Views Bangladesh Logo

লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে

প্রায় ১৪ বছর আগে, একজন তরুণ কর্মী হিসেবে আমি বাংলাদেশের এক এনজিওতে কাজ শুরু করি। সে সময় আমার এক সহকর্মী নারী ও কিশোরীদের ওপর সহিংসতা নিয়ে একটা কেস স্টোরি তৈরি করছিল। একদিন তা আমার নজরে পড়ল। যা আমার কাছে সবচেয়ে ভয়ংকর মনে হয়েছিল তা হলো এক অসহায় মেয়েকে তার ধর্ষকের সঙ্গে বিয়ে দেয়া হয়েছিল। এতেই আমি বুঝতে পারি লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা বাংলাদেশে কতটা উদ্বেগজনক, সহিংসতার পর শেষরক্ষার চাবিকাঠিও এখানে এক দুষ্টচক্রের হাতে বন্দি। এই ঘটনা নিয়ে তার পরিবার কী ভাবছিল? মেয়েটির পরিবারকে তথাকথিত লজ্জা ও অসম্মানের হাত থেকে বাঁচাতে কি তারা এতটাই উদ্বিগ্ন ছিল যে মেয়েটিকে শেষ পর্যন্ত তার ধর্ষকের সঙ্গেই বিয়ে দিতে হলো? না কি সেই জঘন্য অপরাধীর পরিবারকে লজ্জার হাত থেকে বাঁচাতে মেয়েটির পরিবারকে বাধ্য করা হয়েছিল এই বিয়েতে? এই না বলা গল্প আমি কখনোই গভীরভাবে তলিয়ে দেখার সুযোগ পাইনি।

মাগুরায় যে ৪ বছরের শিশুটি সম্প্রতি ধর্ষিত হলো, সেখানেও আমরা একই চিত্র দেখলাম। মেয়েটির বড় বোনের শ্বশুরবাড়ির লোকজনের দুশ্চরিত্র সম্পর্কে জানা সত্ত্বেও তারা মেয়েটিকে সেই বাড়িতে পাঠাতে বাধ্য হয়েছিল। বাংলাদেশে নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধ না হওয়ার কারণ প্রথমত, এখানে ন্যায়বিচার নেই; দ্বিতীয়ত, সামাজিক কলঙ্কের ভয়। গণপরিবহনেও এখানে গণধর্ষণ ও শ্লীলতাহানির মতো ঘটনা ঘটেছে এবং এসব অপরাধ সংঘটিত হওয়ার সময় উপস্থিত লোকজনদের মধ্যে এক ধরনের নিষ্ক্রিয়তা দেখা গেছে।

অন্যদিকে, মোরাল পুলিশিং এবং মব-জাস্টিসের মাধ্যমেও লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা বাড়ছে। যেমন, গত অমর একুশে বইমেলায় আমরা স্যানিটারি ন্যাপকিনের স্টল বন্ধ করে দিতে দেখলাম। এতে বোঝা যায় মেয়েলি স্বাস্থ্য বিষয়েও বাংলাদেশে নারীদের অধিকার সীমিত।

যৌন নিপীড়নের শিকার হলে বাংলাদেশে দোষ পড়ে নারীর ওপর, এই অশুভ সামাজিক-সাংস্কৃতিক লৈঙ্গিক নিয়মের কারণে যৌন সহিংসতা থেকে বেঁচে যাওয়া বেশিরভাগ নারীকে সমাজের প্রতিটা স্তরেই ন্যায়বিচার পাওয়ার জন্য সংগ্রাম করতে হয়। তাদের সংগ্রাম করতে হয় পরিবার থেকে সম্প্রদায়, সমাজ, কর্মক্ষেত্র এমন কি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও। তারা ক্ষমতার ভারসাম্যহীনতার শিকার হয়। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার পাশাপাশি প্রথাগত বিচারও তাদের পক্ষে যায় না, ফলে প্রকৃত অপরাধীরা এতে পার পেয়ে যায়। ন্যায়বিচার পেতে হলে তাদের একটা দীর্ঘ ও জটিল প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। ‘বিচার বিলম্বিত মানেই বিচার বাদ’ এমন একটা অবস্থার মধ্যে তারা পতিত হয়। সম্প্রতি এ ক্ষেত্রে একটা বিরাট পরিবর্তন এসেছে। আর তা হলো সংশোধিত আইনে ১৫ দিনের মধ্যে ধর্ষণের তদন্ত শেষ করতে হবে এবং ৯০ দিনের মধ্যে বিচারকার্য সম্পন্ন করতে হবে। এই আইন জরুরিভাবে কার্যকর করা দরকার।

এটি আবারও বাংলাদেশের বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন, ২০১৭-এর কথা মনে করিয়ে দেয়। তখন এই আইনটি জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে সমালোচিত হয়েছিল। এই আইনে একটি বিশেষ বিধান ছিল যে, কিছু ব্যতিক্রমী ক্ষেত্রে বিধিবদ্ধ বয়সে পৌঁছানোর আগে একটি ছেলে বা মেয়ে পরিবারের সম্মতিক্রমে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হতে পারবে। আইনটির সমালোচনা করে অনেকে এর আগে উল্লেখ করেছিলেন, এটি বাল্যবিবাহ রোধ করতে পারবে না এবং ধর্ষণ-পরবর্তী বিয়ের ঝুঁকি বাড়াবে, ধর্ষককে মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়ার পথ সহজ করে দিবে। এই ধরনের পশ্চাৎপদ আইনগুলোকে আরও পুনর্বিবেচনা করার সময় এসেছে।

শিশুরা- সে যে লিঙ্গেরই হোক, প্রতিরোধ ক্ষমতা না থাকার কারণে এবং যৌন-সহিংসতার শিকার হলেও তা প্রকাশ করতে না পারার অক্ষমতার কারণে তারা আরও বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। অনেক ক্ষেত্রেই অপরাধীরা অপরিচিত কেউ নয়, বরং শিশুদের কাছে খুবই পরিচিত, হয়তো পরিবারের সদস্য বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কেউ। এটা খুবই চিন্তার বিষয় যে, প্রায় ৫৫ ভাগ শিশু যৌন-নিপীড়নের শিকার হয় তাদের পরিবারের মধ্যে। মেয়েদের চেয়ে বেশি আক্রান্ত হয় ছেলেরা। (সূত্র: মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন এবং ইনসিডিন বাংলাদেশ, ২০১১)

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শিশুদের ‘ভালো স্পর্শ ও খারাপ স্পর্শ’ সম্পর্কে ধারণা দিতে হবে, কার সঙ্গে কীরকম সম্পর্ক রাখতে হবে, কাছের সম্পর্ক, দূরের সম্পর্কগুলো সম্পর্কে সচেতন করতে হবে। পাশাপাশি তারা এও বলেন, শিক্ষার্থীদের যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য এবং অধিকার সম্পর্কে শিক্ষিত করতে হবে। প্রযুক্তিনির্ভর শিক্ষাব্যবস্থা এখন সারা বিশ্বেই জনপ্রিয় হয়ে উঠছে, অনলাইন ক্লাসগুলো এখন শিশুদের কাছে নতুন অভ্যাস হয়ে উঠছে, শিশুরা যেন কোনো সাইবার যৌন-নিপীড়ন, পর্নোগ্রাফির শিকার না হয় তা সম্পর্কে অভিভাবকদেরও সচেতন হতে হবে।

যারা পুনরাবৃত্তিমূলক যৌন অপরাধী, তাদের হাত থেকে মুক্তির জন্য ইন্দোনেশিয়া, মলদোভা, পোল্যান্ড, দক্ষিণ কোরিয়া এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কিছু রাজ্যে ও দেশে আইনের অধীনে রাসায়নিক খোজাকরণ প্রক্রিয়া চালু করেছে। বাংলাদেশ ম্যাগান-এর আইন এবং শিশুদের বিরুদ্ধে জ্যাকব ওয়েটারলিং অপরাধ থেকেও শিখতে পারে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে, সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রীয় আইন এবং আন্তর্জাতিক আইনসহ যা তাদের সরকারি সংস্থাগুলোকে পেডোফাইল এবং/অথবা যৌন অপরাধীদের সম্পর্কে সর্বজনীনভাবে উপলব্ধ তথ্য প্রকাশ করতে বাধ্য করে। যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, ভারত এবং আরও কয়েকটি দেশেও একই ধরনের ব্যবস্থা রয়েছে।

Shocheton.org এই সাইটে এই বিষয়ে বাংলাদেশে প্রথম যৌন অপরাধীদের রেজিস্ট্রি যথাযথভাবে চালু করা হয়েছে। মিথ্যা অভিযোগের মতো সম্ভাব্য অপব্যবহার এড়াতে সরকারি বিভাগগুলো বা আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর সঙ্গে সহযোগিতার মাধ্যমে এই ধরনের সত্য উদ্যোগগুলোকে আরও জোরদার করতে হবে।

যৌন সহিংসতার থেকে বেঁচে থাকা ব্যক্তিদের পরিচয় রক্ষার জন্য বেশিরভাগ দেশ কঠোর আইনি বিধান প্রণয়ন করেছে। মিডিয়ায় তাদের নাম-ঠিকানাসহ খবর প্রচার থেকে বিরত থাকতে বলা হয়। ভিকটিমের খবর সচিত্র প্রচার হলে তা শুধুমাত্র সামাজিকভাবে ভুক্তভোগীদের কলঙ্কিত করতে পারে। তাদের নিরাপত্তাকে আরও ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিতে পারে। অনেক সময় তাদের জীবন হুমকির মধ্যে পড়তে পারে। বাংলাদেশের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০-এর ১৪ ধারা প্রিন্ট ও ডিজিটাল মিডিয়ায় ধর্ষণ ও যৌন নিপীড়নের শিকার ব্যক্তিদের নাম ও ছবি প্রকাশ ও সম্প্রচার নিষিদ্ধ করেছে। এ বিষয়ে দায়িত্বশীল সাংবাদিকতা এবং নৈতিক সংবেদনশীলতার প্রয়োজন বাড়ছে।

কিছু সমালোচক এমনও প্রশ্ন তুলেছেন যে, যৌন-নিপীড়িত ব্যক্তিদের নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য বাংলাদেশে ‘নিরাপদ কাস্টডি’ আছে কি না, যেখানে সহিংসতার শিকার শিশু, কিশোর-কিশোরীদের প্রয়োজনে নিরাপদ আশ্রয় দেওয়া যেতে পারে। অতীতে পুলিশ অনেক সময় নিয়ম লঙ্ঘনের অভিযোগ করেছে, যে আদালত ছাড়া অন্য কেউ কাউকে নিরাপদ হেফাজতে নিতে পারে না।

মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় বাংলাদেশজুড়ে ‘ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টার’ (ওসিসি) প্রতিষ্ঠা করেছে। শুধুমাত্র লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতার বিরুদ্ধে জরুরি প্রতিক্রিয়া হিসেবে নয়, ফরেনসিক সংরক্ষণে সহায়তার জন্যও। নারীদের বিরুদ্ধে সহিংসতা বন্ধে এবং যে কোনো অপরাধের বিরুদ্ধের আইনি সহায়তা নিতে হলে সমাজসেবা অধিদপ্তর কিছু হেল্পলাইন চালু করেছে। অপরাধ দমনে এসব হেল্পলাইনগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নিচে কিছু হেল্পলাইনের নম্বর দেওয়া হলো:
নারী-নিপীড়নের বিরুদ্ধে আইনি সহায়তা পেতে হলে- ১০৯, শিশু নির্যাতনের বিরুদ্ধে আইনি সহায়তা পেতে হলে-১০৯৮ এবং যে কোনো প্রকার আইনি সহায়তা নিতে হলে জরুরি হেল্পলাইন নম্বর-৯৯৯।

সম্প্রতি নারীর প্রতি সহিংসতা বেড়ে যাওয়ার কারণে পুলিশ সদর দপ্তর থেকে আরও কিছু হটলাইন চালু করা হয়েছে। নম্বরগুলো হলো- 3333, 01320002001, 01320002002 এবং 01320002222। তাছাড়া নারীদের জন্য পুলিশ সাইবার সহায়তা এবং আইনি সুরক্ষার ফেসবুক পেজ রয়েছে যাতে সহিংসতার শিকার ব্যক্তিদের প্রতিক্রিয়া জানা যায় এবং প্রয়োজনীয় আইনি পরিষেবাগুলো দেয়া হয়।

দুর্ভাগ্যবশত দক্ষিণ এশিয়ায় একজন নারীর প্রতি লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্য গর্ভে থাকতেই শুরু হয়। যার ফলে সমাজ মনে করে যে তারা প্রকৃতি নারী শক্তি ছাড়া বাঁচতে পারে এবং তাদের ওপর অবহেলা চালিয়ে যেতে পারে। শিশুটি যদি তৃতীয় লিঙ্গের কেউ হয় তাহলে তার ভাগ্য খারাপ। অনেক সময় পরিবারেও তার জায়গা হয় না। আমরা যারা এখনো নারীর অধিকারের জন্য লড়াই করছি, দৃঢ় ইচ্ছাশক্তি সম্পন্ন নারী ও মেয়েদের জন্য বেড়ে উঠছি, আমরা বারবার বলছি- “আমাদের ছাড়া একটি বিশ্ব কল্পনা করুন! পৃথিবী আমাদের ছাড়া বাঁচতে এবং শ্বাস নিতে পারে না!”


বাংলাদেশের স্বাধীনতা ৫৪ বছর অতিক্রম করছে, সমতা অর্জনের জন্য আমাদের এখনো অটল পাহাড় পাড়ি দিতে হবে। যশোরের মুক্তিযোদ্ধা হালিমা পারভীনের একটি স্মরণীয় উক্তি দিয়ে শেষ করছি, ‘একজন মুক্তিযোদ্ধা বা নির্যাতিত নারী কেউই সহজে হার মানে না।’


মেহজাবিন আহমেদ: একজন উন্নয়নকর্মী ও লেখক।  

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ