উদ্বোধনী সংখ্যা ৫ : বাংলা সাহিত্যের সম্ভাবনা
অন্তরে খুব কমসংখ্যক মানুষ সত্যিকারের প্রগতিশীল এবং অসাম্প্রদায়িক
সম্প্রতি ঢাকায় এসেছিলেন আমেরিকাপ্রবাসী লেখক দম্পতি কথাশিল্পী জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত এবং বিজ্ঞানী ও কথাশিল্পী পূরবী বসু। জীবনের পড়ন্তবেলায় এসে তাদের লেখালেখি ও জীবনদর্শনের গল্প শুনতে ঢাকার শান্তিনগরের বাসায় গিয়েছিল ‘ভিউজ বাংলাদেশ’ টিম। এই লেখক দম্পতির সাহিত্য, দর্শন, রাজনীতি ইত্যাদি নিয়ে দীর্ঘ আড্ডায় মেতেছিলেন কবি গিরীশ গৈরিক ও কথাসাহিত্যিক রণজিৎ সরকার ও ভিউজ বাংলাদেশের সহ-সম্পাদক মাহফুজ সরদার।
গিরীশ গৈরিক: জীবনের প্রয়োজনে মানুষ এক দেশ থেকে আরেক দেশে যায়। সে ক্ষেত্রে আমরা দেখেছি, সিরিয়ান কবি আদুনিস, কলকাতার মেধা মজুমদার কিংবা কানাডিয়ান কবি রুপি কৌর। তাদের মতো অনেকেই প্রবাসী হয়েও আন্তর্জাতিক বেস্ট সেলার; কিন্তু বাংলাদেশি প্রবাসী লেখকরা কেন আন্তর্জাতিক বেস্ট সেলার বা বিখ্যাত হতে পারে না, তার কারণ কী?
জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত: কারণ অতি সাধারণ, আমরা ইংরেজিতে লিখি না, আর ইংরেজিতে না লিখলে কোনোদিনই বাঙালি কবি লেখক আন্তর্জাতিক বেস্ট সেলার কিংবা বিখ্যাত হতে পারবে না। তবে অনেকেই চেষ্টা করে যাচ্ছেন বাংলা থেকে ইংরেজি অনুবাদ করে এই শূন্যস্থান পূরণ করতে। যদিও এটা পর্যাপ্ত নয়। তাই আমরা বহির্বিশ্বে পৌঁছাতে পারছি না, অন্যসব ভাষার লেখকদের মতো। সবচেয়ে বড় কারণ হচ্ছে, আপনি যে লিটারেচার অনুবাদ করবেন, তার ইকোনমিক পাওয়ার থাকতে হবে, আমাদের সেই পাওয়ারটা নেই। আমি বিভিন্ন দেশের বইয়ের দোকানে দেখেছি, এই উপমহাদেশের কিছু বই ভারতীয় অনুবাদে, সামান্য দুই-একটি জাপানি। আর সবেচেয় বেশি দেখেছি, জার্মান, স্প্যানিশ বই। তাই আমরা যেহেতু ইংরেজিতে লিখি না, যদিও আমরা কিছু কিছু ইংরেজিতে লিখেছি, তা লিখেছি বাংলাদেশে কিন্তু এগুলো আমরা বহির্বিশ্বে ছড়ানোর চেষ্টাও করিনি, সুযোগও হয়নি। এটা আমাদের ব্যর্থতা।
পূরবী বসু: বিদেশি সাহিত্যে যদি দেখেন, রুশ ভাষায় বলুন, স্প্যানিশ ভাষায় বলুন, পর্তুগিজ ভাষায় বলুন, তারকিশ ভাষায়, আফ্রিকান ভাষায় লেখা উপন্যাস, কবিতা কিংবা অন্যান্য লেখা যেগুলো পৃথিবীতে সুনাম অর্জন করে দেখবেন সেগুলো কিন্তু প্রথমে ইংরেজি ভাষায় অনুবাদ করা হয়। আমরা সাধারণত সেই ইংরেজি থেকে অনুবাদ করি; কিন্তু সরাসরি ওই ভাষাটি শিখে অনুবাদ করা হয় না।
গিরীশ গৈরিক: এই না হওয়ার পেছনের কারণটা কী?
পূরবী বসু: ইংরেজি অনুবাদ করবে কে? ইংরেজি অনুবাদ করার লোকের অভাব। যাদের লেখার ক্ষমতা আছে তারা হয়তো অনুবাদে ততটা আগ্রহী না। তারা হয়তো ভালো ইংরেজি লেখেন; কিন্তু ভালো গল্প লেখার ক্ষমতা নেই। ট্রান্সলেশন ঠিক মতো হয় না, ফলে আমাদের গল্প তারা পায় না। এমন না যে তারা আমাদের গল্প পড়ে বিমোহিত হয় না; কিন্তু তারা তো আমাদের লেখা পড়ার সুযোগই পায় না। কারণ আমাদের লেখা ঠিকমতো পৌঁছায় না তাদের কাছে।
রণজিৎ সরকার: এ জন্য কি উদ্যোগ নেয়া উচিত?
জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত: অনেক রকম উদ্যোগ নেয়ার আছে। তবে আমাদের এখানে লেখার তেমন পাওয়ার নেই, হয়তো উপায়ও নেই। আমাদের লেখার মধ্যে জাপান বা জার্মানির লেখার মতো ইকোনমিক পাওয়ার থাকতে হতো।
মাহফুজ সরদার: বাংলাদেশ থেকে অনেক লেখক সাহিত্যিক বিভিন্ন দেশে গিয়ে থাকেন, তাদের আত্মজীবনীতে লিখেছেন তিনি আমেরিকা গিয়েছেন, জাপানে গিয়েছেন, কানাডায় গিয়েছেন, পেরুতে গিয়েছেন; কিন্তু আমরা জেনেছি প্রবাসী বাঙালিরা তাদের আমন্ত্রণ করে নিয়ে গিয়েছিল; কিন্তু ওই দেশের কোনো সাহিত্য সংগঠন, কিংবা রাষ্ট্র তাদের আমন্ত্রণ করে নিয়ে যায় না এর কারণ কী?
পূরবী বসু: এটা সত্য কথা; কিন্তু পৃথিবীতে আমাদের আর্থসামাজিক যে অবস্থান, সেখানে আমরা গৃহিত নই। আমাদের ডেকে, আমাদের একজন লেখককে ডেকে সম্মানিত করার মতো উদারপন্থি দেশ বেশি নেই। যে বাংলা থেকে একজন কবিকে ডেকে প্রধান অতিথি করবে; কিন্তু কেন করবে? করবে না।
জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত: যেমন আমি যখন ইউনিভার্সিটি অব মিসৌরিতে পড়তে যাই, লাইব্রেরিতে বাংলা নভেল খুঁজতে লাগলাম, দেখলাম বুদ্ধদেব বসুর একটি গল্পের অনুবাদ। আমরা তো জানিই না যে বুদ্ধদেব বসু এত গল্প অনুবাদ করেছেন।
পূরবী বসু: যেমন রবীন্দ্রনাথের কথাই যদি ধরেন, আমাদের একমাত্র নোবেল পাওয়া মানুষ, উনি তো 'গীতাঞ্জলি' ইংরেজিতে নিজেই অনুবাদ করেছিলেন। তার আগে তো ওনাকে কেউ জানতো না। সেটাও এডিট হয়েছিল এজরা পাউন্ডকে দিয়ে। তারা অনেকখানি পরিবর্তন করেছিলেন। আর ওই সময়টা প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মাঝখানে গোটা ইউরোপ একটা আধ্যাত্মিকতার মধ্যে ঝুঁকে ছিল। তারা মুক্তি চাইছিল। এরকম একজন ঋষির মতো লোক আধ্যাত্মিকতার কথা বলবে, তা শোনার জন্য তারা আগ্রহী ছিল। প্রাণ মন পেতেছিল তারা। রবীন্দ্রনাথের জন্য তারা যেন অপেক্ষা করছিল। রবীন্দ্রনাথের লেখা যে সহজে ধরতে পেরেছিলেন, এ জন্য তারাও তৈরি ছিলেন।
রণজিৎ সরকার: আমাদের এই ব্যর্থতা যদি যুগের পর যুগ চলতে থাকে, তাহলে আমাদের সাহিত্য আর কবে বিশ্ববাসীর কাছে পৌঁছাবে বলে মনে করেন।
পূরবী বসু: আমি জানি না, তবে আমার মনে হয় বিশ্ববাসীর কাছে আমাদের সাহিত্য পৌঁছাবে প্রধানত ডায়াসপোরা সাহিত্যিক বা তাদের প্রজন্মের লেখকদের দিয়ে। আমরা কতটা পারব, জানি না; কিন্তু আমাদের সন্তানরা যারা বাংলায় কথা না বলে; কিন্তু বাঙালি জীবনের কথা জানে, তাদের লেখা আরও বেশি জনপ্রিয় এবং গ্রহণযোগ্য হবে, কারণ তারা ইংরেজিতে লিখবে। যেমন ধরেন, একটা বাংলা লেখা এখন অবহেলিত, কুড়ি বছর দেখা গেল সেই লেখাটিই প্রশংসিত হলো; কিন্তু আমাদের প্রজন্মের যারা ইংরেজিতে লিখছে, তাদের অনেকেই কিন্তু এখন নাম করছে, যেমন: মনিকা আলী, ঝুম্পা লাহিড়ী।
জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত: কিন্তু কথা হলো আমরা নিজেরা যা লিখছি, আমাদের বাঙালি জনসংখ্যা তো কম নয়, আমাদের তো প্রচুর লোক। আমরা পৃথিবীতে চতুর্থ। আমাদের নিজেদের পাঠকই কী যথেষ্ট নয়? অথচ আমরা এটাকে যথেষ্ট মনে করি না। আমাদের এই যে ইংরেজি মনষ্কতা, যেটা আমাদের ব্রিটিশরা দিয়ে গেছে, আমরা এটাকে এখনো ধরে রেখেছি। নিজেদের দিকে আমরা তাকাতে পারি না। আমাদের লিটারেচার কি খুব খারাপ? না তো।
গিরীশ গৈরিক: বহির্বিশ্বের যত বই আমরা পাঠ করেছি, সেই পাঠের বিচার করলে, আমাদের সাহিত্যের মান যে উন্নত নয়, এ কথা আমরা বলতে পারি না।
জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত: আমাদের সাহিত্যের মান যে উন্নত নয়, সেকথা আমরা বলতেই পারি না, বলবও না।
গিরীশ গৈরিক: আমাদের প্রজন্মের সাহিত্য যাতে আমরা ছাড়িয়ে যেতে পারি, সে বিষয়ে আপনাদের পরামর্শ কী?
পূরবী বসু: আমরা মনে করি, বিভিন্নভাবে হয়তো সেটা করা যায়, তবে এককভাবে আমরা চেষ্টা করছি, সেটা হচ্ছে বহির্বিশ্বের লেখকদের একত্র করা। তারা পরস্পরের সঙ্গে মতবিনিময় করবে, লেখা পাঠ করবে, আলোচনা করবে, নিন্দা করবে, অন্য দেশের লেখার সঙ্গে তুলনা করবে, এতে তাদের যোগাযোগটা বাড়বে। সেই চেষ্টা থেকেই আমরা ‘বিশ্ব বাংলা সাহিত্য’ সমাবেশ নামে বছরে একটা অনুষ্ঠান করি। যাতে বিভিন্ন দেশের বাঙালি লেখকরা আসেন, তারা একত্র হয়ে এবং লেখা নিয়ে আলোচনা করেন। বাংলা সাহিত্যে কি লেখা হচ্ছে, তা নিয়ে আলোচনা করেন। এটা একটা উপায়, কিন্তু একমাত্র উপায় না। আর একটা উপায় হলো খুব ভালো ট্রান্সলেশন, বাংলা থেকে ইংরেজি, স্প্যানিশ এমন কিছু ভাষা, যেগুলো অনেকে জানেন এবং বোঝেন, এমন কিছু ভাষায় অনুবাদ হওয়া। কিন্তু সেটা হচ্ছে না।
রণজিৎ সরকার: আপনি খনাকে নিয়ে গবেষণাধর্মী কাজ করেছেন, আমাদের পাকিস্তান-ভারত উপমহাদেশ খনা একটি মিথলজিক্যাল টার্ম। পরে আমরা শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে দেখেছি এই মিথলজিক্যাল টার্মের মধ্য দিয়ে যেতে, যাতে মিথলজিক্যাল সম্পর্কগুলো সাহিত্যে ছড়িয়ে পড়ে। খনার মতো আর কি কোনো টার্ম আছে, যাতে আমাদের চারশ বছরের যে বাংলা সাহিত্য, তা নতুন প্রজন্মের মধ্যে ছড়িয়ে পড়বে?
পূরবী বসু: সম্ভাবনা ছিল হুমায়ূন আহমেদের মধ্যে, খনার পরে, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের পরে জনপ্রিয়তার দিক থেকে দেখেন তাহলে সম্ভাবনা ছিল হুমায়ূন আহমেদের। হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাস নন্দিত নরকে যখন পড়ি, তখন সত্যি সত্যি মনে হয়েছিল একজন লেখক এসেছে আমাদের কাছে, একেবারে অন্যরকম লেখা; কিন্তু পরে আমি নিজেও খুব একটা পড়তে পারিনি, ছিলাম না দেশে; কিন্তু পরে যা পড়েছি তাতে আমি একদম মুগ্ধ হয়নি আরকি। কিছুটা হতাশ হয়েছি কারণ, ঠিক আগের মতো, প্রথম দিকের দু-তিনটা বইয়ের মতো মনে হয়নি। শেষের দিকে তিনি হয়তো বাণিজ্যিক হয়ে গিয়েছিলেন। তারপরও কিছু লেখা ভালো ছিল। তবে শেষের দিকে ‘মধ্যাহ্ন’ ভালো একটি উপন্যাস, যেটা উনি লিখেছেন পাকিস্তান-ভারত বিভাজনকে কেন্দ্র করে, তখনকার হিন্দু-মুসলিম সম্পর্ক, নানা রকম বাদ-প্রতিবাদ নিয়ে। তারপর ‘জোছনা ও জননীর গল্প’, ‘বাদশাহ নামদার’ এসব বই লিখে তিনি আসলে দেখিয়েছেন তিনি চাইলে ভালো লিখতে পারেন, গভীরে যেতে পারেন। উনি যখন ‘মধ্যাহ্ন’ লিখছেন তখন বাংলাদেশে কি হচ্ছে, তার পাশাপাশি ইউরোপে কি হচ্ছে, এমনকি জার্মানিতে কি হচ্ছে, হিটলার কি করল, সেটাও রিলেট করেছেন, যা খুবই ইন্টারেস্টিং। ফলে আমার মনে হয়, মিথ বলতে যেটা বোঝায়, যে মিথলজি দিয়ে সাহিত্য তৈরি হয়, সে মিথ তৈরি করার সুযোগ হুমায়ূন আহমেদের ছিল; কিন্তু আমার মনে হয় না সেটা পুরোপুরি সফল হয়েছে।
গিরীশ গৈরিক: দেবদাসের মতো মিসির আলীর চরিত্রটা এতবেশি সর্বজনীন নয়।
পূরবী বসু: আমারও তা মনে হয়নি। একটা সময় দেখা গেল হুমায়ূন আহমেদের চরিত্রগুলো, একই রকম ক্যারেক্টর, একই ক্যারেক্টার স্টিক্স, পুন পুন ঘটতে থাকলে। ফলে নতুন কিছু পাইনি আরকি। অনেকই মনে করেন, জনপ্রিয়তা মানেই উন্নতমানের লেখা না, আমি সেটা মনে করি না। আপামর জনসাধারণ যখন একজন লেখককে ভালোবাসে, তখন সবাই তো হালকা কিছু পায় না, কেউ কেউ সিরিয়াস কিছুও পায়। জনপ্রিয় লেখা যে সব সময় উন্নতমানের হবে, তা না, তবে হুমায়ূন আহমেদের বেশ কিছু লেখা আছে অন্তত উন্নতমানের। তবে অনেক লেখাই আছে যেগুলো উনি না লিখলেও পারতেন।
গিরীশ গৈরিক: দাদা আপনি সাদ কামালীর এক গল্প ‘জিয়াফত’। যেটাকে আপনি বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠ গল্পের একটি বলেছেন। আপনার গল্পে আমরা কমলকুমার মজুমদার, শহীদুল জহির পরে এক ধরনের জাদুময়তা পাই, ভাষাটা সহজিয়া ভাষা নয়, এই ভাষাজ্ঞান সম্পর্কে আপনার অভিমত কী?
জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত: হা হা হা। যখন আমি লিখতে শুরু করি, এই ধরেন কলেজ ম্যাগাজিনে গল্প লিখলাম, দৈনিকে লিখলাম, তখন আমি ভাষা ব্যবহার সম্পর্কে এত সচেতন ছিলাম না; কিন্তু পরে দু-একটি উদাহরণ আমি দিয়েছি, কীভাবে আমার মধ্যে ভাষা-জ্ঞানটা এলো। ইউনিভার্সিটিতে আসার পরে আমাকে ‘উত্তরণ’ পত্রিকার সম্পাদক এনামুল হক আমাকে সহ-সম্পাদক করলেন, এবং বললেন জ্যোতি নতুন গল্প লিখতে হবে। গল্প লিখে সিকান্দার আবু জাফরের কাছে গেলাম তিনি আমাকে বললেন নতুন করে লিখতে হবে। তখন আমার মনে হলো এমন একটি ভাষা তৈরি করতে হবে, যা লোকের চোখে পড়বে। আমি অন্যদের মতো করে লিখব না, গল্পও আলাদা হবে এবং ভাষাও আলাদা হবে। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে তখন এত ভাবিনি, এখন ভাবি। একটি ভাষার কিছুটা স্বতন্ত্র চেহারা দেয়া এত সহজ না। তার জন্য ভাষাজ্ঞানটি পরিপূর্ণ থাকতে হবে। আমি অনুমান করি আমার সেটা ছিল, আমি বাংলা ভাষার ছাত্র। আমি বাংলা বই পড়বার জন্য বাংলা পড়িনি, বাংলাভাষা শেখা এবং জানবার জন্য বাংলা লিটারেচার পড়েছি; কিন্তু ভাষাজ্ঞান এর পাশাপাশি থাকতে হবে ব্যাকরণ। আমি শরৎচন্দ্র, বিদ্যাসাগরের ব্যাকরণ আমি অতিশয় মনোনিবেশ করে পাঠ করেছি, ব্যাকরণ জ্ঞান আমার ছিল। ফলে ব্যাকরণ এবং ভাষাবোধ দুটিকে একত্র করে আমি অন্যরকম একটি ভাষা সৃষ্টির চেষ্টা করেছি, যা পরে অনেকের কাছে নতুন ভাষা বলে গৃহিত হয়েছে। এটা একটি সচেতন চেষ্টার ফল।
গিরীশ গৈরিক: নির্মলেন্দু গুণের ‘মহাজীবনের কাব্য’ বইয়ে আপনাদের নিয়ে ছোট একটি অধ্যায় আছে, সেখানে বলা আছে, ওনার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘প্রেমাংশুর রক্ত চাই’ এই নামটি আপনারা নির্ধারণ করে দিয়েছিলেন। তার সম্পর্কে আপনাদের স্মৃতিচারণ শুনতে চাই।
জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত: একটা সময় ছিল যখন নির্মলেন্দু গুণ প্রায়ই আমাদের বাসায় অনেক সময় কাটাতো, তখন পরীক্ষা-টরীক্ষাও দেয়নি বাউন্ডেলের মতোই আরকি। কবিতা লিখতো, বন্ধুবান্ধব ছিল। তার প্রথম কবিতার বই বের করবে, আমি বললাম ‘প্রেমাংশুর রক্ত চাই’-এর থেকে আর কোনো ভালো নাম হয় না। বললাম শুধু কবিতা লিখলে তো হবে না নির্মল, ক্যারিয়ার বলে একটা কথা তো আছে। কিছু তো করতেই হবে। এই বলে তাকে আমরা বিএ পরীক্ষা দেয়ানোর জন্য কম চেষ্টা করিনি, তাকে পরীক্ষা দিতে বাধ্য করেছি।
গিরীশ গৈরিক: কিন্তু সে রেজাল্ট তো তিনি কখনো আনতে যায়নি
পূরবী বসু: পরে অবস্য তিনি লিখেছেন, আমরা তাকে পরীক্ষা দিতে জোর-জবরদস্তি করেছি। বিয়ের আগে গুণকে আমি দেখিনি। বিয়ের পরে প্রথম দেখেছি। সে বরাবরই আমাদের ভালো বন্ধু। তবে একটু পাগলাটে আরকি।
রণজিৎ সরকার: পৃথিবীতে জনপ্রিয় হয়েছেন এমন অনেক কবিই আছেন, যারা একটু পাগলাটে-ক্ষ্যাপাটে। সেটা আমেরিকায়ই বলুন আর বাংলাদেশেই বলুন।
জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত: আর কবিরা এক ধরনের প্রশ্রয় পায়, আমরা প্রশ্রয় দেই আরকি; কিন্তু আমরা যখন এদের কাজকর্ম দেখি তখন পাগলামি দেখি না। নির্মলেন্দু গুণের লেখা আমি খুটিয়ে খুটিয়ে পড়েছি, এর মধ্যে কোনো পাগলামো দেখিনি।
গিরীশ গৈরিক: আপনি এ সময়ের প্রতিষ্ঠিত একজন লেখক, একই সঙ্গে একজন বিজ্ঞানী, আপনি বলেছিলেন আপনার চল্লিশটিরও বেশি আর্টিকেল ছাপা হয়েছে। কীভাবে এর যাত্রাটা শুরু হয়েছিল।
পূরবী বসু: আমি এসএসসি পাস করেছিলাম হিউম্যানিটিতে, বিজ্ঞান পড়িনি। কলেজে গিয়ে আমি প্রথম বিজ্ঞান পড়ি। আমি আইএসসি পাস করে যখন অনার্স করতে যাই, তখন ফার্মেসি ডিপার্টমেন্ট খুব পপুলার, খুব শক্ত ওখানে ঢোকা; কিন্তু শক্তের দিকে আমার নজর সবসময় বেশি ছিল।
মেডিকেল কলেজে আমার অ্যাডমিশন হয়ে গেছিল। বাবা নিজে ডাক্তার ছিলেন; কিন্তু বাবা কখনো আমাদের জোর করতেন না, আমি ভাবলাম ফার্মেসিতে পড়ব, ওষুধ তৈরি করব, টাকা ইনকাম করব, বাবাকে সাহায্য করব; কিন্তু ফার্মেসিতে পড়তে পড়তে আমার মনে হলো এটা থিওরিটিক্যাল বিজ্ঞান না, ফলিত বিজ্ঞান। এটার প্রতি আমার আগ্রহ কম হলো আরকি। আমি যে বিজ্ঞান পড়তে চেয়েছিলাম, সে বিজ্ঞান এটা না; কিন্তু বাংলাদেশে এমনই একটা সিস্টেম যে, একটা বিষয়ে কয়েক বছর পড়ার পর যদি ভালো না লাগে, অন্য ডিপার্টমেন্টে যে চলে যাব, আমি স্কলারশিপসহ সবকিছু হারাব। স্কলারশিপ ছাড়া তখন পড়ালেখা করা সম্ভব ছিল না। ফলে বাধ্য হয়ে ফার্মেসিতে আমার অনার্স শেষ করতে হলো। আশানুরূপ ফলও করিনি। তবে ফার্মেসি পড়ার পর প্রথমে একটা সুবিধা পেলাম আমেরিকায় গিয়ে, ওখানে গিয়ে পড়লাম প্রাণ-রসায়ন, তখন বেসিক সায়েন্সের প্রতি আমার যে ঝোঁক ছিল ওটা এক্সপ্লোজার হলো আরকি। একটা সময় বিজ্ঞান বাদ দিয়ে লেখালেখি শুরু করলাম।
গিরীশ গৈরিক: জীবনের এই সময়ে এসে কি কোনো আক্ষেপ আছে যে, আমি এটা করতে পারলাম না?
পূরবী বসু: আমি জীবনের একটা আশা-আকাঙ্ক্ষা ছিল, সেটা হলো হিন্দু-মুসলমানের সম্প্রীতি দেখতে চেয়েছিলাম; কিন্তু সেটা দেখা হলো না। (কান্নাজড়িত কণ্ঠে)।
গিরীশ গৈরিক: এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে আপনার কি মনে হচ্ছে, এই সম্প্রীতির জায়গাটা এখন কোন অবস্থায় আছে?
পূরবী বসু: ভালো না। আগে বৈষম্য-বিরোধটা বাইরে থেকে বোঝা যেত। এখন মানুষ সভ্য হয়েছে, শিক্ষিত হয়েছে ফলে বাইরে থেকে বোঝা যায় না; কিন্তু অন্তরে অনেক কমসংখ্যক মানুষ সত্যিকারের প্রগতিশীল এবং অসাম্প্রদায়িক।
মাহফুজ সরদার: আপনাদের ধন্যবাদ
জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত ও পূরবী বসু: আপনাদেরকেও ধন্যবাদ
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে