উবার বিড়ম্বনা: অভিযোগ অনেক, প্রতিকার সুদূরপরাহত
বাংলাদেশে যাত্রা শুরুর পর থেকেই রাইড শেয়ারিং সার্ভিস উবারের বাইক ও গাড়ি চালকদের বিরুদ্ধে ব্যাপক অভিযোগ পাওয়া গেলেও প্রতিকার পাওয়ার সংখ্যা হাতেগোনা।
ভয়াবহ গণপরিবহন সংকটের মধ্যে ২০১৬ সালের ২২ নভেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে অ্যাপের মাধ্যমে ট্যাক্সি সেবাদানকারী কোম্পানি উবার যাত্রা শুরু করলে স্বস্তি পেয়েছিল ঢাকার অসংখ্য মানুষ; কিন্তু সে আশায় গুড়ে বালি পড়ে খুব অল্প সময়েই। চালকদের স্বেচ্ছাচারিতা আর নানারকম সমস্যার কারণে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই সেবাগ্রহণকারীদের বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায় উবার।
গন্তব্যের কথা শুনে যেতে না চাওয়া, অতিরিক্ত ভাড়া আদায়, যাত্রীদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার, গাড়ি বিকল হয়ে পড়া, চালকের ভুলে যাত্রীদের জরিমানা, মাঝপথে যাত্রীদের গাড়ি থেকে নামতে বাধ্য করাসহ নানা অভিযোগ করে আসছেন উবার ব্যবহারকারীরা। যাত্রীরা বলছেন, সিএনজিচালিত অটোরিকশার মতো ভয়ংকর হয়ে উঠছে উবার।
শয়ন বিশ্বাস নামে এক উবার যাত্রী তার তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা জানান ভিউজ বাংলাদেশকে। তিনি মিরপুর থেকে পল্টনে যাওয়ার জন্য উবার অ্যাপে ৩৬০ টাকা ভাড়ায় রাইড সেবা গ্রহণ করেন। নির্দিষ্ট স্থানে গিয়ে সে ভাড়া দেখায় ১৫৮৪ টাকা। শয়নের মতো উবার নিয়ে এমন বিড়ম্বনায় পড়েছেন অনেক যাত্রী। তবে কেউ কেউ অভিযোগ দিয়ে প্রতিকার পেলেও, প্রতিকার না পাওয়ার সংখ্যাই বেশি। কারণ, গ্রাহকদের পক্ষ থেকে অ্যাপে অভিযোগ দেয়ার নিয়ম থাকলেও তাৎক্ষণিক প্রতিকার চাওয়ার কোনো সুযোগই নেই। আবার অ্যাপে অভিযোগ করলেও তার ভিত্তিতে কোনো চালকের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়ার কোনো নজির নেই।
পর্ণা ডি কস্তা নামে এক সেবা গ্রহীতা বলেন, কিছুদিন আগে তিনি উবারে একটি গাড়ি বুক করেন বাসার ওয়াইফাই ব্যবহার করে। মোবাইলে ইন্টারনেট না থাকার কথা জানান গাড়ি চালককে। ফোন দেয়ার কিছু সময় পর বাসা থেকে নেমে সড়কে গাড়ির জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন তিনি। গাড়ি আসে বিলম্ব করেই, দেরিতেই পৌঁছে দেয় গন্তব্যে। তবে পূর্ব প্রদর্শিত ভাড়ার থেকেও বেশি ভাড়া এসেছে বলে দাবি করেন চালক। চালকের দাবি মতো টাকা মিটিয়ে দিয়ে পরে উবার রাইড হিস্ট্রি চেক করতে গিয়ে তিনি দেখেন, কল ক্যান্সেল করায় ৩০ টাকা জরিমানা হয়েছে তার।
জিয়া উদ্দিন রাজু নামে আরেক ব্যক্তি বলেন, ‘উবার সার্ভিস তো এখন রিকশাওয়ালাদের মতো ভাড়া নেয় এবং নামিয়ে দেয়ার পর বলে, ভাই ২০টা টাকা বকশিশ দিয়ে যান।’
অথচ, ‘রাইড শেয়ারিং সার্ভিস নীতিমালা, ২০১৭’ অনুযায়ী উবার চালকরা নিজেদের ইচ্ছামতো যাত্রী আনানেয়া বা ভাড়া বাড়িয়ে চাইতে পারবেন না।
২০১৮ সালের ১৫ জানুয়ারি ‘রাইড শেয়ারিং সার্ভিস নীতিমালা, ২০১৭’-এর অনুমোদন দেয় বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)। এ নীতিমালাটি গেজেট আকারে প্রকাশিত হয় ওই বছরেই ২৮ ফেব্রুয়ারি এবং কার্যকর হয়ে ৩ মার্চ থেকেই; কিন্তু সাত বছর পার হলেও এ নীতিমালার বেশিরভাগই কার্যকর হয়নি।
যাত্রীদের অভিযোগ, নীতিমালা থাকলেও কার্যত অকার্যকর হয়ে গেছে অ্যাপভিত্তিক রাইড শেয়ারিং সেবা। অনেক চালক অ্যাপে না গিয়ে রাস্তার মোড়ে মোড়ে দাঁড়িয়ে যাত্রী সংগ্রহ করে নিজেদের পছন্দমতো ভাড়ায় পরিবহন শুরু করে বলে অভিযোগ সেবা গ্রহীতাদের।
জিকলুর রহমান বলেন, ‘উবারে রাইড নেয়ার চেয়ে বিসিএস পরীক্ষায় অংশ নেয়া সহজ।’ কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ক্যাশ না বিকাশ? -এ প্রশ্ন উবার ড্রাইভারদের কমন প্রশ্ন। তারপর মেইন রাস্তায় নাকি ভেতরে যাবেন? এ ধরনের নানা প্রশ্নবানে বিদ্ধ হতে হয়। সব বিষয়ের উত্তর দেয়ার পর উবার চালকের পছন্দ না হলে বাতিল করে দিতে বলে, মাঝেমধ্যে বাতিল না করতে বলেই যাত্রীর বিরুদ্ধে অ্যাপে অভিযোগ করে তারা!’
ভাড়া বেশি চাওয়ার ব্যাপারে ভিউজ বাংলাদেশ একাধিক চালকের সঙ্গে কথা বললে তারা দাবি করেন যখন চাহিদার চেয়ে গাড়ি কম থাকে ওই সময়টাকে সার্জ বলা হয়। তখন নিয়মিত ভাড়ার চেয়ে ভাড়া কয়েকগুণ বেড়ে যায়। সাধারণত সকাল ৬টা থেকে সকাল ১০টা ও সন্ধ্যা ৬টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত উবারের চাহিদা বেশি থাকে।
জানা যায়, তিন ধরনের সেবা দেয় উবার। এগুলো হচ্ছে উবার এক্স, উবার প্রিমিয়ার ও উবার মটো। উবার এক্সের নিয়মিত ভাড়া প্রতি কিলোমিটার ১৮ টাকা, ওয়েটিং চার্জ প্রতি মিনিট তিন টাকা। আর সর্বনিম্ন ভাড়া ৪০ টাকা। এ ছাড়া উবার প্রিমিয়ারের সর্বনিম্ন ভাড়া ৮০ টাকা। প্রতি কিলোমিটার ২২ টাকা। এ ক্ষেত্রেও ওয়েটিং চার্জ তিন টাকা প্রতি মিনিট।
শুধুমাত্র যাত্রী উঠা-নামা বা ভাড়া নিয়ে বিড়ম্বনাই না, উবার চালকদের স্বেচ্ছাচারিতা এবং যাত্রীর সঙ্গে দুর্ব্যবহারের ব্যাপারে কারও কোনো দ্বিমত নেই।
তাহেরুল ইসলাম নামে এক যাত্রী অভিযোগ করেন, ‘বকশীবাজারে ঢাকা মেডিকেলের সামনে থেকে উবার কল করলাম। দুজনের কাছে রিকোয়েস্ট যাওয়ার পর কেটে দিল। আরেকজনকে কল করলাম, তাকে ম্যাপে দেখাচ্ছিল লালবাগ। তবে তিনি বললেন, আমি কামরাঙ্গীরচরে আছি। আরেকজনকে ফোন দিলাম, তিনি কাছাকাছি থাকলেও যাবেন না বলে দিলেন। এরপর আরও একজন রাইড গ্রহণ করেও কল ধরেনি। এমনকি রাইড বাতিলও করেনি। তাকে রাইড বাতিল করতে বললে তিনি বাতিল করেননি। আমি জানালাম, আমি রাইড বাতিল করলে ৩০ টাকা কেটে নেবে। ওই চালক বলেন, উবারে চড়লে টাকার হিসাব করা যাবে না।’
আতিকুল ইসলাম বলেন, ‘একজন উবার চালক আমার রাইড বাতিল করে দিয়েছেন। ওই চালক আমাকে উবারের মাধ্যমে না গিয়ে ভাড়া চুক্তিতে যেতে বলেন। রাইড বাতিল করার আগে তিনবার মিস কল দিয়েছেন আমার মোবাইলে। যাতে তিনি প্রমাণ করতে পারেন, কল না ধরায় তিনি রাইড বাতিল করেছেন। তবে রাইড বাতিল করায় ৩০ টাকা জরিমানা গুনতে হচ্ছে আমাকে। দুইভাবে লাভ করার নতুন পদ্ধতি।’
এ ব্যাপারে কথা বললে উবার চালকরা নিজেদের মতো ব্যাখ্যা দাঁড় করান।
একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের গাড়ি চালক মো. মহসীন ভিউজ বাংলাদেশকে জানান, ‘কাজের ফাঁকে উবারে রাইড শেয়ার করি। অনেক উবার চালকই পার্টটাইম এই কাজ করেন, যে কারণে সব রাস্তা ঠিকমতো চিনেন না। আর উবারের অ্যাপসেও অনেক সময় সঠিক জায়গা দেখায় না। যার কারণে যাত্রীর সঙ্গে ভুল বোঝাবুঝি হয়। রাইড বাতিল করলে ৩০ টাকা দিতে হবে। এ জন্য যাত্রী বা চালক কেউ রাইড বাতিল করতে চান না। আর ভাড়া বেড়ে যাওয়ার একটি কারণ হলো, জ্যামে থাকলে সেই সময়ের চার্জ ভাড়ার সঙ্গে যুক্ত হয়।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরেক উবার চালক জানান, মাসিক ২০ হাজার টাকা বেতনে কাজ করেন তিনি। সকাল ৯টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত কাজ করতে হয় তাকে।
তিনি বলেন, ‘যাত্রীর রাইড গ্রহণ করার পর নির্দিষ্ট স্থান থেকে তুলে আনতে গেলেও অনেক সময় লাগে। জ্যামের জন্য রাস্তায় বসে থাকতে হয়। আবার গ্যাসও ফুরায়। এ জন্য খরচ অনেক বেশি পড়ে যায়। উবার যদি ভাড়া আরেকটু বাড়াত তাহলে ভালো হতো।’
কেবল অনিয়মই নয়, উবার চালকদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে নানারকম অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত থাকারও।
সম্প্রতি রাজধানীর হাতিরঝিলে রাইড শেয়ারিং উবার চালকের রহস্যজনক আচরণের মুখে পড়েছিলেন চিত্রনায়িকা নিঝুম রুবিনা। উবারে চড়ে বনশ্রী থেকে ধানমন্ডি যাওয়ার পথে হাতিরঝিলে অবস্থা বেগতিক দেখে গাড়ি থেকে ঝাঁপ দেন এই নায়িকা।
গত বছর মে মাসে মোহাম্মদপুর থানার রিং রোডের সূচনা কমিউনিটি সেন্টারের সামনে রিকশাযোগে ফেরার পথে এক কিশোরীকে পথরোধ করে ভয়ভীতি দেখিয়ে উবার নিবন্ধিত গাড়িতে তুলে নিয়ে অস্ত্রের মুখে ধর্ষণ ও মুক্তিপণ আদায় করে সংঘবদ্ধ অপহরণ ও ধর্ষণকারী চক্রের সদস্যরা।
২০২১ সালের মে মাসে উবার আলোচনায় আসে মিরপুর এলাকায় এক নারী যাত্রীকে উত্ত্যক্ত করার মাধ্যমে।
এছাড়াও উবারের চালকের অসাবধানতার ফলে ২০১৯ সালের এপ্রিল মাসে সড়ক দুর্ঘটনায় ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ফাহমিদা হক লাবণ্য নিহত হন।
উবার চালকদের এসব অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার বিষয়ে বিভিন্ন থানায় একাধিক মামলা হয়েছে।
এ ব্যাপারে ডিএমপির উপ-পুলিশ কমিশনার (মিডিয়া) তালেবুর রহমান বলেন, অপরাধ করে কেউ পার পাবে না। অপরাধ যেই করুক তাকে আইনের আওতায় এনে শাস্তি নিশ্চিত করা হবে। উবার চালকদের বিরুদ্ধে অভিযোগগুলো গুরুত্ব দিয়ে দেখা হচ্ছে।
সব বিষয়ে উবারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করতে চাইলেও তাদের পক্ষ থেকে কোনো আনুষ্ঠানিক বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
এদিকে, উবার পরিচালনার ক্ষেত্রে ‘রাইড শেয়ারিং সার্ভিস নীতিমালা, ২০১৭’ কীভাবে বাস্তবায়ন করা যায়, জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) এক কর্মকর্তা জানান, অ্যাপস ভিত্তিক রাইড শেয়ারিং প্লাটফর্মের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ থাকলে তা সহজেই বিআরটিএ'র ওয়েবসাইটে অভিযোগ করা সম্ভব। তবে বড় কোনো অপরাধ সংগঠিত করলে তার জন্য আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
২০০৯ সালের মার্চে যাত্রা শুরু হয় অ্যাপভিত্তিক রাইড শেয়ারিং সেবা উবারের। বর্তমানে বিশ্বের ৬৬৩টি শহরে এই সেবা দিচ্ছে অ্যাপভিত্তিক এ সংস্থা। সারা বিশ্বে প্রতিদিন গড়ে ৫০ লাখের বেশি মানুষ উবার ব্যবহার করে সেবা নিচ্ছেন এর মাধ্যমে।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে