রানা প্লাজা: আহত আফরোজার খাবারের টাকাই থাকে না

এক যুগ আগে সাভারের রানা প্লাজায় ধসে আহত শ্রমিকদের খোঁজে ভিউজ বাংলাদেশ। জানতে চাই কেমন আছেন আলোচিত দুর্ঘটনা থেকে বেঁচে ফেরা শ্রমিকরা। রানা প্লাজা থেকে কিছুটা দূরেই সেদিনের ভাগ্যবান দুজনের সন্ধান পায় ভিউজ বাংলাদেশ। পড়ন্ত বিকেল শেষে সূর্য বিদায়বেলায় প্রথমে হাজির রানা প্লাজার সপ্তম তলার নিউ ওয়েভ স্টাইল লিমিটেড কারখানার নারী পোশাক শ্রমিক আফরোজা বেগমের বাসায়।
আধা পাকা ভাড়া বাসার একটি বড় ও একটি ছোট কক্ষে চার ছেলেমেয়ে অসুস্থ স্বামীকে নিয়ে বসবাস সেদিনের আহত আফরোজা বেগমের। দরজা খুলে দেখা মিলবে মেঝেতে পাতলা তোশক ও ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বিভিন্ন আসবাবপত্র। বিছানার পাশেই পরে আছে এক যুগ ধরে চলমান আফরোজা বেগমের চিকিৎসাপত্র। আর দেয়ালে পেরেকে ঝুলানো প্লাস্টিক ও স্কুল ব্যাগে রাখা ছেলেমেয়েদের বই। ঘরের এক কোণায় দড়িতে ঝুলিয়ে রাখা পরিবারের সদস্যদের জামাকাপড়।
ঘরে প্রবেশে দেখা মিলে আফরোজা বেগমের। লজ্জা নিয়ে জানান ঘরে চাল নেই তাই দিন শেষে পরিবারের জন্য তৈরি হচ্ছে আটার রুটি সঙ্গে পেঁয়াজবিহীন আলু ভাজি। সকালে নিজে না খেয়ে সন্তানদের মুখে তুলে দিয়েছেন প্রতিবেশীর দেয়া পান্তাভাত ও বাসি তরকারি। দুদিন ধরেই ঘরে চাল নেই, সামর্থ্য নেই বাজারের দামি সবজি কেনার। তাই ভরসা যেন আটা কেনার ওপর। তবু অন্যের ওপর নির্ভর করে আটা কেনার অর্থ। চোখের পানি মুছতে মুছতেই বলেন ডাক্তার বলেছে ভাত খাওয়ার পর ওষুধ খেতে; কিন্তু চাল কেনার টাকাই নাই তাহলে ওষুধ খাব কীভাবে। এভাবেই চালিয়ে যাচ্ছেন আহত হয়ে এক যুগ ধরে জীবন সংগ্রাম চালানো আফরোজা বেগম।
জানা যায়, রানা প্লাজা ধসের সময় মাথায় আঘাত পেয়েছেন, ভেঙেছে মেরুদণ্ডের হাড়। আহত হয়ে এক যুগ ধরে নিচ্ছেন চিকিৎসা। ব্যথা কমাতে একাধারে ওষুধ সেবনে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় বেড়েছে তার অসুস্থতা। টিউমার, হার্টের সমস্যাসহ সেই সঙ্গে শরীরে বাসা বেঁধেছে নানাবিধ জটিলতা। মানসিক সমস্যাতো রয়েছেই। ডাক্তারের পরামর্শ আহত আফরোজাকে নিতে হবে বিভিন্ন চিকিৎসা। কদিন আগেই একমাত্র উপার্জনক্ষম স্বামীর হার্টে ব্লক ধরা পড়ায় সেও শয্যায়। নবম শ্রেণিতে পড়ুয়া মেজো মেয়ের ফুসফুসে ধরা পড়েছে জটিল রোগ। চার মাস পেড়িয়ে গেলেও ড্রেস তৈরি করে দিতে না পাড়ায় বন্ধ অষ্টম শ্রেণিতে পড়া ছেলের। ছোট ছেলেরও একই অবস্থা। বেঁচে ফিরে আফরোজা বেগম যেন ক্লান্ত।
২০১৩ সালের জানুয়ারিতে গাইবান্ধা থেকে সাভারের এক আত্মীয়ের বাসায় উঠেন আফরোজা বেগম। সঙ্গে ছিল তিন ছেলেমেয়ে। দুই মাসের গর্ভবতী হয়েও সংসারের হাল ধরতে আত্মীয়ের মাধ্যমেই সুইং হেলপার হিসেবে চাকরি নেন রানা প্লাজার সপ্তম তলার নিউ ওয়েভ স্টাইল লিমিটেড নামের কারখানায়। ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল নিত্যদিনের মতোই কারখানায় যোগ দিয়েছিলেন তিনি। ভবন ধসে পাল্টে যায় জীবনের সব হিসেব। মাথায় ও মেরুদণ্ডে আঘাত। সেই সঙ্গে দীর্ঘ নয় ঘণ্টা চাপা থাকা অবস্থায় শ্বাসনালিতে ধুলা প্রবেশ করায় হারিয়েছে স্বাভাবিক শ্বাসপ্রশ্বাস ক্রিয়া। বর্তমানে সাভার পৌর এলাকার মজিদপুরের মোতালেব মিয়ার বাসায় বসবাস আফরোজা বেগমের। দীর্ঘদিন ধরে রানা প্লাজায় আহতদের চিকিৎসার জন্য গড়ে ওঠা ‘দুর্ঘটনায় আহত শ্রমিকদের চিকিৎসা সহায়তা ট্রাস্ট’ নামের একটি সংস্থার তত্ত্বাবধানে চিকিৎসাধীন তিনি।
দরিদ্রতা মানে না কোনো অসুস্থতা। তার প্রমাণ মেলে আফরোজা বেগমের জীবনযাত্রায়। শরীরে নানা রোগ নিয়ে কাজের সন্ধানে হেঁটে ঘুরে বেড়াচ্ছেন তিনি। আত্মসম্মানে হাত পেতে নেয়ার সাহস নেই তাই অনেকটাই না খেয়েই দিন পার করছে তার পরিবার। চাকরি নিলেও একবেলার বেশি করতে পারেননি। অভিযোগ আর আক্ষেপ নিয়েই ভিউজ বাংলাদেশের সঙ্গে কথা বলেন আফরোজা বেগম। একে একে শোনাতে থাকেন গত ১২ বছর ধরে হারিয়ে যাওয়ার তালিকা।
আফরোজা বেগম বলেন, ‘দেখেন আপনারা যখন আসছেন তখন কিন্তু আমি রুটি বানাচ্ছিলাম। সারাদিন কিছু খাই নাই। একজন ১০০ টাকা দিয়েছে সে টাকা দিয়ে আটা কিনে আনল। এখন রুটি বানাচ্ছি। কেউ দিলে খাই। না দিলে এখন না খেয়ে থাকতে হয়। জীবনটা এমন হবে ভাবতে পারে নাই। গ্রাম থেকে ঢাকায় আসছি ভালো কিছুর আশায়। সেই অসুস্থ হইলাম। এখন প্রায় প্রতিদিনই ডাক্তারের কাছে যাইতে হয়। এমন একটা দিন নাই যে ডাক্তারের কাছে না যাই। আমার স্বামীটা অসুস্থ হইল এখন সে কাজ করতে পারে না। বাড়িতে যে জায়গা জমি ছিল তাও বেচে দিলাম। সে টাকা দিয়ে চিকিৎসা করলাম। এখন বিভিন্ন আত্মীয়স্বজনের কাছে টাকা ধার করে সংসার চালাইছি। চিকিৎসা করাইছি। এখন কাউরে ফোন দিলে ধরতে চায় না। তারা জানে যে এখন ফোন দিলেন আমি টাকা চাবো। এখন ভাই আমাদের মরা ছাড়া কোনো উপায় নাই, মাঝে মাঝে মনে চায় সবাই মিলে বিষ খেয়ে মরে যাই। এই যে ডাক্তার ওষুধের কথা লেখে, খাবারের কথা লেখে। বলে ভালো-মন্দ খাইতে হবে। ওষুধ খাওয়ার আগে পেট ভরে কিছু খাইতে হবে। এই যে ওষুধ খাওয়ার আগে যে পেট ভরে খাব সে খাবারের টাকাই তো নাই। খাবার খাই তারপর না ওষুধ খাব।’
এত বছরে মেলেনি কোনো ক্ষতিপূরণ। দেয়া হচ্ছে নামমাত্র চিকিৎসা। যেখানে নিশ্চয়তা নেই একবেলা খাবারের সেখানে চিকিৎসার টাকা জোগাড় যেন স্বপ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে আফরোজা বেগমের। জানান চিকিৎসা নিয়ে তার অসহায়ত্বের কথা, গত সরকার ১২ বছর কাটালো কোনো ক্ষতিপূরণ দিল না। কেউ এসে কোনো খোঁজখবর নিল না। ওই সরকার চলে গেল আবার নতুন সরকার আসল। তারা এসে বলল যে এক মাসের ভিতরে আমাদের ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করবে; কিন্তু ছয় মাস চলে যায় এখনো কোনো ক্ষতিপূরণ আমরা পাই নাই। যে টাকা দিয়েছিল সে টাকা তো সেই তখনই শেষ হয়ে গেছে। স্কুলের ড্রেস কিনে দিতে পারি নাই তাই ছেলে স্কুলে যেতে পারে না। আবার ছোট ছেলেটারে মাদ্রাসায় দিয়েছিলাম সেখানে বেতন দিতে পারি নাই সে লজ্জায় চলে এসেছে। আগের বড় মাইয়াডা ইন্টার পর্যন্ত পড়ছে, বিয়া দিয়েছি সেখানে অসুস্থ দেখে জামাই রেখে চলে গেছে। মেজো মেয়ের বেতন দিতে পারি নাই তাই পড়া বন্ধ। দেখেন আমি কোথাও চাকরির জন্য গেলে কোথাও কাজ করতে পারি না। শরীর দুর্বল। তাহলে আমাদের দায়িত্ব কে নিবে।
অসুস্থ আফরোজা বেগমের সন্তানরা আজ যেন নিরুপায়। তার মতো ছোট শিশু সন্তানও ঘুরছে একটি চাকরি কিংবা কাজের সন্ধানে। বয়স কম ও অপরিচিত থাকায় মিলছে না কোনো কাজ। তবে তারা আবার ফিরে যেতে চায় স্কুলের ক্লাস রুমে। দেশ গড়তে রাখতে চায় ভূমিকা।
আফরোজা বেগমের কথা অনুযায়ী অনুদান হিসেবে পেয়েছেন মাত্র ৯৮ হাজার টাকা। তবে চিকিৎসার জন্য তার খরচ হয়েছে ৭ লাখ টাকার উপরে। বাকিটা জোগাড় করেছে স্বামীর জমি বিক্রি ও আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে সাহায্য নিয়ে। আফরোজা বেগমসহ সব আহত শ্রমিককে সরকারের ফান্ডে রাখা ১ কোটি ৮ লাখ টাকা বিতরণ ও ক্ষতিপূরণ দাবি করছেন বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠনের নেতারা।
বাংলাদেশ গার্মেন্ট ও সোয়েটার্স শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের আইনবিষয়ক সম্পাদক খাইরুল মামুন মিন্টু, রানা প্লাজা ধস শুধুমাত্র একটি ভবন ভেঙে যায়নি। ভেঙেছে হাজার মানুষের স্বপ্ন। আফরোজা বেগমের মতো হাজারো শ্রমিককে কঠিন করে গেছে জীবনযুদ্ধ।
তিনি আরও বলেন, ‘আর কবেই বা মিলবে এই পথ থেকে মুক্তি। শুধুমাত্র সরকারি উদাসীনতায় ক্ষতিপূরণ পাইনি। বারবার বলেছি যে এরকম আহত অবস্থায় কোনো শ্রমিকদের কাজ করার ক্ষমতা নেই। তাদের পরিবারটা অনেকটাই ধ্বংস হয়ে গেছে। আর যারা মারা গেছে তাদের পরিবারগুলোও মারা গেছে। যখন পরিবারের একজন উপার্জনক্ষম মানুষ কাজ করতে না পারে তখন তার পরিবার চলে না। এই যে ছোট ছোট বাচ্চাদের রেখে বাবা বা কারো মা মারা গেছে তাদের পরিবারটা এখন কীভাবে চলতেছে। ক্ষতিপূরণ না দেয়া পর্যন্ত তাদের প্রস্তুতিতে কখনো উন্নতি হবে না।’
সাভার উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা কেএম শহীদুজ্জামান বলেন, ‘আমাদের অনেক কিছুই সম্ভব নয়। আবার অনেকে কিছুই যৌথ বা রেফারেন্স করতে পারি। তারা যেন ভালো থাকতে পারে সেভাবে অনেকে এগিয়ে আসবে আশা করি।’
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে