Views Bangladesh

Views Bangladesh Logo

ক্রমাগত যুদ্ধের কারণে মার্কিন কূটনীতি জটিল হচ্ছে

Rayhan Ahmed Tapader

রায়হান আহমেদ তপাদার

মঙ্গলবার, ৩ ডিসেম্বর ২০২৪

সরায়েলে হামাসের হামলা এবং এর জের ধরে গাজা যুদ্ধ শুরুর এক বছর পূর্ণ হলো। বছর শেষে সেই যুদ্ধ মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে ব্যাপক পরিবর্তন এনেছে আর যুদ্ধ আরও বিস্তৃত হয়েছে। ইসরায়েলে হামাসের আক্রমণ ছিল ইসরায়েলিদের জন্য ভয়াবহ একটি দিন। প্রায় বারোশ মানুষ, যাদের বেশিরভাগই বেসামরিক নাগরিক, নিহত হয়েছিল। ঘটনার পর দেশটির প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে ফোন করে বলেছিলেন যে, ‘আমরা আমাদের রাষ্ট্রের ইতিহাসে কখনো এ ধরনের বর্বরতা দেখিনি’। ইসরায়েলিরা হামাসের ওই হামলাকে তাদের অস্তিত্বের জন্য হুমকি হিসেবে বিবেচনা করেছিল। এরপর ইসরায়েল গাজায় ভয়াবহ হামলা চালায়, যাতে প্রায় ৪২ হাজার মানুষ নিহত হয়েছে এবং হামাস পরিচালিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মতে তাদেরও বেশিরভাগ বেসামরিক নাগরিক। গাজার বড় অংশ ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে এবং ফিলিস্তিন গণহত্যার অভিযোগ এনেছে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে।

যুদ্ধ এরপর আরও ছড়িয়েছে। হামাসের হামলার ১২ মাস পর এসে মধ্যপ্রাচ্য এখন ভয়াবহ ও আরও ধ্বংসাত্মক একটি যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়েছে। তার সঙ্গে ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধে গোটা বিশ্বের জ্বালানি, খাদ্য ও অর্থনীতিতে যে আঘাত এসেছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। গত বছরের ৭ অক্টোবর হামাস ইসরায়েলের ওপর একটি স্থল, বিমান ও নৌ হামলা চালায়। এতে ১ হাজার ২০০ ইসরায়েলি মারা যায় এবং ২৫০ জন সামরিক ও বেসামরিক কর্মী হামাসের হাতে জিম্মি হয়। ফলে ইসরায়েল আন্তর্জাতিক আইন ও জাতিসংঘ রেজুলেশনের অধীনে দখলদার নিপীড়ক শক্তি গণ্য হওয়া সত্ত্বেও হামাসের সন্ত্রাসী হামলার শিকার হিসেবে নিজেদের তুলে ধরে গাজায় পুরোদমে আক্রমণ শুরু করে। তখন থেকে হামলাটি লেবাননে প্রসারিত হয়েছে, যা এখন ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে একটি পূর্ণ যুদ্ধে রূপ নিয়েছে।

যুদ্ধের ভয়াবহতার ফলে গাজায় আনুমানিক ৪৩ হাজার ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে, যার অধিকাংশই নারী ও শিশু। হাজার হাজার লোক বাস্তুচ্যুত। এর বাইরে ইসরায়েল হামাস নির্মূলের অজুহাতে গাজা উপত্যকার গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো যেমন: হাসপাতাল, স্কুল, বিশ্ববিদ্যালয় ও শরণার্থী শিবিরগুলোর গুরুতর ক্ষতি করেছে। তবে মাঠ পর্যায়ের পর্যবেক্ষকদের মতে, বেশির ভাগ ইসরায়েলি হামলা গাজাবাসীদের নির্মূলের লক্ষ্যে চালানো। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এটি হামাসকে পরাজিত করার চেয়ে ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে গণহত্যামূলক অভিযান হিসেবে দেখা হয়েছে। ইসরায়েলি সামরিক অভিযান গাজা উপত্যকাতেই থেমে থাকেনি, বরং যুদ্ধকে আঞ্চলিক পর্যায়ে নিয়ে যেতে পশ্চিম তীর, গোলান হাইটস, সিরিয়া, ইয়েমেন ও লেবাননে তার অভিযান ও আক্রমণের বিস্তার ঘটিয়েছে।

দুর্ভাগ্যবশত, যুদ্ধবিরতি ও আলোচনার আহ্বান সত্ত্বেও ইসরায়েল কোনো এতে অংশ নিতে অস্বীকার করে। এর সঙ্গে ইসরায়েল ইরানি শাসক সমর্থিত প্রতিরোধ জোটের উচ্চ পর্যায়ের নেতাদের হত্যা করতে শুরু করে। ইসমাইল হানিয়া থেকে শুরু করে হিজবুল্লাহপ্রধান হাসান নাসরাল্লাহর হত্যার মধ্য দিয়ে ইসরায়েল স্পষ্টভাবে এ বার্তাই দিয়েছে- আমরা গাজায় থামব না। যার চূড়ান্ত লক্ষ্য হলো প্রতিরোধের অক্ষ ও ইরান সরকারকে আঞ্চলিক যুদ্ধে টেনে আনা। বিশেষ করে আসন্ন মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রেক্ষাপটে এ অঞ্চলে ইসরায়েলের কর্মকাণ্ড নিয়ে আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞরা বিভক্ত হয়ে পড়েছিলেন। কিছু বিশেষজ্ঞ বিশ্বাস করেন, গাজায় সংঘাত বৃদ্ধি করলে নিজ দেশে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর পক্ষে সমর্থন জোরালো হবে, যা একইভাবে গাজা উপত্যকার মানবিক সংকট থেকে আন্তর্জাতিক মনোযোগ সরিয়ে ফেলতে পারে। অন্যরা বিশ্বাস করেছিলেন, একটি আঞ্চলিক যুদ্ধ ক্রমাগত ইসরায়েলের অস্তিত্বের জন্য হুমকি সৃষ্টিকারী প্রতিরোধ অক্ষকে দুর্বল করতে পারে।

ইরানকে সংঘাতের দিকে ঠেলে দিলে এ অঞ্চলে ইসরায়েলি প্রচারাভিযানে পশ্চিমা রাজনৈতিক, আর্থিক ও সামরিক সমর্থন পুনরুজ্জীবিত করতে পারে। ইসরায়েল নাসরাল্লাহকে হত্যা করলে ইরানের কৌশলগত ধৈর্য হ্রাস পায়। ১ অক্টোবর ইরান ইসরায়েলে প্রায় ২০০টি ব্যালাস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে, যার মধ্যে কিছু ইসরায়েলের আয়রন ডোম আগে থেকে বুঝে উঠতে পারেনি। ইরান স্পষ্টভাবে বলেছে, অনভিপ্রেত ইসরায়েলি আগ্রাসন ও যুদ্ধবাদী দেশপ্রেমের পরিপ্রেক্ষিতে তার আত্মরক্ষা করার অধিকার রয়েছে। তবে ইরানের ব্যালাস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের পাল্টা জবাব হিসেবে ইসরায়েল ইরানের অভ্যন্তরে পারমাণবিক কিংবা তেল স্থাপনায় হামলার কথা ভাবছে। সেই প্রতিক্রিয়ায় ইরানও স্পষ্ট করেছে-এ ধরনের উসকানিমূলক ইসরায়েলি কর্মকাণ্ড মোকাবিলা এ অঞ্চলের যে কোনো তেল স্থাপনায় হামলার মাধ্যমেই করা হবে।

অতএব, চলমান সংকট হবে এ অঞ্চল ও তার বাইরে যুদ্ধ লাগানোর একটি রেসিপি, যা বিশ্ব অর্থনীতির জন্য ভয়াবহ পরিণতি বয়ে আনবে। পারস্য উপসাগর ও আরব উপদ্বীপের তেল স্থাপনায় হামলা হলে বৈশ্বিক পরিণতি ভয়াবহ হতে পারে। অঞ্চলটি বিশ্বের তেল ও গ্যাস সম্পদের এক-তৃতীয়াংশ সরবরাহ করে, যা আন্তর্জাতিক জ্বালানি শক্তির বাজারের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এতে গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক রাস্তাগুলো মিলিত হয়েছে, যেখানে রয়েছে লোহিত সাগর, পারস্য উপসাগর, হরমুজ প্রণালি ও বাব-এল-মান্দেবের মতো কৌশলগত ব্যস্ত পয়েন্ট। এ পথে যে কোনো ব্যাঘাত, বিশেষ করে ইরান ও এর প্রক্সিদের এই গুরুত্বপূর্ণ জলপথের ওপর প্রভাবের কারণে তেলের দাম বেড়ে যেতে পারে। এ ধরনের পরিস্থিতি হয়তো একের পর এ বিষয়কে প্রভাবিত করতে পারে, যা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য, বৈশ্বিক উৎপাদন ও বিশ্বব্যাপী সরবরাহ চক্রকে বিরূপভাবে প্রভাবিত করবে।

দুর্ভাগ্যবশত ঘটনার পুরো সময় ধরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিরলস সমর্থন ইসরায়েলি অতি দেশপ্রেমকে উৎসাহিত করেছে। ফলে মধ্যপ্রাচ্যে যে কোনো সময় আঞ্চলিক যুদ্ধ বেধে যেতে পারে, যা অস্থিতিশীলতা, বিশৃঙ্খলা, সহিংসতা ও একের পর এক যুদ্ধ বাধিয়ে দেওয়া ছাড়া কিছুই নিয়ে আসে না। ৭ অক্টোবর হামলার পর থেকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন প্রশাসনের অধীনে যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলকে আত্মরক্ষার নামে গাজায় নিরবচ্ছিন্ন যুদ্ধাপরাধ সংঘটনে সমর্থন দিয়েছে। দেশটি রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামরিক ও কূটনৈতিক অনুমোদনের মধ্য দিয়ে নেতানিয়াহুর নীতির পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। সম্প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চলমান যুদ্ধের সমর্থনে ইসরায়েলের জন্য ২০ বিলিয়ন ডলারের সামরিক প্যাকেজ অনুমোদন করেছে, যে যুদ্ধ ইতোমধ্যে গাজা উপত্যকার বাইরেও বিস্তৃত। ইতোমধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান যেমন-কংগ্রেস, পেন্টাগন, স্টেট ডিপার্টমেন্ট ও আমেরিকান মূলধারার সংবাদমাধ্যম মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েলি অভিযানের প্রতি প্রকাশ্যে সমর্থন দিয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের জনসাধারণ মধ্যপ্রাচ্যে আরেকটি যুদ্ধ নিয়ে তেমন সম্মতি না দেয়া সত্ত্বেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এতে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করবে। সুতরাং কেউ সহজেই উপসংহারে আসতে পারে-মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ইহুদি লবির কারণে মার্কিন পররাষ্ট্রনীতি এ অঞ্চলে ইসরায়েলের কৌশলগত লক্ষ্যগুলোর সঙ্গে গভীরভাবে জড়িয়ে গেছে। সেই সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন ঘাঁটি ও তাদের প্রায় ৪০ হাজার সেনা উপস্থিতির কারণে ইসরায়েলের এই বিশ্বাসটুকু জন্মেছে-মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পূর্ণ সমর্থন ছাড়া ইসরায়েল ইরানকে হারাতে পারবে না। বিশ্বের বড় শক্তিধর রাষ্ট্রগুলো ঐতিহাসিক পাঠ উপেক্ষা করেছে বলে মনে হচ্ছে। এ অঞ্চলে স্থায়ী শান্তি ফিলিস্তিনিদের আত্মনিয়ন্ত্রণ এবং একটি কার্যকর ও সার্বভৌম ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ওপর নির্ভর করে।

তাই যুদ্ধবিরতি নিশ্চিত করতে এবং ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে ইসরায়েলের যুদ্ধাপরাধ বন্ধে অবিলম্বে পদক্ষেপ নিতে হবে। এদিকে পশ্চিমা শক্তিগুলোর উচিত ইরানকে সম্পৃক্ত করা এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ে একটি দায়িত্বশীল রাষ্ট্র হিসেবে পুনরায় যুক্ত করা। অন্যথায় ভূরাজনৈতিক উত্তেজনা, আঞ্চলিক সংঘর্ষ ও প্রক্সি যুদ্ধ বিশ্বশান্তি, নিরাপত্তা ও অর্থনীতিকে হুমকির মুখে ফেলবে। এ ছাড়াও লেবাননের সঙ্গে ইসরায়েলের সীমান্তে হিজবুল্লার মতো ইরানের মিত্রদের কার্যকলাপ এবং ইয়েমেনে তাদের দুর্গ থেকে লোহিত সাগরে জাহাজ চলাচলকে লক্ষ করে হুতিদের আক্রমণের মতো অন্যান্য অজ্ঞাত সমীকরণকে বাইরে রাখলেও এই পরিস্থিতি যথেষ্ট জটিল। গাজার যুদ্ধ দুর্ঘটনাজনিত ধর্মঘট, যোগাযোগের ব্যর্থতা বা অ-রাষ্ট্রীয় শক্তিদের যে কোনো একজনের দ্বারা কোনো ভুল অভিযানের মাধ্যমে এখনো আঞ্চলিক দাঙ্গায় পরিণত হওয়ার আশঙ্কা রাখে।

পরিশেষে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কথাও মাথায় রাখতে হবে, যারা বিদ্যমান বন্দি আলোচনায় মিশর ও কাতারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করছে এবং গাজায় কিছু ত্রাণ সরবরাহের প্রবাহ নিশ্চিত করে আবারও তার কেন্দ্রীয়তা প্রদর্শন করেছে; কিন্তু নির্বাচনের মৌসুম যখন পুরোদমে এগিয়ে আসছে, তখন প্রেসিডেন্ট বাইডেন যেভাবে নেতানিয়াহুর নীতির প্রতি তার বিতৃষ্ণা কাটিয়ে উঠে ইসরায়েলের প্রতি সুদৃঢ় সমর্থন প্রকাশ করেছেন এবং তার ডেমোক্র্যাটিক দলের সমর্থকরা যে ভাবে বিষয়টিকে আরও ভারসাম্যপূর্ণভাবে দেখতে আগ্রহী, তার মধ্যে স্পষ্ট ব্যবধান রয়েছে। যেহেতু রিপাবলিকানরা মূলত নেতানিয়াহু ও ইসরায়েল উভয়কেই সমর্থন করছে, তাই ওয়াশিংটন ডিসিতে ক্রমবিবর্তিত রাজনৈতিক সমীকরণ আর একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাঁধা হয়ে উঠবে। এতে পৃথিবীর শান্তি-শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা যেমন বিঘ্নিত হচ্ছে তেমনি অর্থনীতির ওপর চাপ বাড়ছে।

রায়হান আহমেদ তপাদার: গবেষক ও কলাম লেখক।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ