Views Bangladesh

Views Bangladesh Logo

উপজেলা নির্বাচন ও মন্ত্রী-এমপিদের কর্তৃত্ব

Chiroranjan  Sarker

চিররঞ্জন সরকার

সোমবার, ১৫ এপ্রিল ২০২৪

বার ঈদে সরগরম হয়ে পড়েছে তৃণমূলের রাজনীতি। ঈদের পরই শুরু হচ্ছে উপজেলা পরিষদ নির্বাচন। এবার দেশের ৪৮১টি উপজেলায় ভোট হবে চারটি ধাপে। এর মধ্যে দুই ধাপের নির্বাচনের তপশিল ঘোষণা করা হয়েছে। প্রথম ধাপে ১৫২টি উপজেলায় ভোট গ্রহণ ৮ মে এবং দ্বিতীয় ধাপে ১৬১টি উপজেলায় ভোট হবে ২১ মে। বাকি দুই ধাপের তপশিল এখনো ঘোষণা করা হয়নি।

তৃণমূলের জনগোষ্ঠীর আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে উপজেলা নির্বাচন অপরিহার্য এবং গুরুত্বপূর্ণ। ফলে ঈদকে কেন্দ্র করে এবার দলীয় নেতাকর্মীর পাশাপাশি সাধারণ ভোটারের কাছে যাচ্ছেন সম্ভাব্য প্রার্থীরা। অনেকে ঈদের শুভেচ্ছা জানিয়ে টানিয়েছেন পোস্টার-ব্যানার। ফেসবুকে ভোটারদের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করছেন কেউ কেউ। সামর্থ্য অনুযায়ী সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়াচ্ছেন। ঈদ উপলক্ষে মন্ত্রী-এমপিরাও এলাকায় এসেছেন। তারাও গুরুত্ব দিচ্ছেন উপজেলা নির্বাচনকে। দলের হাইকমান্ডের নিষেধ থাকলেও পছন্দের প্রার্থীকে নানাভাবে সামনে রাখার চেষ্টা করছেন তারা। সব মিলিয়ে এবারের ঈদকে ভিন্ন মাত্রা দিয়েছে উপজেলা পরিষদ নির্বাচন।

বিএনপির অংশগ্রহণহীন ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ করার জন্য আওয়ামী লীগ যে উন্মুক্ত প্রতিযোগিতার দুয়ার খুলে দিয়েছিল, সেটি এবার উপজেলা নির্বাচনেও চালু রাখা হয়েছে। ফলে তৃণমূলে জনপ্রিয়তার পরীক্ষায় অবতীর্ণ হচ্ছেন অনেক নেতা। দল এ ক্ষেত্রে নীরব দর্শক। যে জয়ী হবেন, দল তাকেই গ্রহণ করবে।

আমাদের দেশে জাতীয় নির্বাচনের চেয়ে স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলোতে অনেক বেশি জনসম্পৃক্ততা ও আগ্রহ লক্ষ্য করা যায়। ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা কিংবা পৌরসভা নির্বাচনে একটা সাজ-সাজ রব পড়ে যায়। উৎসব-উত্তেজনা, প্রতিদ্বন্দ্বিতার আবহ সৃষ্টি হয়। এর কারণও আছে। জাতীয় নির্বাচনের প্রার্থীরা ভোট শেষে ঢাকায় চলে যান। তাদের কাজ হয় সংসদভবনে বসে আইন প্রণয়নে অংশগ্রহণ করা। নির্বাচনি এলাকা অনেক বড় হওয়ায় তাদের সঙ্গে সাধারণ মানুষের যোগাযোগ ও সম্পর্ক খুব একটা থাকে না। পক্ষান্তরে স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধিরা এলাকাতেই থাকেন। স্থানীয় মানুষজন সমস্যা-সংকটে তাদেরই স্মরণাপন্ন হন। স্থানীয় সরকার প্রতিনিধিদের সঙ্গে এলাকার মানুষের যোগাযোগ প্রত্যক্ষ ও ঘনিষ্ঠ। তাই এই নির্বাচন নিয়ে সবার মধ্যেই একটা চাঞ্চল্য ও আগ্রহ সৃষ্টি হয়।

এবার ষষ্ঠবারের মতো অনুষ্ঠিত হচ্ছে উপজেলা নির্বাচন। এ নির্বাচনের বিধিমালায় বেশ কিছু সংশোধনী আনা হয়েছে। এত দিন ধরে নির্বাচনে প্রার্থী হতে মনোনয়নপত্র জমা দিতে হতো রিটার্নিং কর্মকর্তা বা সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয়ে গিয়ে। প্রার্থীরা তাদের কর্মী-সমর্থকদের সঙ্গে নিয়ে মনোনয়নপত্র জমা দিতেন। এবার আর সে সুযোগ নেই। প্রথমবারের মতো অনলাইনে মনোনয়নপত্র জমা দেয়ার বিধান বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। ফলে প্রার্থী হতে ইচ্ছুক ব্যক্তিদের মনোনয়নপত্র জমা দিতে হবে অনলাইনে নির্ধারিত পদ্ধতিতে।

এবার উপজেলা নির্বাচনে প্রথমবারের মতো মনোনয়নপত্রে লিঙ্গ হিসেবে ‘তৃতীয় লিঙ্গ’ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। অর্থাৎ তৃতীয় লিঙ্গ চাইলে হিজড়া পরিচয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবেন। অন্য নির্বাচনে এই বিধান আগেই করা হয়েছিল। উপজেলায় তা সংযুক্ত করা হয়েছে।

উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে এত দিন ২৫০ জন ভোটারের সমর্থনসূচক সই মনোনয়নপত্রের সঙ্গে জমা দিতে হতো। এবার সে বিধান বাদ দেয়া হয়েছে। ফলে স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে ভোটারদের সমর্থনসূচক সইয়ের তালিকা আর দিতে হবে না।

এত দিন চেয়ারম্যান পদে প্রার্থীদের জামানত হিসেবে ১০ হাজার টাকা জমা দিতে হতো। এবার দিতে হবে ১ লাখ টাকা। ভাইস চেয়ারম্যান পদে দিতে হবে ৭৫ হাজার টাকা। প্রার্থীরা মনোনয়নপত্রের সঙ্গে জামানতের যে টাকা জমা দেন, ভোট শেষে তা ফেরত পান। তবে এই টাকা ফেরত পেতে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ ভোট পেতে হয়। নাহলে জামানতের টাকা বাজেয়াপ্ত করা হয়। এবার জামানত রক্ষায় আগের চেয়ে বেশি ভোট পেতে হবে। এত দিন প্রদত্ত ভোটের এক-অষ্টমাংশ বা প্রায় সাড়ে ১২ শতাংশ ভোট পেলে জামানত রক্ষা হতো। এবার প্রার্থীদের পেতে হবে প্রদত্ত ভোটের ১৫ শতাংশ।

উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে কোনো পদে একাধিক প্রার্থী সমান ভোট পেলে আবার ভোট করার বিধান ছিল। এখানে এবার সংশোধনী আনা হয়েছে। একাধিক প্রার্থী সমান ভোট পেলে ফলাফল নির্ধারণ করা হবে লটারিতে। নতুন নিয়মকে সবাই স্বাগত জানালেও জামানতের টাকার অঙ্কটা নিয়ে অনেকেই আপত্তি জানিয়েছেন। স্থানীয় নির্বাচনে অনেক সৎ, জনপ্রিয় মানুষ অংশগ্রহণ করে থাকেন। তাদের পক্ষে এক লাখ টাকা জামানত দিয়ে নির্বাচন করাটা কঠিন। এক্ষেত্রে যাদের অর্থবিত্ত কম, তাদের নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগ খর্ব করা হয়েছে। গণতান্ত্রিক রাজনীতির জন্য যা মোটেও কাম্য নয়।

৮ মে থেকে চার ধাপে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া স্থানীয় সরকার নির্বাচনে প্রার্থীদের দলীয় নির্বাচনি প্রতীক ব্যবহার করতে না দেয়ার এবং নির্বাচনে প্রার্থী মনোনয়ন না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে আওয়ামী লীগ। তবে ইতিমধ্যে এক ডজনের বেশি মন্ত্রী-এমপি নিজ নিজ উপজেলায় ‘দলীয় প্রার্থী’র নাম ঘোষণা করেছেন। অনেক উপজেলায় আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গ বা সহযোগী সংগঠনগুলোর সাত-আটজন পর্যন্ত ভোটের প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামছেন। কোনো কোনো উপজেলায় মন্ত্রী, প্রভাবশালী নেতা ও সংসদ সদস্যরা তাদের সন্তান, ভাই, শ্যালকসহ নিকটাত্মীয়দেরও প্রার্থী করছেন। স্থানীয় আওয়ামী লীগের ওপর নিজেদের নিয়ন্ত্রণ বাড়ানোর ব্যাপারে সব মন্ত্রী-এমপিই কমবেশি চেষ্টা করছেন। এ নিয়ে কোথাও বিক্ষোভও হয়েছে।

উপজেলা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে তৃণমূলের বিভেদ ঠেকাতে কেন্দ্রীয় নেতারা দফায় দফায় বৈঠক করছেন। নির্দেশনা দিচ্ছেন। এসব বৈঠকে তৃণমূলের নেতারা মন্ত্রী, সংসদ সদস্য ও প্রভাবশালী নেতাদের বিরুদ্ধে স্বজনতোষণের অভিযোগ এনেছেন। স্থানীয় নেতাদের কেউ কেউ উপজেলায় একক প্রার্থী দেয়ার দাবি জানিয়েছেন। দলীয় প্রতীকে নির্বাচন না হওয়ায় সেটি সম্ভব হবে না। তবে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব চেষ্টা করছে, দলের ‘প্রার্থীর’ সংখ্যা যতটা কম রাখা যায়।

বিএনপি এখনো পর্যন্ত নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করার সিদ্ধান্তে অটুট রয়েছে। যদিও এই সিদ্ধান্ত বিএনপির জন্য কতটুকু ইতিবাচক তা নিয়ে চিন্তা-ভাবনার অবকাশ রয়েছে। তারা ৭ জানুয়ারির জাতীয় নির্বাচন বর্জনের আহ্বান জানিয়েও সেটি ঠেকিয়ে রাখতে পারেননি। সরকার যেভাবেই হোক নির্বাচনটি করে ফেলেছে। আন্তর্জাতিকভাবে যারা অংশগ্রহণমূলক ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচনের জন্য সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করেছিল, তারাও কিন্তু বিএনপির বর্জননীতি সমর্থন করেনি।

দলের স্বার্থেই বিএনপির নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা উচিত। কেননা নির্বাচন ঠেকানোর মতো শক্তি বিএনপির নেই। এ অবস্থায় তৃণমূল নেতাদের যদি নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগ দেয়া হয়, তবে তারা রাজনৈতিকভাবে ঘুরে দাঁড়ানোর সুযোগ পেতে পারে। সারা দেশে বিএনপির অনেক জনপ্রিয় স্থানীয় নেতা আছে। আওয়ামী লীগের বহু প্রার্থীর ভোট-বিভক্তির সুযোগে সহজেই বিএনপির প্রার্থীরা বিজয়ী হয়ে নতুন ইতিহাস লিখতে পারে। ২০০৯ সালে অনুষ্ঠিত উপজেলা নির্বাচনে ক্ষমতাসীনদের জবরদস্তি সত্ত্বেও বিএনপি ভালো ফল করেছিল।

উপজেলা নির্বাচনে অংশগ্রহণের ব্যাপারে দলগত সিদ্ধান্ত নেতিবাচক হলেও কিন্তু দলের স্থানীয় নেতাদের নির্বাচন থেকে বিরত রাখা যাচ্ছে না। ক্ষমতাসীন দলের নেতা-মন্ত্রী-এমপিদের মধ্যে ত্রিমুখী অবস্থানের কারণে প্রতিটি উপজেলা পরিষদে আওয়ামী লীগের প্রার্থীর ছড়াছড়ি। স্থানীয় নেতা-কর্মী, সমর্থকরা ইতিমধ্যেই নানা গ্রুপে বিভক্ত হয়ে নিজ নিজ পছন্দের প্রার্থীর পক্ষে নির্বাচনি মাঠ গরম করছেন। এই সুযোগটি কাজে লাগাতে চাইছে বিএনপি-জামায়াতের স্থানীয় নেতারা। স্বতন্ত্র প্রার্থিতার ব্যানারে অনেক বিএনপি-জামায়াতের নেতা বিজয়ী হওয়ার জোর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। বিএনপি তাদের ঠোকাবে কীভাবে?

বিএনপি অংশগ্রহণ করুক আর না করুক, উপজেলা নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হবে বলেই আশা করা হচ্ছে। নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু, ও অংশগ্রহণমূলক করাটাই এ মুহূর্তে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। উপজেলা নির্বাচনে এমপিদের প্রভাব রয়েছে। স্থানীয় নেতাদেরও প্রভাব রয়েছে। সবাই চাইবে নিজেদের পক্ষে প্রশাসনকে ব্যবহার করতে। সব ধরনের প্রভাবের বাইরে বেরিয়ে নিজেদের দায়িত্ব নিরপেক্ষভাবে পালন করাটাই প্রশাসনের কর্তব্য হওয়া উচিত।

আর স্থানীয় নির্বাচনে এমপিদের প্রভাব ও কর্তৃত্ব বন্ধের ব্যাপারে ক্ষমতাসীনদের আরও কঠোর ও যত্নবান হওয়া উচিত। সংবিধানে এমপিদের দায়িত্ব সুনির্দিষ্ট করা আছে। স্থানীয় নির্বাচনে প্রভাব সৃষ্টি করা, কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা একজন এমপির কাজ হতে পারে না। তারা আইন প্রণয়নের ব্যাপারে মনোযোগী হলেই সমাজের মঙ্গল হবে।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ