নরেন্দ্র মোদি শিবিরে ভাটার সুর
গত ১৯ এপ্রিল শুরু হয়েছিল এবারের ভারতের লোকসভা নির্বাচন। ৪৭ দিনের নির্বাচনি কর্মকাণ্ড শেষে আজ ভোট গণনা শুরু হয়েছে। এরই মধ্যে বেসরকারি ফলাফলে এনডিএ জোট ২৮৯, ইনডিয়া জোট ২৩৫ ও অন্যান্য ১৯টি আসন পেয়েছে। সন্ধ্যা নাগাদ জানা যাবে চূড়ান্ত ফল। তখন জানা যাবে বিজেপি নাকি কংগ্রেস, এনডিএ নাকি ইন্ডিয়া জোট লোকসভা নির্বাচনে কারা বিজয়ী হয়ে নতুন সরকারের দায়িত্ব নিচ্ছেন। লোকসভায় নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ার জন্য দরকার অন্তত ২৭২টি আসন। এবারের নির্বাচনে হিন্দু-মুসলিম বিভাজন, সংরক্ষণ ও নাগরিকত্ব আইন, বিরোধীদের গ্রেপ্তারের মতো অভিযোগ উঠেছে। আর এই অভিযোগের কেন্দ্রে আছেন নরেন্দ্র মোদি নিজেই।
আমার যারা পাঠক, তারা জানবেন, সমানে আমি নরেন্দ্র মোদির বিরুদ্ধে কথা বলে গেছি বলে অনেকেই মনে মনে আমার বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ হয়েছেন। আড়ালে আবডালে হয়তো কেউ কেউ এও বলেছেন যে, আমি ভিন্ন রাজনীতির সমর্থক বলেই এমন তীব্র মোদিবিরোধী। ওই যে কথায় আছে না, যারে দেখতে নারি তার চলন বাঁকা।
আসলে ব্যক্তি নরেন্দ্র মোদি, অমিত শাহ বা অন্য হেভিওয়েট বিজেপি নেতারা ভালো বা খারাপ, তা নিয়ে আমার কোনো মাথাব্যথা নেই। আমি তীব্র মোদিবিরোধী তার দলের স্বৈরাচারী চিন্তা-ভাবনা পছন্দ করি না তাই।
বিজেপি বা সাবেক জনসংঘের থিঙ্ক ট্যাঙ্ক হচ্ছে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ, সংক্ষেপে আরএসএস। আরএসএসের জন্ম ১৯২৫ সালে ভারতের মহারাষ্ট্র রাজ্যের নাগপুরে। প্রথম থেকেই আরএসএস চূড়ান্ত সাম্প্রদায়িক, দাঙ্গাবাজ। স্বাধীনতা আন্দোলনে ওদের একমাত্র ভূমিকা ছিল ব্রিটিশ সরকারের তোয়াজ করা। ইংরেজ নয়, আরএসএসের মূল উদ্দেশ্য ছিল নির্দিষ্ট একটি সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে জনমনে বিষ ঢালা। এই আরএসএস, হিন্দু মহাসভা দেশের স্বাধীনতা দিবসকে আজও মানে না। তাদের ঘোষিত উৎসবের তালিকায় ১৫ আগস্টের উল্লেখ পর্যন্ত নেই। ভারতের স্বাধীনতার পর আজ অবধি যত দাঙ্গা হয়েছে, প্রত্যেকটির পেছনে কোনো না কোনোভাবে নাম জড়িয়েছে সংঘ পরিবারের। গুজরাট গণহত্যা তো আমার নিজের চোখে দেখা। কীভাবে আরএসএস, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, বজরং দল প্রশাসনকে সঙ্গে নিয়ে সারা গুজরাটে দাপিয়ে বেড়িয়েছিল, তা ভাবলে আজও এই বাইশ বছর বাদেও আতঙ্কে শিউরে উঠি।
তখন গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন নরেন্দ্র মোদি। গুজরাট ছিল এক ধরনের ল্যাবরেটরি। যেমন সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায়কে সংহত করে পরবর্তী সময়ে দিল্লির ক্ষমতা দখল করেছিলেন নরেন্দ্র মোদির দল। সেটা ২০১৪ সাল। সেবার অবশ্য বিজেপির সঙ্গে বিরোধী ভোটের খুব পার্থক্য ছিল না। পরের বার ২০১৯-এ বিরোধী দলগুলোর পারস্পরিক দ্বন্দ্বকে কাজে লাগিয়ে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে দ্বিতীয় দফা প্রধানমন্ত্রী হন নরেন্দ্র মোদি। এবার নির্বাচন ঘোষণার পর থেকেই বিজেপির স্লোগান ছিল, আপকি বার চারশ পার।
অর্থাৎ চারশ সিটে জিতবে বিজেপি ও তার শরিক দলগুলো। বাস্তবে এখনো হাওয়া যা, তাতে নরেন্দ্র মোদির আকাশছোঁয়া অহঙ্কার যে, তলানিতে তা নিশ্চিত। দু-এক দিনের মধ্যে পুরো ছবি পরিষ্কার হবে; কিন্তু এটা এখনই বলে দেওয়া যায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি যদি হন, তাহলেও তার তর্জন-গর্জন অনেক কমবে। আসলে দোষ আমাদেরই। কাগুজে বাঘকে বাঘ বলে ভুল করেছিলাম।
সৌমিত্র দস্তিদার: ভারতীয় চলচ্চিত্র নির্মাতা ও লেখক।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে