হাইকোর্টের নির্দেশ উপেক্ষিত: পর্ব ৪
ঢাকার ফুটপাত দিয়ে স্বাচ্ছন্দ্যে হাঁটা এখন স্বপ্নের মতো
তৃতীয় পর্বের পর
সরকার যায় সরকার আসে; কিন্তু রাজধানী ঢাকার সড়ক-মহাসড়কের ফুটপাত রয়ে যাচ্ছে বেদখলেই। এমনকি ফুটপাত দখলমুক্ত করতে হাইকোর্টের দুটি রায় ও একাধিক নির্দেশনাও উপেক্ষিত সবার কাছে। কোনো না কোনোভাবে অধিকাংশ ফুটপাত যেমন দখলেই রাখছেন দখলদাররা, তেমনি তাদের উচ্ছেদে কার্যকর কঠোর উদ্যোগ নেই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষেরও।
তাই ফুটপাত দিয়ে ঢাকাবাসীর স্বাচ্ছন্দ্যে হেঁটে চলাচলের কোনো উপায় আগেও ছিল না, এখনো নেই। গুলিস্তান, পল্টন, রায়সাহেব বাজার, বায়তুল মোকাররম, নিউমার্কেট ও মিরপুর এলাকায় সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, কোথাও ভ্রাম্যমাণ ও টং দোকান, কোথাও পাশের দোকানের পণ্য ও মালামাল, কোথাও আবার বাড়িঘরের নির্মাণসামগ্রী রেখে দখল করে রাখা হয়েছে ফুটপাত।
সেগুলো দিয়ে তাই পথচারীর হাঁটাচলা করা বা ব্যবহারের সুযোগ ও উপায়ই নেই। সূত্র জানায়, শুধু নিউমার্কেট ও বায়তুল মোকাররমে দুটি এলাকার ফুটপাতেই দোকান রয়েছে সাত হাজারের মতো। এর মধ্যে বায়তুল মোকাররমের ফুটপাত দখলে রেখেছে আড়াই হাজারের মতো দোকান। শত শত দোকান রয়েছে মিরপুরের বেগম রোকেয়া সরণিতেও।
নিউমার্কেট-সায়েন্সল্যাবের রাস্তায় দোকানের কারণে হাঁটাই দায়। পথচারীদের চলাচলের কোনো সুযোগ নেই ফুটপাত দিয়েও। ফুটপাতের কোথাও সারি সারি দোকান, কোথাও নানা ধরনের নির্মাণসামগ্রীর স্তূপ, কোথাও দীর্ঘদিন খোঁড়াখুঁড়ি করে ফেলে রাখা হয়েছে, আবার কোথাওবা ফেলে রাখা হয়েছে পরিত্যক্ত যানবাহন। যেখানে-সেখানে ফুটপাতের ওপর হুটহাট উঠে যায় মোটরসাইকেল, রিকশা ও অটোরিকশা। কোনো কোনো ফুটপাতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায় প্রাইভেটকারও।
ফুটপাত দখলে বেশি দুর্ভোগের শিকার কর্মব্যস্ত মানুষ, শিক্ষার্থী, নারী ও শিশুরা। চলাচলে সব সময় বিপাকে পড়তে হচ্ছে তাদের। ঘটছে নানা দুর্ঘটনাও। মিরপুর ১০ নম্বরের ফুটপাত দখল করে কাপড়ের দোকান চালানো মো. আরিফ হোসেন ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন, ‘আমরা নির্দিষ্ট হারে চাঁদা দিয়েই ফুটপাতে ব্যবসা করছি। মানুষ তো ফুটপাত দিয়ে হাঁটছে। আমাদের দোকানে কেনাকাটাও করছে। একটু হয়তো সমস্যা হচ্ছে। কিছু করার নেই।’
গুলিস্তানের ফুলবাড়িয়া মার্কেটের সামনের ফুটপাত দখল করে ফলের দোকান দেয়া মনির হোসেন বলেন, ‘পেটের দায়ে ফুটপাতে দোকান দিয়েছি। এটা দিয়ে সংসার চলে।’ কিন্তু এতে করে যে জনদুর্ভোগ হচ্ছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সে তো একটু হয়ই। এমন দোকান তো আমি একা চালাই না। দেখেন এই লাইন ধরে (ফুটপাতে) কত শত দোকান।’
এদিকে, হযরত শাহ্জালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর সিভিল অ্যাভিয়েশন অথরিটি ও মাস্টার পয়েন্ট শপিং কমপ্লেক্সের সামনের সড়ক, উত্তরা ৪নং সেক্টর, বিমানবন্দর রেলস্টেশন সংলগ্ন এপিবিএন হেডকোয়ার্টার ও র্যাব-১-এর সামনের রাস্তায় ফুটপাতের দশাও বেহাল। আজমপুর থেকে হাউস বিল্ডিং আব্দুল্লাহপুর পর্যন্ত সড়কের দুপাশের ফুটপাত ভাঙতে ভাঙতে মিশে গেছে রাস্তার সঙ্গে। কোনো কোনো অংশে ফুটপাতের চিহ্নও নেই।
রাজধানীর ফুটপাতগুলো বেদখলে থাকায় যানজট এবং দুর্ঘটনা বাড়ছে বলে মনে করেন নগর পরিকল্পনাবিদ স্থপতি ইকবাল হাবিব। ভিউজ বাংলাদেশকে তিনি বলেন, সব ফুটপাত দখল করে রেখেছেন ছোট-বড় ব্যবসায়ীরা। সেখান দিয়ে চলাচলও তাই দুরূহ হয়ে পড়েছে। তিনি বলেন, ‘পথচারীদের নিরাপদে চলাচলের উপযুক্ত স্থান ফুটপাত। প্রশস্ত ফুটপাতের কারণে যানজট বা দুর্ঘটনা অনেক কমে। এই ব্যস্ত নগরীকে যানজটমুক্ত রাখতে স্বল্প দূরত্বে হেঁটে চলার কোনো বিকল্প নেই।
কিন্তু ফুটপাত বেদখলে থাকায় তা দিয়ে পথচারীর চলার কোনো অবস্থা নেই। জায়গা নেই পা ফেলারও। ‘নাগরিকদের অবাধ যাতায়াতের সুবিধায় ফুটপাত মেরামত এবং হাঁটার উপযুক্ত করা প্রয়োজন। ফুটপাতকে নাগরিকদের ব্যবহার উপযোগী করলে এ নগরীর যানজট এবং দুর্ঘটনা অনেকাংশে কমবে’ বলেও পরামর্শ স্থপতি ইকবাল হাবিবের।
ঢাকার ফুটপাতকে দখলমুক্ত করতে ২০০১ ও ২০১২ সালে দুটি রায় দেন হাইকোর্ট, যেগুলোও বাস্তবায়িত হয়নি এখনো। এর মধ্যে ২০০১ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি দেয়া রায়ে রাজধানীর ফুটপাত ও চলাচলের পথকে জনসাধারণের ব্যবহারের উপযোগী এবং পথচারীদের জন্য পরিচ্ছন্ন ও উন্মুক্ত রাখার নির্দেশ দেন হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ। জিরো পয়েন্ট থেকে সদরঘাট পর্যন্ত ফুটপাত দখলমুক্ত করতে ২০১২ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি আদেশ দেন অন্য একটি বেঞ্চ।
অন্যদিকে গত ২৯ এপ্রিল মহানগরীর ফুটপাত দখল, ভাড়া ও বিক্রিতে জড়িতদের তালিকা চান বিচারপতি শেখ হাসান আরিফ ও বিচারপতি মো. বজলুর রহমানের হাইকোর্ট বেঞ্চ। স্বরাষ্ট্র অথবা স্থানীয় সরকার সচিবকে এ তালিকা হলফনামা করে আদালতে দাখিলের নির্দেশ দেওয়া হয়। সেই সঙ্গে ফুটপাত দখল ও বিক্রির সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, তাও জানাতে বলা হয় দুই সচিবকে। এর জবাব এখনো দেননি সংশ্লিষ্টরা।
‘উচ্চ আদালতের রায় ও নির্দেশনাগুলো বাস্তবায়িত না হওয়ায় ফুটপাতগুলো এখনো দখলদারদের দখলে’ বলে মন্তব্য করেন এ-সংক্রান্ত রিটকারী সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী ও পরিবেশবাদী সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট মনজিল মোরসেদ।
অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন, ‘পুরো রাজধানীর প্রায় সব ফুটপাতই হকারদের দখলে। ফলে চরমে পৌঁছেছে জনভোগান্তিও। মতিঝিল, গুলিস্তান, পল্টন, সদরঘাটের ফুটপাতে এ চিত্র আরও ভয়াবহ। অথচ ফুটপাত দখলমুক্ত করতে একাধিকবার হাইকোর্ট থেকে আদেশ ও নির্দেশনা এসেছে। এর মধ্যে সরকারও বদল হয়েছে; কিন্তু সংশ্লিষ্টদের উদাসীনতায় এ চিত্র পাল্টায়নি খুব একটা।’ ঢাকার ফুটপাত কবে নগরবাসীর হাঁটার উপযোগী হবে- তা নিয়েও সংশয় প্রকাশ করেন মনজিল মোরসেদ।
আরও পড়ুন
পর্ব: ১
নিষিদ্ধ পলিথিনে সয়লাব সারা দেশ
পর্ব: ২
নিয়মের তোয়াক্কা না করে দূষণ ছড়িয়ে চলছে ইটভাটা
পর্ব: ৩
নদী দখল-উচ্ছেদ নিয়ে চলছে কানামাছি খেলা
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে