উপজেলা নির্বাচনের এপিঠ-ওপিঠ
উপজেলা পরিষদের গুরুত্ব কম নয়। দেশে তিনস্তরে স্থানীয় সরকার পদ্ধতি রয়েছে। জেলা পরিষদ, উপজেলা পরিষদ এবং ইউনিয়ন পরিষদ। এ ছাড়া শহর অঞ্চল নিয়ে রয়েছে পৌরসভা অথবা বড় শহর হলে সিটি করপোরেশন। ১৯৯৮ সালে উপজেলা পরিষদ আইন প্রণীত হলেও বর্তমানে দেশের অর্থনীতির ভলিউম বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে উপজেলা পরিষদও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার দ্বিতীয় দফা, অর্থাৎ ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর আইন সংশোধনের মধ্য দিয়ে উপজেলাকে আরও শক্তিশালী করে তুলেছে। তাই রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে, বিশেষ করে ক্ষমতাসীন দলের কাছে উপজেলা পরিষদ নির্বাচন আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
৮ মে ষষ্ঠ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে প্রতীক বরাদ্দ না দিলেও আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টিসহ কয়েকটি দল অংশগ্রহণ করেছে। অন্যদিকে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি ও সমমনা দলগুলো জাতীয় নির্বাচনের মতো এ নির্বাচন বয়কট করেছে। দলীয় নির্দেশনা না মেনে বিএনপির যারা এ নির্বাচনে এসেছে তাদের দল থেকেও বহিষ্কার করা হয়েছে। অর্থাৎ বিএনপি এ ব্যাপারে অনমনীয়।
প্রথম ধাপের এ নির্বাচনে ১৩৯টি উপজেলায় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। অবশ্য তপশিল ঘোষণা হয়েছিল ১৫২টির। এর মধ্যে কয়েকটিতে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন কেউ, আবার কয়েকটিতে আইনগত জটিলতায় নির্বাচন স্থগিত হয়েছে। অনুষ্ঠিত নির্বাচনে অধিকাংশ আওয়ামী লীগ নেতারাই জয়ী হয়েছেন। সরাসরি আওয়ামী লীগের সক্রিয় এমন ৪৯ জন নেতা নির্বাচিত হয়েছেন। অন্যদিকে বিএনপির বহিষ্কৃত ৫, জাতীয় পার্টির ৩, জাতীয় জনসংহতি সমিতির ২, ইসলামী আন্দোলন ও আল ইসলামের ১ জন করে নির্বাচিত হয়েছেন।
সরকারে থাকা দল আওয়ামী লীগ এই উপজেলা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলেও দলের হাই কমান্ড থেকে আনুষ্ঠানিক নির্দেশ দেয়া হয়েছিল, যাতে দলের এমপি ও নেতারা প্রভাব না খাটান। এমনকি উপজেলা নির্বাচনে প্রভাব খাটালে ভবিষ্যতে এমপি মনোনয়নের ক্ষেত্রে বাতিল হতে পারেন এমন হুমকিও আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে দেয়া হয়; কিন্তু সে তো কাগজপত্রের কথা। বাস্তবে প্রায় প্রতিটি উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে এমপি ও স্থানীয় প্রভাবশালী নেতারা পেছন থেকে কাউকে না কাউকে সমর্থন দিয়েছেন, নিজের লোকদের করণীয় সম্পর্কে ইঙ্গিত দিয়েছেন; যার তাপ প্রশাসনের গায়ে গিয়েও লেগেছে। এটাই বাস্তবতা। এই নেতারা যে সর্বক্ষেত্রে দলীয় লোককে সমর্থন দিয়েছেন, তা কিন্তু না। বিষয়টি নির্ভর করেছে ব্যক্তিগত সম্পর্ক এবং স্থানীয় রাজনীতির কৌশলের ওপর।
তবে এত কিছুর পরও বাহ্যিকভাবে নির্বাচন মোটামুটি সুস্থ হয়েছে। দু-একটি জায়গায় বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষ হয়েছে প্রার্থীদের সমর্থকদের মধ্যে, এই যা। বিএনপি এ নির্বাচনে আসেনি। তার কারণগুলো অস্পষ্ট নয়। তাদের দলীয় অবস্থান হলো বর্তমান সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করা। উপজেলা নির্বাচনে দলীয় নির্দেশনা অমান্য করে অংশগ্রহণ করায় তারা ১৪২ জন নেতাকর্মীকে বহিষ্কার করেছে। এটি কিন্তু চোখে পড়ার মতো একটি সংখ্যা। এটা প্রমাণ করে, বিএনপির স্থানীয় পর্যায়ে বা তৃণমূল স্তরে দলের হাই কমান্ডের সিদ্ধান্তের প্রতি দ্বিমত রয়েছে। অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক মনে করেন, বিএনপি আনুষ্ঠানিক ঘোষণা না দিয়ে নির্বাচনে থাকতে পারত।
এতে দলের কর্মীদের মধ্যে নেটওয়ার্ক তৈরি হতো, সমমনা দলগুলোর সঙ্গে স্থানীয় পর্যায়ে বাঁধন শক্ত হতো এবং প্রকৃতপক্ষে মাঠের অবস্থা কী তা খানিকটা হলেও পরিষ্কার হতো। সেই সঙ্গে সাংগঠনিক দুর্বলতাগুলো দলের কাছে স্পষ্ট হতো। এ কথা সত্য যে, এই উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে খুব উল্লেখ করার মতো কোনো কারচুপি হয়নি। তবে বিএনপি ব্যাপক হারে অংশগ্রহণ করলে কী হতো, তা বলা মুশকিল। আরও একটি বাস্তবতা হলো, উপজেলা পরিষদে সরকারের আদর্শ ও দৃষ্টিভঙ্গি পরিপন্থি কেউ নির্বাচিত হয়ে আসলে প্রশাসন ও স্থানীয় সরকারের কতটা সহযোগিতা পাবেন, তা নিয়ে সন্দেহ আছে। সে কথাটা সাধারণ ভোটারদেরও অজানা নয়।
বিগত দিনের অভিজ্ঞতা আমাদের ভালো না। এমনকি স্থানীয় নির্বাচনে বিরোধী রাজনৈতিক দলের প্রার্থী নির্বাচিত হয়ে আসার পর মামলা মোকদ্দমা, বরাদ্দে বৈষম্য ও নানা ধরনের হয়রানির শিকার হতে আমরা দেখেছি। সব সরকারের সময়েই। ততৃীয় বিশ্বের এই দেশ তো আর ইংল্যান্ড না! এই তো ইংল্যান্ডেও স্থানীয় সরকার নির্বাচন হয়ে গেল কয়েকদিন আগে। সেখানে বিরোধী দল লেবার পার্টি বিশাল সাফল্য পেয়েছে। তৃতীয়বারের মতো লন্ডনের মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন সাদিক খান। এতে স্থানীয় সরকার পরিচালনায় কোনো প্রভাব পড়বে না এটা নিশ্চিত। এতকালও পড়েনি বা সরকারের দলগত বৈষম্য নিয়ে ইংল্যান্ডে কোনো অভিযোগও শোনা যায়নি।
আমাদের দেশের বৈশিষ্ট্য অনুসারে স্থানীয় নির্বাচনে জাতীয় নির্বাচনের চেয়ে ভোটারের অংশগ্রহণ বেশি হয়ে থাকে। সরকারও চেয়েছিল ভোটার উপস্থিতি বেশি হোক; কিন্তু ভোটার উপস্থিতি আশানুরূপ হয়নি। বিগত নির্বাচনে ৪০ শতাংশের কিছু বেশি ভোটার ভোট দিলেও এবার অংশ নিয়েছেন ৪০ শতাংশের কম। তবে এটাও ঠিক, বেশ কিছু উপজেলায় চরম প্রতিদ্বন্দ্বিতা লক্ষ্য করা গেছে। এমনকি কয়েকশ ভোটের ব্যবধানের জয়-পরাজয় নির্ধারিত হয়েছে। ১৩৯টি নির্বাচনি এলাকার মধ্যে ২২টি উপজেলায় ইভিএমের মাধ্যমে ভোট গ্রহণ করা হয়েছে নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী। ইভিএম নিয়ে বিতর্ক আছে। শুধু বাংলাদেশে নয়, বিভিন্ন দেশে আছে। কেউ বলেন, ইভিএম কারচুপির সম্ভব যা সাধারণ ম্যানুয়েল কারচুপির মতো দেখা যায় না। আবার কেউ বলেন, ইভিএমে কারচুপির সুযোগ নেই। এটি ইভিএম এক্সপার্টরাই বলতে পারবেন।
সামনে আরও তিন ধাপ নির্বাচন রয়েছে। সে নির্বাচনে প্রধান দেখার বিষয়, ভোটার উপস্থিতি কেমন হয়। এর বাইরে যে খুব উত্তেজনা আছে, তা বলা যাবে না। তবে উপজেলা নির্বাচন সেরে ফেলতে পারলে সরকারের জন্য দল সংগঠিত করার সুযোগ তৈরি হতে পারে। কারণ, জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সরকারে থাকা দল আওয়ামী লীগের মধ্যে স্থানীয় পর্যায়ে বড় ফাটল তৈরি হয়ে আছে, যা মেরামত করা দলটির জন্য অত্যন্ত জরুরি।
লেখক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে