Views Bangladesh Logo

কাঙ্ক্ষিত সাড়া ফেলতে পারেনি ভোটার তালিকা হালনাগাদ কর্মসূচি

Kamrul  Hasan

কামরুল হাসান

বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোটার তালিকা হালনাগাদকরণ কর্মসূচি শুরু হলেও নানা কারণে সাধারণ মানুষ এই প্রক্রিয়া সম্পর্কে সম্পূর্ণভাবে অবগত নয়। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, ভোটার তালিকা হালনাগাদ কার্যক্রমে বেশিরভাগ মানুষের মধ্যেই তেমন কোনো সাড়া ফেলেনি।

সরেজমিন গিয়ে জানা যায়, এক সপ্তাহের বেশি সময় পার হয়ে গেলেও অনেক এলাকায় এখনো ভোটার তথ্য সংগ্রহ শুরুই করতে পারেনি তথ্য সংগ্রহকারীরা। আবার ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান বা কাউন্সিলরের প্রত্যয়নপত্র, অনলাইন জন্মসনদের বাধ্যবাধকতা ও কিছু কিছু ক্ষেত্রে তথ্য সংগ্রহকারীদের ধীরগতির কারণে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য পূরণ করতে পারছে না ভোটার তালিকা হালনাগাদ প্রক্রিয়া।

বাড়ি থেকে বাড়ি গিয়ে ভোটারের তথ্য সংগ্রহের কথা বলা হলেও রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় কেন্দ্র স্থাপন করে সেখান থেকে তথ্য সংগ্রহ করছেন তথ্য সংগ্রহকারীরা। জানা যায়, কেন্দ্রে আসার জন্য অনেক এলাকায় মাইকিং করা হচ্ছে।

আবার রাজধানীর বাইরেও একইরকম চিত্র দেখা গেছে। তথ্য সংগ্রহকারী শিক্ষকরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোটারদের অনুরোধ করছেন তারা যেন তথ্য জমা দিতে নির্দিষ্ট কেন্দ্রে আসেন।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে মাঠপর্যায়ের কয়েকজন কর্মকর্তা বলেন, সময়ের বাস্তবতায় সার্বিক নিরাপত্তা এবং কাজের সুবিধার্থে তারা ভোটার হতে ইচ্ছুকদের কেন্দ্রে এসে তথ্য জমা দিতে বলেছেন।

নাসির উদ্দিন চৌধুরী, নির্বাচন কমিশনের সিনিয়র সহকারী সচিব ঢাকা অঞ্চল মো. নাসির উদ্দিন চৌধুরী ভিউজ বাংলাদেশকে জানান বাড়ি থেকে বাড়ি গিয়ে তথ্য সংগ্রহ করতে বলা হয়েছে। তবে তা না হলে জেলা বা থানা কর্মকর্তা বলতে পারবে কেন তারা বিকল্প পদ্ধতিতে যাচ্ছেন। তবে তা কোনোভাবে কাম্যই নয়।

পরিচালক (জনসংযোগ) ও তথ্য প্রদানকারী কর্মকর্তা মো. শরিফুল আলম যেহেতু শহরাঞ্চলে নিরাপত্তা একটা বিষয়, তাই হয়তো তারা এ পদ্ধতি নিতে পারে। যদি কাজ হয় তবে এতে বলার কিছু নেই।

পদ্ধতি সহজীকরণ বিষয়ে তিনি বলেন, এগুলো পূর্বনির্ধারিত। এতো অল্প সময়ে পদ্ধতিগত পরিবর্তন আনা কঠিন হবে।

সারা দেশেই মোবাইল ফোনে এ ব্যাপারে বার্তা দেয়া হচ্ছে বলে নির্বাচন কমিশন জানিয়েছে। এদিকে বেশ কয়েকজন পুরাতন ভোটারের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তারা কোনো বার্তা পাননি ফলে তথ্য সংশোধনের প্রয়োজন থাকলেও, তারা সে বিষয়ে জানতে পারেননি।

মিরপুরের বাসিন্দা শাহিন আযম বলেন, ‘আমি খুঁজে পাচ্ছিলাম না কীভাবে এই তথ্য হালনাগাদের কাজ হচ্ছে। পরে কাউন্সিলরের অফিসে গেলে জানতে পারি কীভাবে তথ্য দিতে হবে।’

প্রচার এবং ভোটার তালিকা সহায়ক ব্যবস্থাপনা আরও সুশৃঙ্খল হতে পারতো মন্তব্য করে সিএসইর ছাত্র শাহিন বলে, ‘যেখানে জন্মনিবন্ধন আছে, এসএসসি সার্টিফিকেট আছে সেখানে এতো জটিল প্রক্রিয়া রাখার কারণই বুঝলাম না। জন্মনিবন্ধনে থাকা স্থায়ী ঠিকানা ধরেও তো সহজেই করতে পারতো। তবে যা বুঝলাম নিজের গরজেই আসলে সব কিছু নির্ভুল করে নিতে হবে। না হলে নিজেকেই পস্তাতে হবে।’

নূরজাহান রোড মূল রোডের পূর্ব পাশের বাড়িগুলোর ভোটার তালিকা হালনাগাদকরণে তথ্য সংগ্রহকারী বেঙ্গল মিডিয়াম স্কুলের শিক্ষক মো. ওমর ফারুক বলেন, ‘আমাদের তথ্য সংগ্রহের সময় ভোটারের নাম, পিতা-মাতার নাম, জন্মনিবন্ধন বা শিক্ষা সনদের সঙ্গে হুবহু মিলিয়ে নিতে বলা হয়েছে। তাছাড়া জন্ম তারিখ অবশ্যই জন্মনিবন্ধন বা শিক্ষা সনদ অনুযায়ী হয়েছে কিনা সেটাও মেলাতে বলা হয়েছে। স্থায়ী ঠিকানা লেখার ক্ষেত্রে অবশ্যই ভোটারের প্রকৃত স্থায়ী ঠিকানা লিখতেও বলা হয়েছে যেন কোনো অবস্থাতেই দ্বৈত বা দুইবার ভোটার না হয়।’

কী কী সমস্যা বেশি হচ্ছে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, অনেকেই সঠিক কাগজপত্র নিয়ে আসেন না। তাদের বুঝিয়ে দিলেই হয়। বেশি সমস্যা হয় যখন অনলাইনে জন্ম সনদে ভুল থাকে। সেটা সংশোধন করে আনা একটা সমস্যা। আবার কাউন্সিলরের প্রত্যয়নপত্র বিশেষ করে এমন সময় যখন তারা পলাতক অবস্থায় আছে তখন এটি আরও সমস্যার সৃষ্টি করছে।

এমনই একজন লালমাটিয়ার রাশেদুল হাসান। তিনি জানান, গত শনিবার আবেদন করে বৃহস্পতিবার তিনি তার জন্ম সনদ এবং প্রত্যয়নপত্র পেয়েছেন।

‘আমার বন্ধুর জন্ম সনদে বাবার নাম ভুল আসছে। এখন এটা সংশোধনে দেরি হচ্ছে। যারা আজকে পাচ্ছে তারা তো সংশোধনের সুযোগও পাবে না’, বলে মন্তব্য করেন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের এই শিক্ষার্থী।

অন্য সময়ের চেয়ে সময় একটু বেশি লাগছে বলে স্বীকার করেন ৩২ নম্বর ওয়ার্ডের ওয়ার্ড সচিব মো. জাহিদ ফেরদৌস। তবে কেউ যেন এই একটু শ্লথ প্রক্রিয়ার জন্য তালিকাভুক্তি থেকে বাদ না পড়ে তার ব্যবস্থাও রাখা হচ্ছে। সাপ্তাহিক ছুটির দিনে খোলাও থাকবে কাউন্সিলর অফিস।

তথ্য সংগ্রহ কার্যক্রম এই দুদিনে চলমান থাকবে বলে জানিয়েছেন তথ্য সংগ্রহ কার্যক্রম কেন্দ্রের সুপারভাইজার লালমাটিয়া স্কুল অ্যান্ড কলেজের সহকারী অধ্যক্ষ মো. শামসুল আলম।

এদিকে, নির্বাচন কমিশন বলছে নির্ভুল ভোটার তালিকা তৈরি করতে এবং নাগরিকদের ভোগান্তি এড়াতে তথ্য সংগ্রহকারীদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে এবং এই প্রক্রিয়ায় নতুন ভোটার অন্তর্ভুক্তি, তালিকা থেকে বাদ পড়া নাগরিকদের তথ্য সংগ্রহ এবং মৃতদের নাম বাদ দেয়ার জন্য বাড়ি বাড়ি গিয়ে তথ্য সংগ্রহ করার কথা বলা হয়েছে। এবার ২০০৮ সালের ১ জানুয়ারি বা তার আগে জন্মগ্রহণকারী সবাইকে অন্তর্ভুক্ত করা হবে।

তারা বলছেন ভোটার হতে হলে ১৭ ডিজিটের অনলাইন জন্মসনদের কপি, জাতীয়তা বা নাগরিকত্ব সনদের কপি, নিকট আত্মীয়ের (পিতা-মাতা, ভাইবোন প্রভৃতি) এনআইডির ফটোকপি, এসএসসি/দাখিল/সমমান অথবা অষ্টম শ্রেণি পাসের সনদের কপি (প্রযোজ্য ক্ষেত্রে), ইউটিলিটি বিলের কপি (বিদ্যুৎ/গ্যাস/পানি/চৌকিদারি ট্যাক্স রশিদের ফটোকপি)।

নির্বাচন অফিসের তথ্যমতে, চলতি বছরের ২০ জানুয়ারি থেকে শুরু করে সারা দেশব্যাপী ভোটার তালিকা হালনাগাদ কার্যক্রম চলছে। চলবে আগামী ৩ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত।
এ কর্মসূচিতে নতুন ভোটারদের তথ্য সংগ্রহ এবং মৃত ভোটারদের নাম কর্তনের তথ্য বাড়ি বাড়ি গিয়ে সংগ্রহ করছেন তথ্য সংগ্রহকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা।

কার্যক্রম মনিটরিংয়ে সুপারভাইজারের দায়িত্ব পালন করছেন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকরা। শহরে থানা কর্মকর্তা এবং উপজেলায় উপজেলা নির্বাচন অফিসাররা স্ব-স্ব উপজলায় তথ্য সংগ্রহের কর্মসূচি তদারকি করছেন।

এরই মধ্যে সব ধরনের সমস্যা এবং বিভ্রান্তি দূর করতে ও এই প্রক্রিয়াকে আরও সহজীকরণ করতে নতুন ভোটারদের অনলাইনে আবেদন করে আবেদনের ডাউনলোডকৃত কপি তথ্য সংগ্রহকারীদের কাছে জমা দিতে অনুরোধ করেছেন ইসি।
নির্বাচন কমিশন বলছে তথ্য সংগ্রহ শেষে আগামী ৫ ফেব্রুয়ারি থেকে ১১ এপ্রিল পর্যন্ত চলবে নিবন্ধন কার্যক্রম। এ সময় নেয়া হবে ছবি, আঙুলের ছাপ এবং চোখের আইরিশের ছবি।

নির্বাচন কমিশন জানায়, একাধিকবার ভোটার হওয়া আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। কেউ একাধিকবার ভোটার হলে আঙুলের ছাপ পরীক্ষার মাধ্যমে তা সহজেই শনাক্ত করা যাবে এবং কেউ যদি পূর্বের তথ্য গোপন করে আবার ভোটার হওয়ার চেষ্টা করে তবে ধরা পড়লে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

রাজধানীর বাইরের অবস্থা
ভোটার তালিকা হালনাগাদকরণ নিয়ে সারা দেশ থেকে আসছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। দেশের বিভিন্ন জেলায় কর্মরত ভিউজ বাংলাদেশের প্রতিনিধিদের দেয়া তথ্য মতে, একেক জেলায় এই হালনাগাদ কর্মসূচি নিয়ে একেকরকম প্রতিক্রিয়া জানা যাচ্ছে।

যেমন ভোটার হালনাগাদ কর্মসূচির বিষয়ে বগুড়া সদর, শেরপুর, শাজাহানপুর, গাবতলী ও শিবগঞ্জ উপজেলার অন্তত ৫০ জন বাসিন্দার সঙ্গে কথা বলা হয়।

তাদের বেশিরভাগ ব্যক্তিই জানান, ভোটার তালিকা হালনাগাদ শুরু হয়েছে কি না তা তারা জানতেন না। নির্বাচন অফিস থেকে তথ্য সংগ্রহকারী আসার পর অনেকে জেনেছেন। মুঠোফোনে খুদে বার্তায় এ তথ্য দেয়া হলেও তারা কেউ তা দেখেননি। এর মধ্যে আবার অনলাইনে আবেদন করে সেই কপি জমা দেয়ার বিষয়টিও তাদের জানা নেই।

বগুড়ার সিনিয়র জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা মো. ফজলুল করিম বলেন, নিয়ম অনুযায়ী বাড়ি বাড়ি গিয়ে তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। তবে অনেক তথ্য সংগ্রহকারী এক বাড়ির উঠানে বসে ভোটারদের কাছে খবর পাঠান। আশপাশের ভোটার সেখানে এসে তথ্য দিয়ে যান। উপজেলাভিত্তিক তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। সব এলাকায়ই যাওয়া হবে।

এদিকে দিনাজপুর, রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল, সিলেটের একাধিক উপজেলা থেকে এই সংক্ষিপ্ত সময় ভোটার তালিকা হালনাগাদকরণ করা যাবে কি না তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন বাসিন্দারা।

সাভারে জন্মনিবন্ধন জটিলতায় আটকে যাচ্ছে নতুন ভোটার তালিকাভুক্ত হওয়া। তবে দেশের অধিকাংশ উপজেলা থেকে বিপরীত চিত্র দেখা যাচ্ছে সাভারে। ভোটার হালনাগাদে অংশ নেয়া মাঠকর্মীদের দাবি, এবারের ভোটার হালনাগাদে ব্যাপক সাড়া পাওয়া যাচ্ছে। তবে কিছু জটিলতার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সঠিক না থাকা, মা-বাবার ভোটার কার্ডের সঙ্গে নামের অমিল ছাড়াও স্থায়ী ও অস্থায়ী ঠিকানা নিয়ে বিলম্বিত হচ্ছে। আগের তুলনায় অনেক নতুন ভোটার হতে আগ্রহ দেখাচ্ছে।

চট্টগ্রামের ২৬টি উপজেলায় ভোটার তালিকা হালনাগাদ কার্যক্রম শুরু হয়েছে। প্রচার-প্রচারণা কর্মসূচিও চলমান রয়েছে। তবে নতুন ভোটারদের তথ্য সংগ্রহ এবং মৃত ভোটার কর্তনের তথ্য সংগ্রহের কার্যক্রমে তেমন সাড়া পড়েনি তিন পার্বত্য জেলা বান্দরবান, রাঙামাটি এবং খাগড়াছড়ি জেলায়। পার্বত্য চট্টগ্রামের ১২২টি ইউনিয়নের প্রত্যন্ত অঞ্চলের গ্রামগুলোর অনেকেই জানেই না ভোটার তালিকার তথ্য সংগ্রহের কাজ শুরু হয়েছে।

তথ্য সংগ্রহকারীরা বাড়ি বাড়ি না গিয়ে গ্রামের একটি স্থানে বসে আশপাশের লোকজনের তথ্য সংগ্রহ করছেন, এতে অনেকেই বাদ পড়ে যাচ্ছেন অভিযোগ স্থানীয়দের।

এ প্রসঙ্গে রাঙামাটি জেলা নির্বাচন অফিসার সাখাওয়াত হোসেন ও বান্দরবান জেলা নির্বাচন অফিসার সাহাদাত হোসেন জানান, তথ্য সংগ্রহের কাজ সন্তোষজনকভাবেই চলছে। শেষের দিকে মূলত সংখ্যাটা বাড়ে। তবে তথ্য সংগ্রহে অবহেলার এখনো কোনো অভিযোগ তারা পাননি।

পার্বত্য চট্টগ্রাম হচ্ছে বিশেষ এলাকা, তাই এখানে উপজেলাভিত্তিক একটি যাচাই-বাছাই বিশেষ কমিটিও রয়েছে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) হলো কমিটির আহ্বায়ক ও নির্বাচন অফিসার সদস্য সচিব। তথ্য সংগ্রহের পর কমিটির যাচাই-বাছাইয়ের পর পরবর্তীতে ভোটার নিবন্ধন ও ছবি তোলার জন্য মনোনীত হবেন। আগামী ১৬ ফেব্রুয়ারি থেকে নিবন্ধন ও ছবি তোলা কার্যক্রম শুরু হবে বলে জানান তারা।

এদিকে কক্সবাজার জেলায় হালনাগাদের কার্যক্রমে বড় চ্যালেঞ্জ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী। স্থানীয়রা বলছেন, সঠিকভাবে পর্যবেক্ষণ না হলে রোহিঙ্গারা ভোটার হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়ে যেতে পারে।


মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ