বাধিক সুবিধা পাওয়ার সুযোগ করে দেয়। ক্ষমতায় থাকা দলটি একইভাবে স্থানীয় সরকার অফিসগুলোতে নির্বাচিত সদস্যদের পূর্ণ সমর্থন নিয়ে স্থানীয় পর্যায়ে তার কর্মসূচি বাস্তবায়ন করার সুযোগ তৈরি করে। অর্থাৎ, কিন্তু বাস্তবতা হলো, স্থানীয় রাজনীতি কেন্দ্রীয় রাজনীতিতে উঠে না এসে জাতীয় রাজনীতিই বরং এখন স্থানীয় রাজনীতির ওপর প্রভাব সৃষ্টি করছে। দলভিত্তিক নির্বাচন পুরো স্থানীয় সমাজকে বিভক্ত করে দিয়েছে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সঙ্গে বিবাদমান দলগুলো এখন স্থানীয় পর্যায়েও জড়িয়ে পড়েছে।
যেহেতু রাজনৈতিক নেতারা নিজেদের শাসন ব্যবস্থার আধিপত্য বিস্তারের জন্য প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষের উপর নির্ভরশীল, প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষও ক্ষমতা হাতে রাখতে রাজনৈতিক নেতাদের হাতে রাখেন। রাজনৈতিক ক্ষমতা নিজের হাতে রাখতে তারাও বিরোধী দলকে দৌড়ের ওপর রাখেন। সরকারী দলের নেতা এবং প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষের চাপে স্থানীয় সরকারের কার্যক্রম এখন এতটাই মুষ্টিবদ্ধ যে, জনগণ সেখান থেকে বহু দূরে। স্থানীয় সরকারের কার্যক্রম নিয়েও জনগণের এখন আর তেমন উৎসাহ নেই।
এই রাজনৈতিক সংস্কৃতির সবচেয়ে বাজে দিকটি হচ্ছে, তৃণমূল পর্যায়ের মানুষেরা মনে করেন তারা আর স্থানীয় সরকারের অংশ নয়। স্থানীয় রাজনীতিও এখন কেন্দ্রীয় রাজনীতির অংশ বলেই তারা মনে করেন। আর এই রাজনীতিও ধনী ব্যবসায়িরাই নিয়ন্ত্রণ করেন। কোনো প্রতিনিধি বাছাইয়ের ক্ষমতাও আর তাদের হাত নেই। সব খেলা এখন আমলা আর কেন্দ্রীয় নেতাদের হাতে।
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক, সমাজ-রাজনীতি বিশ্লেষক
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে