নিয়ন্ত্রণহীন বাজার, দায় কার?
নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম কিছুতেই নিয়ন্ত্রণে আসছে না। চাল-ডাল, তেল, মাছ-মাংস, চিনি ও ডিমের দাম তো বাড়ছেই, এর সঙ্গে যোগ হয়েছে শাক-সবজির ঊর্ধ্বমূল্য। শাক-সবজির দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। আর এতে হিমশিম খাচ্ছে আমজনতা। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর হুট করে দাম কমে গিয়েছিল শাক-সবজির। সবাই উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠেছিলেন। ভেবেছিলেন, এবার বুঝি সুখ ফিরে এলো; কিন্তু বাজারের এই অবস্থা টেকেনি দুদিনও। বৃষ্টি ও বন্যার অজুহাত দেখিয়ে আগের চেয়েও বেড়ে যায় বিভিন্ন সবজির দাম। এখন কোনো কারণ ছাড়াই লাগামছাড়া দাম কাঁচাবাজারের প্রায় সব পণ্যের। বেশিরভাগ সবজির কেজি ৮০ বা ১০০ টাকার ওপরে। ফলে ব্যাগ নিয়ে বাজারে ঢুকে হিমশিম খেতে দেখা যায় সীমিত আয়ের ক্রেতাদের। বাজার কে নিয়ন্ত্রণ করছে বা আদৌ কারও নিয়ন্ত্রণে আছে কিনা, ক্রেতাদের মধ্যে এই প্রশ্ন উঠছে। আগেই ভালো ছিল এমন কথাও কেউ কেউ বলতে শুরু করেছে।
কেবল সবজিই নয়, প্রতিযোগিতা করে বাড়ছে ডিম, মুরগি, মাছের দামও। আর আগে থেকেই উচ্চমূল্যে অবস্থান করছে গরু ও খাসির মাংস। এখন নাগালের মধ্যে নেই আলু, পেঁয়াজ, আদা, রসুনের মতো পণ্যও। এক সপ্তাহের ব্যবধানে গড়পরতা তরিতরকারির দাম কেজিপ্রতি বেড়েছে ১৫-২০ টাকা করে। কোনো কোনো বাজারে সেই বৃদ্ধি কেজিতে ২৫-৩০ টাকা পর্যন্ত দাঁড়িয়েছে। এক মাসের ব্যবধানে প্রায় সব ধরনের চালের দাম বেড়েছে। ফার্মের মুরগির ডিমের দাম হালিপ্রতি বেড়েছে ১০ থেকে ১৫ টাকা পর্যন্ত। ব্রয়লার মুরগির দাম কেজিতে ২০ থেকে ৩০ টাকা বেড়েছে। খোলা পামঅয়েল ও সুপার তেলের দাম বেড়েছে ১৫ টাকা পর্যন্ত। সাধারণের নাগালের বাইরে রয়েছে আদা, রসুন, মরিচ, পেঁয়াজের দাম। তেল, চিনিসহ এ ছাড়া সরকার থেকে কয়েকটি পণ্যের দাম নির্ধারণ করে দেয়া হলেও তার চেয়ে বেশি দামে পণ্য বিক্রি হচ্ছে। আওয়ামী লীগ সরকার নেই, নেই পুরোনো সিন্ডিকেট। আকাশছোঁয়া দাম ঠেকাতে সরকারের টাস্কফোর্সও রয়েছে; কিন্তু তারপরও তরিতরকারিসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম এভাবে লাফিয়ে লাফিয়ে কেন বাড়ছে, তার উত্তর মেলেনি।
এভাবে পণ্যের দাম বৃদ্ধির নেপথ্যে যৌক্তিক কোনো কারণ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। অনেকের মতে, অসৎ ব্যবসায়ী ও মধ্যস্থতাকারীদের কারসাজির জন্যই মূলত পণ্যমূল্য বাড়ছে। বিশ্ববাজারে বেশকিছু পণ্যের দাম কমেছে; কিন্তু বাংলাদেশে তার প্রভাব নেই। বরং উল্টো জিনিসের দাম বেড়েছে। ব্যবসায়ীদের ভাষ্য মতে, বর্তমানে পরিবহন চাঁদাবাজি কমেছে। এ ছাড়া ২৯টি পণ্যের আমদানি শুল্ক কমানো হলেও তার প্রভাবও বাজারে দেখা যাচ্ছে না। পুলিশ প্রটেকশন না পাওয়ায় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরও ঠিকঠাক কাজ করতে পারছে না। এজন্য আগের মতোই নিয়ন্ত্রণহীন বাজার। ভোক্তাদের জীবন চালানো কঠিন হয়ে যাচ্ছে। সরকার বদলালেও বাজার বা ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য কমেনি। পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে সরকারেরও তেমন কোনো মাথাব্যথা আছে বলে মনে হচ্ছে না।
যেসব পণ্য আমদানি করা হয়, সেগুলোর দাম বেড়ে যাবার পেছনে তবু কার্যকারণ সম্পর্ক খুঁজে পাওয়া যায়; কিন্তু দেশে উৎপাদিত শাকসবজির দাম যখন আকাশছোঁয়া হয়, তখন সত্যিই বিস্মিত হতে হয়। কৃষিপণ্য বাজারজাত করার আগে সংরক্ষণের পরিকাঠামো আমাদের দেশে এখনো প্রায় নেই বললেই চলে। চাষি থেকে খুচরা বিক্রেতা- সকলে দাবি করেন, তরিতরকারির দাম নির্ভর করে জোগান এবং পাইকারি ব্যবসায়ীদের ওপরে। যাদের আর এক পরিচয় ফড়িয়া বা ‘ফড়ে’। মাঠ থেকে চাষিরা কোন সবজি কত পরিমাণ আনতে পারছেন, তার উপরেই পাইকারি বাজারগুলোতে সবজির দাম নির্ধারিত হয়।
খুচরা ব্যবসায়ীরা পাইকারি বাজার থেকে কেনার পরে দর আরও কিছুটা বাড়িয়ে বাজারে তা বিক্রি করছেন। শুধু ফড়েরা নন, অভিযোগ এখানেও রয়েছে। পাইকারি ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, বাজারে জোগান কমলে দাম বাড়ে। এই সুযোগে খুচরা ব্যবসায়ীরাও ঝোপ বুঝে কোপ মারতে দাম অনেকটাই বাড়িয়ে সবজি বিক্রি করেন।
ফলন কম হলে এমনিতেই দাম চড়ে। তা বলে বেগুন ১৮০ ছোঁবে! উৎপাদনকারীরা ৩০-৪০ টাকার বেশি পায় না। শহরে সবজি আসে গাঁ-গঞ্জের হাট থেকে। সেখান থেকে এক শ্রেণির আড়তদার বা ফড়ে সবজি শহরে পাঠায়। সবজির আমদানি বাড়লে ফড়েরা দাম কমিয়ে দেন। চাষিদের কাছ থেকে সবজি নিয়ে আড়তদাররা পাইকারি ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করেন। তারা কেনা দামের ওপরে ৪-৫ শতাংশ লাভ রাখেন। এর বাইরেও রয়েছে আরও এক ধরনের কারবারি। তারা স্থানীয় ফড়ে।
স্থানীয় ফড়েরা আবার ছোট চাষিদের কাছ থেকে সবজি কিনে নেন অনেক কম দামে। অন্যদিকে, এ ধরনের অনেক চাষির ফসল এক সঙ্গে হাটে আনতে ফড়েদের খরচও কম পড়ে। সে জন্য ছোট চাষিরা মার খাচ্ছেন দীর্ঘদিন ধরে। আর পাইকারি ব্যবসায়ীদের যুক্তি, ঝাড়াই-বাছাই করে সবজি গাড়িতে তোলা, মজুরের খরচ, আনা-নেয়ার ফলে কিছু সবজি নষ্ট হওয়া, এসব কারণে লাভ পোষাতে দাম বাড়ে। এর বাইরে রাস্তায় অনেককে টাকা দিতে হয়। সেই চাঁদার খরচও চেপে বসে সবজির দামে।
আড়তদার, ফড়ে, খুচরা ব্যবসায়ী- হাত বদলের সঙ্গে সঙ্গে সবজির দাম বাড়ছে। যে যার ইচ্ছেমতো দাম বাড়াচ্ছেন। বাজারভেদেও জিনিসপত্রের দাম ভিন্ন হচ্ছে। উৎপাদনকারী কৃষকরা খেতের ফসলের ন্যায্য দাম পাচ্ছেন না; কিন্তু গাঁট কাটা যাচ্ছে আমজনতার। এমন প্রস্তাব বহুবার শোনা গেছে যে, এমন একটি ব্যবস্থা চালু হবে যেখানে চাষিরা সরাসরি ক্ষেতের ফসল আনবেন এবং পাইকাররা সেখান থেকে ন্যায্য মূল্যে সবজি কিনবেন। মাঝে কেউ থাকবে না; কিন্তু এমন পরিকল্পনা এখনো বাস্তবায়িত হয়নি।
নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম বেড়ে যাওয়ার দায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকেই নিতে হবে। বাজার নিয়ন্ত্রণে সর্বাত্মক উদ্যোগ নিতে হবে। সাধারণ মানুষ কিন্তু সংস্কার, ফ্যাসিবাদী শাসনের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের বিচারের চেয়ে জিনিসপত্র যৌক্তিক দামে কিনতে পারাটাকে অধিক গুরুত্ব প্রদান করে।
মানুষ খেয়ে-পরে বাঁচলেই কেবল সুশাসনের খোঁজ করে। সীমিত আয়ের মানুষ যদি প্রয়োজনীয় জিনিস কিনতে না পারে, তাহলে তারা বিদ্রোহ করতে পারে। আর সাধারণ মানুষ ক্ষুব্ধ হলে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যে উদ্দেশ্য নিয়ে ক্ষমতায় এসেছে তাও ভেস্তে যেতে পারে। কাজেই জিনিসপত্রের দাম যেন সহনীয় পর্যায়ে থাকে সে জন্য সরকারকে সর্বোচ্চ উদ্যোগ নিতে হবে।
চিররঞ্জন সরকার: কলামিস্ট।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে