হাথুরুর সঙ্গে ‘অস্বাভাবিক’ বিচ্ছেদ
কোচ না চাইলে তাকে ধরে রাখা যায় না। ২০১৭ সালে দক্ষিণ আফ্রিকা সফরের মাঝপথে বাংলাদেশ কোচের দায়িত্ব ছেড়ে যাওয়া চন্ডিকা হাথুরুসিংহেকে ধরে রাখা যায়নি। কোচ চাইলে পদটা আঁকড়েও থাকতে পারেন না, পারলেন না সেই চন্ডিকা হাথুরুসিংহে। এবার দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে হোম সিরিজের আগে ছাঁটাই করা হলো টাইগারদের প্রধান কোচকে। সিরিজের মাঝপথে দায়িত্ব ছেড়ে যাওয়া যেমন অদ্ভুত; তেমনি অদ্ভুতুড়ে বিষয় হচ্ছে, অসদাচরণের দায়ে কোচ ছাঁটাই করার সিদ্ধান্তও। বাংলাদেশের সঙ্গে অস্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় দুই দফা সম্পর্ক ছিন্ন করার সঙ্গে জড়িয়ে আছে দক্ষিণ আফ্রিকার নাম। ২০১৭ সালের পর ২০২৪ সালের এ ঘটনা কাকতালীয়ভাবে অক্টোবর মাসে!
৫ আগস্ট-পরবর্তী সময়ে ক্রিকেট বোর্ডে (বিসিবি) পরিবর্তন আসে। নাজমুল হাসানের উত্তরসূরি হিসেবে ফারুক আহমেদ বিসিবি সভাপতির চেয়ারে বসার আগেই ধারণা করা হচ্ছিল হাথুরুসিংহের ওপর ঝড় আসন্ন। বোর্ড সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণের পর প্রথম সংবাদ সম্মেলনে ঝড়ের আভাসও মিলেছে, ‘চন্ডিকা হাথুরুসিংহের সঙ্গে চুক্তিটা কি- সেটা ঠিক জানি না। আমি আগের অবস্থানেই আছি (হাথুরুসিংহেকে না রাখার অবস্থান বোঝানোর অর্থে বলা হয়েছে)। আমি যা বলেছি, সেটা থেকে সরে যাইনি।’ ২১ আগস্ট দেয়া আভাসের পর ঝড়টা গতকাল আছড়ে পড়ল দেশের ক্রিকেটে।
কোচকে অপসারণের অন্যতম কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে ‘অসদাচরণ’। এমন অদ্ভুত কারণে কোচের চাকরি যেতে পারে- বোধকরি বাংলাদেশেই সম্ভব! সে আলোচনায় পরে আসা যাবে। আপাতত ‘অসদাচরণ’ সম্পর্কে জানি। গত বছর ভারতে অনুষ্ঠিত ওয়ানডে বিশ্বকাপের পর দেশের গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হয়, ক্রিকেটার নাসুম আহমেদকে শারীরিকভাবে হেনস্তা করেছেন হাথুরুসিংহে। এ নিয়ে শ্রীলংকান সাবেক ক্রিকেটারকে নানা প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়েছে। যথারীতি অভিযোগ অস্বীকার করেছেন এ কোচ। এক পর্যায়ে মেজাজ হারিয়ে গণমাধ্যমের মান নিয়েও প্রশ্ন তোলেন। ২০২৩ সালে ৫ ডিসেম্বর মিরপুরে সংবাদ সম্মেলনে হাথুরুসিংহে ওই পর্যন্ত থামলে মেনে নেয়া যেত। প্রশ্নকর্তার মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন সদ্য সাবেক হওয়া এ কোচ, যা মোটেও স্বাভাবিক ছিল না।
অস্বাভাবিক বিষয় ছিল এ নিয়ে বিসিবির লুকোচুরি করার মাঝেও। ফারুক আহমেদের পূর্বসূরি নাজমুল হাসান বরাবরই নাসুম আহমেদের সঙ্গে হাথুরুসিংহের ওই ঘটনা অস্বীকার করে এসেছেন। এটা বোঝার জন্য পণ্ডিত হওয়ার প্রয়োজন নেই যে, এমন লুকোচুরি যে কোনো দলের শৃঙ্খলার ইস্যুতে বাজে দৃষ্টান্ত হতে পারে। লুকোচুরির ঘটনা ওখানেই থেমে থাকেনি। ঘটনা-পরবর্তী সময়ে সৃষ্ট পরিস্থিতিতে চাপে পড়ে বাধ্য হয়ে এনায়েত হোসেন সিরাজ, মাহবুব আনাম এবং আকরাম খানের সমন্বয়ে তদন্ত কমিটিও গঠন করা হয়েছিল। সে কমিটি দল সংশ্লিষ্ট অনেকের সঙ্গে কথা বলেছে; কিন্তু বাংলাদেশের অধিকাংশ ঘটনায় যা হয়, ব্যতিক্রম হয়নি হাথুরুসিংহের ঘটনায়ও- তদন্ত প্রতিবেদন আর প্রকাশিত হয়নি।
ফারুক আহমেদ দায়িত্ব গ্রহণের পর সে ঘটনা সামনে আসে; আসলে সামনে আনা হয়। তাতেই বেরিয়ে আসে ‘অসদাচরণ’ তত্ত্ব! তার সঙ্গে যোগ হয়েছিল কাগজ-কলমে উল্লিখিত দিনের চেয়ে অতিরিক্ত ছুটি কাটানোর বিষয়গুলো। এসব সামনে এনে নিজের ‘অপছন্দ’র গাছটা উপড়ে ফেলেছেন বোর্ড সভাপতি- এমনটিই বলা হচ্ছে। দায়িত্ব গ্রহণের পর নিজের প্রথম সংবাদ সম্মেলনে তো এ ধারণাকে নিজেই প্রতিষ্ঠিত করে দিয়েছেন সাবেক ক্রিকেটার ফারুক আহমেদ।
কোচ হিসেবে অধীনস্থ খেলোয়াড়কে শারীরিকভাবে হেনস্তা করা, সে বিষয় নিয়ে প্রশ্নের পর গণমাধ্যম কর্মীদের ওপর চড়াও হওয়া, ঘটনা নিয়ে বোর্ড সভাপতির লুকোচুরি, তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন ডিপ ফ্রিজে তুলে রাখা, শেষ পর্যন্ত ওই ঘটনাকে অজুহাত হিসেবে সামনে এনে কোচ অপসারণ- ওয়ানডে বিশ্বকাপে চেন্নাইয়ে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচে ওই ঘটনার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সবই ছিল অস্বাভাবিক, অদ্ভুত!
দায়িত্ব গ্রহণের পর ঠিক ৮ সপ্তাহের মাথায় একটাই গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিলেন ফারুক আহমেদ, সেটা হাথুরুসিংহেকে ছাঁটাই করার সিদ্ধান্ত। যেসব অভিযোগের ভিত্তিতে এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে, সে অভিযোগ সম্পর্কে কোচকে আদৌ আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেয়া হয়েছিল তো! মঙ্গলবার সংবাদ সম্মেলনে ফারুক আহমেদের বক্তব্যেও সেটা পরিষ্কার করতে পারল না, ‘জাতীয় ক্রিকেটারের সঙ্গে অসদাচরণ ও বোর্ডের চাকুরে হিসেবে অসদাচরণের জন্য হাথুরুসিংহেকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয়া ও বরখাস্তের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।’
বরখাস্ত করার আগে কোচকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দেয়া হলে সিদ্ধান্তটা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে থাকবে তাতে সন্দেহ নেই। বাংলাদেশের কোচের পদ হারানোর পর আইনি লড়াইয়েও হাথুরুসিংহে শক্ত অবস্থানে থাকবেন সন্দেহ নেই। এ কোচকে যারা চেনে, তার অতীত সম্পর্কে যারা জানেন; তারা নিশ্চিত বিসিবিকে আরেকটি আইনি লড়াইয়ের মুখোমুখি দাঁড় করাতে যাচ্ছেন হাথুরুসিংহে।
দলের ওপর হাথুরুসিংহের কর্তৃত্ব। এ কোচ আসার পর ড্রেসিংরুমে যে অবস্থা তৈরি হয়, তাতে বিসিবির নেয়া সিদ্ধান্তের বিপক্ষে যেমন জনমত আছে। নিশ্চিতভাবে পক্ষেও জনমত আছে; কিন্তু সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশ ক্রিকেটের সমস্যা এবং তা থেকে পরিত্রাণের ইস্যুতে সিদ্ধান্তটা আদৌ যৌক্তিক কি না- এ নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে। ৫ আগস্ট-পরবর্তী সময়ে দেশের বিভিন্ন সেক্টরে পরিবর্তনের প্রত্যাশা তৈরি হয়েছে। প্রত্যাশা আছে ক্রীড়াঙ্গন নিয়েও। সে প্রত্যাশার বিপরীতে হাথুরুসিংহের সিদ্ধান্তটা ‘পায়ের ব্যথা উপশমে মাথায় মলম লাগানো’ গল্পের মতো হয়ে গেল!
বিগত দিনের বোর্ডের নানা দুর্নীতির মুখরোচক গল্প সামনে আসছে। বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ (বিপিএল) নিয়ে লুকোচুরি, শত কোটি টাকার নাকি হিসাব নেই! বিগত দিনে খোদ বোর্ড পরিচালকদের লোয়ার ডিভিশনের বিভিন্ন ক্লাবের সঙ্গে সম্পৃক্ততা। বিভিন্ন ম্যাচের ফলাফল অনুকূলে আনতে আম্পায়ারদের মাধ্যমে কারসাজি করা। এ সময়ের মধ্যে পাতানো ম্যাচের অভিযোগও ছিল নিয়মিত। কারসাজির অভিযোগ ছিল ঘরোয়া শীর্ষ লিগের নানা ম্যাচেও। দিনের পর দিন এভাবে চলার কারণে দেশের ক্রিকেটের কাঠামো দুর্বল হয়ে যাওয়ার মতো অনেক ঘটনা সামনে আনা যেত। প্রকাশ করা যেত শ্বেতপত্র। এসব ঘটনায় জড়িতদের শাস্তির মাধ্যমে দৃষ্টান্ত স্থাপন করা যেত, যাতে দেশের ক্রিকেট কাঠামো নিয়ে কেউ ছিনিমিনি খেলতে না পারে।
হাথুরুসিংহের ছাঁটাইয়ের সিদ্ধান্তের পক্ষে যেমন লোক আছে, আছে বিপক্ষেও। তেমনই বাংলাদেশের প্রধান কোচ হিসেবে ৫৬ বছর বয়সি এ ক্রিকেট এক্সপার্টের ভূমিকার পক্ষে-বিপক্ষেও লোক আছে। দেশের ক্রিকেটের নানা সাফল্যর পেছনে তার শ্রম-ঘামকে যেমন উপেক্ষা করার সুযোগ নেই, আবার পছন্দ-অপছন্দকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে দলে বিভেদ সৃষ্টির বিষয়ও অস্বীকার করা যাবে না; কিন্তু যে প্রক্রিয়ায় হাথুরুসিংহের বাংলাদেশ অধ্যায় শেষ হলো, তা প্রত্যাশিত নয়।
কোচের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার পুরোনো একটা রোগ আছে বাংলাদেশে। সেটা কেবল ক্রিকেটে দেখা যায়- এমন নয়। ফুটবল, হকি, সাঁতারের মতো অন্যান্য ডিসিপ্লিনেও নিয়মিত দেখা যায়। ক্রীড়ামোদীদের ভুলে যাওয়ার কথা নয়, জাতীয় ফুটবল দলের বিদেশি কোচদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার প্রক্রিয়া ধারাবাহিকভাবেই শিরোনামে উঠে আসে। উঠে এসেছিল জাতীয় হকি দলের কোচ হিসেবে জার্মানির গেরহার্ড পিটারের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার ঘটনা। সেই পিটারই আবার বাংলাদেশ হকি ফেডারেশনের টেকনিক্যাল ডিরেক্টর হিসেবে ফিরে এসেছেন। বর্তমানে হকি ফেডারেশনের সঙ্গে বর্ষীয়ান এ কোচের সম্পর্কটা কিন্তু ভালো যাচ্ছে না। জাতীয় সাঁতার দলের দক্ষিণ কোরিয়ান কোচ পার্ক তে গুন বিদায় নিয়েছিলেন এমন অস্বাভাবিক প্রক্রিয়ায়।
গেরহার্ড পিটার এবং পার্ক তে গুনের ক্ষেত্রে আর্থিক জরিমানা গুনতে হয়নি বাংলাদেশকে; কিন্তু জাতীয় ফুটবল দলের সাবেক প্রধান কোচ জেমি ডের মতো অতীতে অনেক কোচ আইনি লড়াইয়ের পর জরিমানা আদায় করে ছেড়েছেন। বাংলাদেশ থেকে অপসারিত হাথুরুসিংহে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় জানিয়েছেন, ‘আইনজীবীর সঙ্গে পরামর্শ করে বিসিবিকে জবাব দেব।’ যার অর্থ আরও একটি আইনি লড়াই আসন্ন। সে লড়াইয়ে বিসিবি জিতে গেলে সমস্যা নেই; কিন্তু হেরে গেলে আরও একটি জরিমানার পর্ব আসন্ন। আদতে পরিস্থিতি কি দাঁড়ায়- সময়ই বলতে পারে। পরিকল্পিতভাবে সিদ্ধান্ত নেয়া হলে হয়তো জটিলতার পথ এড়ানো যেত!
মাহবুব সরকার: ক্রীড়া লেখক ও বিশ্লেষক।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে