সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে পানি ও খাদ্য ব্যবসায়ীদের এক সপ্তাহে ক্ষতি ১৫ লাখ টাকা
ঢাকার প্রাণকেন্দ্র টিএসসি সংলগ্ন ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। বছরের পর বছর ধরে এই উদ্যান হয়ে উঠেছিল শত শত মানুষের জীবিকার কেন্দ্রবিন্দু। ফুচকা, পানি, আইসক্রিম, চটপটি, খিচুড়ি ও বিভিন্ন ফুডকার্ট ব্যবসা ঘিরে এখানে গড়ে উঠেছিল এক ধরনের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা- যেখানে দিন শেষ জীবিকার চাকা ঘুরত অনেক পরিবারে; কিন্তু হঠাৎ করেই সেই নিশ্চয়তায় আঘাত পড়ল ১৩ মে রাতে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী শিক্ষার্থী ও স্যার এএফ রহমান হল ছাত্রদলের সাহিত্য ও প্রকাশনা সম্পাদক শাহরিয়ার আলম সাম্য হত্যাকাণ্ডের পর।
এই হত্যাকাণ্ডের পরই অতিরিক্ত নিরাপত্তা নিশ্চিতের অংশ হিসেবে উচ্ছেদ করা হলো সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ভেতরের শতাধিক ভাসমান দোকান। হঠাৎ এই সিদ্ধান্তে বিপর্যয়ের মুখে পড়েছেন বিক্রেতারা। ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এক সপ্তাহের মধ্যেই তাদের সম্মিলিত ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৫ লাখ টাকারও বেশি।
পানির ডিলারদের ব্যবসা প্রায় বন্ধ
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের আশপাশে মোট পাঁচজন পানির ডিলার নিয়মিত হকারদের কাছে পানি সরবরাহ করতেন। তাদের মধ্যে অন্যতম শাহজাহান, যিনি ১৯৯২ সাল থেকে এই এলাকায় ব্যবসা করছেন।
তিনি বলেন, ‘সাম্য ভাইয়ের হত্যাকাণ্ডের আগে আমি প্রতিদিন ৮০-৯০ কেচ পানি ২৪০ টাকা দরে বিক্রি করতাম, আয় হতো দিনে ২১ থেকে ২২ হাজার টাকা; কিন্তু এখন ১৫-২০ কেচও বিক্রি হয় না। গত এক সপ্তাহে প্রায় দুই লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে।’
আরেক ডিলার রহিম মিয়া জানান, ‘আগে প্রতিদিন ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউশনের সামনে থেকে ১৫০ কেচ পানি বিক্রি করতাম। এখন তা নেমে এসেছে মাত্র ১৫-২০ কেচে। আমি ৪ লক্ষ টাকার পানি কিনে রেখেছি। এর মধ্যে ৫০ হাজার টাকার মতোই বিক্রি হয়েছে। প্রায় ২ লক্ষ টাকা ক্ষতির মুখে আছি।’
আইসক্রিম বিক্রেতাদেরও দুর্দশা
দশ বছর ধরে উদ্যানের গেটের পাশে আইসক্রিম বিক্রি করে আসছেন আরিফ মিয়া। তিনি বলেন, ‘১৩ মের আগে দিনে ৩০-৩৫ কেচ বরফ বিক্রি করতাম ৪৪০ টাকা দরে। রোজ আয় হতো প্রায় ১৫ হাজার টাকা। এখন একদমই বিক্রি নেই। সাত দিনে আমার এক লাখ টাকারও বেশি ক্ষতি হয়েছে।’
ফুডকার্ট ও ফুসকা বিক্রেতাদের সর্বনাশ
রমনা কালীমন্দির গেটের পাশে ফুসকা বিক্রেতা আলাউদ্দিন বাবু বলেন, ‘প্রতিদিন আমার দোকানে ২৫-৩০ হাজার টাকার ফুসকা বিক্রি হতো। দোকান ভাঙার পর এক টাকাও রোজগার করতে পারছি না। আমার একার ক্ষতি আড়াই লাখ টাকা। আমার মতো আরও অন্তত ১০ জন ফুসকার দোকান উচ্ছেদ করা হয়েছে- সব মিলিয়ে ক্ষতি প্রায় পাঁচ থেকে ছয় লাখ টাকা।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী আব্দুল্লাহ মনি জানান, তিনি নিজেই ফুডকার্টে খিচুড়ি বিক্রি করতেন। তাতে প্রতিদিন ৬-৭ হাজার টাকা আয় হতো; কিন্তু দোকান ভেঙে দেয়ায় আর আগের মতো বিক্রি হচ্ছে না।
অনিশ্চিত জীবিকা
১৩ মে রাতে সাম্য হত্যাকাণ্ডের পর বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা উদ্যানের ভেতরে ঢুকে ১০-১২টি দোকান ভাঙচুর করে। এতে দোকানিদের দাবি অনুযায়ী প্রায় দুই লাখ টাকার সম্পদের ক্ষতি হয়েছে। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা সে ক্ষতি কাটিয়ে উঠে আবার নতুন করে ব্যবসা শুরু করতে পারবেন কিনা সে বিষয়ে তারা অনিশ্চিত।
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে কিছুদিন আগেও শতাধিক ভাসমান দোকান ছিল; কিন্তু সাম্য হত্যার পর থেকে সেখানে আর ব্যবসা করার সুযোগ নেই। বিক্রেতারা বলছেন, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের মতো অন্য কোথাও ততটা বিক্রি হয় না। ফলে তাদের আয়ের পথ বন্ধ হয়ে গেছে।
পুনর্বাসনের দাবি
ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীরা প্রশাসনের কাছে মানবিক বিবেচনায় পুনর্বাসনের দাবি জানিয়েছেন। তারা অনুরোধ করছেন, অন্তত সাময়িকভাবে বিকল্প কোনো স্থান নির্ধারণ করে তাদের ব্যবসা চালিয়ে যাওয়ার সুযোগ দেয়া হোক। তা না হলে পরিবার-পরিজন নিয়ে অনাহারে দিন কাটাতে হবে তাদের।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে