টাকার অবমূল্যায়ন কি জরুরি ছিল
ক্রলিং পেগ পদ্ধতির আওতায় ডলারের মধ্যবর্তী দাম ১১৭ টাকায় নির্ধারণ করে ব্যাংকগুলোকে এই দরের আশপাশে স্বাধীনভাবে লেনদেন করতে নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কিছুদিন আগেও অর্থনীতিবিদরা ডলারের মান সম্পূর্ণ বাজারমুখী রাখতে ‘ফ্লোটিং এক্সচেঞ্জ রেট’-এর পক্ষে ওকালতি করেছেন। তাদের কথা ছিল বৈদেশিক মুদ্রার সঙ্গে আমাদের টাকার বিনিময় হার নির্ধারিত হবে বাজার অর্থনীতির ভিত্তিতে, বিনিময় হার নির্ধারণে কোনো কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ থাকবে না; কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক ফ্লোটিং এক্সচেঞ্জ রেট প্রবর্তনের ঝুঁকি নেয়নি, বিনিময় হার নিরূপণে তারা চালু করেছে ক্রলিং পেগ পদ্ধতি। ফ্লোটিং এক্সচেঞ্জ রেটের মতো ক্রলিং পেগ পদ্ধতি ততটা অবাধ ও উন্মুক্ত নয়, এই পদ্ধতিতে কর্তৃপক্ষের কিছুটা নিয়ন্ত্রণ থাকে। ক্রলিং পেগ পদ্ধতিতে মুদ্রার বিনিময় হারের সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন সীমা নির্ধারণ করা থাকে এবং নির্ধারিত সীমার মধ্যে মুদ্রার বিনিময় করতে হয়।
এই ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক সর্বোচ্চ এবং সর্বনিম্ন দর স্থির না করে একটি মধ্যবর্তী দর নির্ধারণ করেছে; নির্ধারিত এই দরের চেয়ে কিছুটা বেশি বা কিছুটা কমে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো মুদ্রা বেচাকেনা করতে পারবে। বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার বাজারভিত্তিক বা নমনীয় করার ব্যাপারে স্থানীয় অর্থনীতিবিদ এবং আইএমএফ বা ইন্টারন্যাশনাল মানিটারি ফান্ডের পরামর্শ দীর্ঘদিন পর বাংলাদেশ ব্যাংক বাস্তবায়ন করল। আইএমএফ-এর ঋণ পেতে হলে তাদের শর্ত মানতে হয়। আইএমএফের সব শর্ত সব সময় অর্থনীতির অনুকূল হিসেবে বিবেচিত না হলেও তা মানতে হয়। আইএমএফ সবকিছু বিচার করে অর্থনীতির নিক্তিতে, কারণ তাদের ভোট করতে হয় না, জনগণের কাছে যেতে হয় না; তাই মুদ্রার দর নির্ধারণে তাদের অবস্থানের নিক্তি চাহিদা ও সরবরাহ। আইএমএফের সঙ্গে সুর মিলিয়ে দেশের অনেক অর্থনীতিবিদ টাকার অবমূল্যায়নের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন, তাদের কথা শুনছিল না বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের জ্ঞান ও প্রজ্ঞা নিয়ে তারা প্রশ্নও তুলেছিলেন। ক্রলিং পেগ পদ্ধতির ভালো-মন্দ এই মুহূর্তে বিচার করা সম্ভব নয়।
টাকার অবমূল্যায়নে অর্থ পাচার কমে যাওয়ার কথা, তবে বাংলাদেশে কোনো নীতি-পদ্ধতিই সুফল বয়ে আনে না; কারণ নীতি-নৈতিকতা বিবর্জিত অবৈধ কর্মকাণ্ড বেশি হয় বিধায় নীতি-পদ্ধতির তোয়াক্কা কেউ করে না। যাদের প্রধান লক্ষ্য অর্থ পাচার করা, বা যারা কালোবাজারের মাধ্যমে পণ্য সংগ্রহ করে, যাদের অহর্নিশ মাদকের অর্থ অবৈধ পথে পরিশোধ করতে হয় তাদের নিকট বিনিময় হার কখনোই মুখ্য নয়, তাদের লেনদেনের একমাত্র মাধ্যম হুণ্ডি। এ ছাড়াও বড় বড় দুর্নীতিবাজ ও ঘুষখোরের অর্থ পরিশোধ হয় বিদেশে এবং তা হয় হুণ্ডির মাধ্যমে। বিদেশে ধনী ব্যবসায়ীদের অবকাশ যাপন ও বিনোদনের অর্থের জোগান হয় ওভার এবং আন্ডার ইনভয়েসে প্রেরিত অবৈধ অর্থের মাধ্যমে। এই সকল ক্ষেত্রে ডলারের অফিসিয়াল বিনিময় মূল্যের কোনো ভূমিকাই থাকে না। তাই টাকার যত অবমূল্যায়নই হোক না কেন কার্ব মার্কেট বা কালোবাজারে আরও অধিক মূল্যে ডলার বিক্রি হবে। কার্ব বা কালোবাজারে ডলারের মূল্য বেশি থাকলে কিছু প্রবাসী হুণ্ডির মাধ্যমে অর্থ প্রেরণ করবেই। তাই টাকার অবমূল্যায়নে রেমিট্যান্স খুব বেশি বাড়ার সম্ভাবনা নেই।
প্রতি মার্কিন ডলারের মধ্যবর্তী বিনিময় হার ১১৭ টাকায় নির্ধারণ করায় স্থানীয় মুদ্রা টাকার অবমূল্যায়ন হয়েছে ৬ দশমিক ৩ শতাংশ। নিকট অতীতে একবারে এত বড় অবমূল্যায়ন আর হয়নি। এই অবমূল্যায়নে রপ্তানির ক্ষেত্রে কিছুটা সুবিধা হলেও আমদানিকৃত পণ্যের দাম বেড়ে যাবে। আমদানিকৃত পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ার অর্থই হচ্ছে আমদানি কম হবে, বাজারে পণ্যের জোগান কমে যাবে, জোগান কমে গেলে জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাবে। সাম্প্রতিক সময়ে রাজস্ব ও মুদ্রানীতিতে নানা পরিবর্তন এনেও দ্রব্যমূল্য কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে কমিয়ে আনা সম্ভব হয়নি; এই অবস্থায় টাকার অবমূল্যায়নে আমদানি ব্যয় বেড়ে গেলে দ্রব্যমূল্য আরেক দফা বাড়বে। আমাদের আমদানিনির্ভর অর্থনীতি; আমরা যা রপ্তানি করি তার প্রায় দ্বিগুণ অর্থের পণ্য আমদানি করে থাকি। আন্তর্জাতিক বাজারে শুধু জ্বালানি তেল-গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধির কারণে আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পতন ঠেকানো যাচ্ছে না। টাকার অবমূল্যায়নে জ্বালানি তেল-গ্যাসের আমদানি খরচ বাড়বে এবং এর প্রভাব পড়বে উৎপাদনের প্রতিটি ক্ষেত্রে। আমদানি ব্যয় বেড়ে গেলে শুধু আমদানি কমবে না, জিডিপি প্রবৃদ্ধিও কম হবে। অর্থনীতির পথ কখনো সরল রৈখিক নীতিতে চলে না, প্রতিটি নীতি-পদ্ধতির ভালো-মন্দ দুটি দিক রয়েছে।
অনেক অর্থনীতিবিদ এই ক্রলিং পেগ পদ্ধতির পক্ষে দৃঢ় অবস্থান নিয়েছেন, তাদের ধারণা এই পদ্ধতি সাময়িকভাবে না হলেও দীর্ঘ মেয়াদে ফলপ্রসূ হবে। তাদের অভিমত হচ্ছে ক্রলিং পদ্ধতির প্রবর্তনের কারণে রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্স বৃদ্ধি পাবে এবং এই বৃদ্ধির কারণে জিডিপি বাড়বে, মূল্যস্ফীতি কমবে। তাদের অভিমত আইএমএফের ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক আউটলুকের ভাষ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ; আউটলুকের মতে মুদ্রার দর ১০ শতাংশ কমানো হলে রফতানির পরিমাণ বাড়ে জিডিপির দেড় শতাংশ পর্যন্ত; কিন্তু আমাদের রপ্তানি পণ্য মাত্র একটি- বস্ত্র। টাকার অবমূল্যায়নে বস্ত্রসহ অন্যান্য রপ্তানির ক্ষেত্রে দর কষাকষির সক্ষমতা বাড়লেও তা আদৌ কতটুকু সম্ভব হবে তা এই মুহূর্তে নিশ্চিত করা কঠিন। কারণ বস্ত্র উৎপাদনে ব্যবহৃত প্রায় সম্পূর্ণ কাঁচামাল আসে বিদেশ থেকে; টাকার অবমূল্যায়নে দ্রব্যমূল্য বেড়ে গেলে অভ্যন্তরীণ বাজার থেকে সংগৃহীত শিল্পের কাঁচামালের দামও বেড়ে যাবে। এ ছাড়া বিদ্যুৎ-গ্যাসের দর বৃদ্ধি পেলে উৎপাদন ব্যয়ও বেড়ে যাবে। উৎপাদন খরচ বেড়ে গেলে রপ্তানি বৃদ্ধির ক্ষেত্রে এই অবমূল্যায়ন কতটুকু সহায়ক হবে তা এই মুহূর্তে নিরূপণ করা সম্ভব নয়। উপরন্তু বস্ত্র রপ্তানিকারক অন্য দেশগুলোও যদি তাদের মুদ্রার অবমূল্যায়ন করে তাহলে টাকার এই অবমূল্যায়ন থেকে রপ্তানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ খুব বেশি উপকৃত হবে না।
তবে আমদানি হ্রাসের পাশাপাশি রপ্তানি বৃদ্ধি পেলে লেনদেনের ভারসাম্য রক্ষিত হবে; কিন্তু অপরদিকে টাকার অবমূল্যায়নে সরকারের বিদেশি ঋণের বোঝা বেড়ে যাবে, প্রাইভেট সেক্টরে ইতোমধ্যে গৃহীত বিদেশি ঋণ পরিশোধে ঝুঁকি তৈরি হবে। টাকার বিরাট অবমূল্যায়নে রেমিট্যান্স প্রবাহ বৃদ্ধির আশা করছে সবাই; কিন্তু এই ক্ষেত্রে প্রবাসীরা কতটুকু উৎসাহিত হবে তা নিয়ে সন্দেহ আছে; কারণ হুণ্ডি ব্যবসায়ীরা আরও বেশি দরে ডলার কিনবে। হুণ্ডি ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে অর্থ পাঠানো সহজ, হুণ্ডি ব্যবসায়ীরা বাসায় বাসায় গিয়ে অর্থ সংগ্রহ করে থাকে, ব্যাংক বা এক্সচেঞ্জ হাউসে গিয়ে প্রবাসীদের সময় নষ্ট করতে হয় না। আর যারা বিভিন্ন দেশের নাগরিকত্ব পেয়ে গেছে তারা সাধারণত কোন অর্থ প্রেরণ করে না, বরং দেশের স্থায়ী সম্পদ বিক্রি করে হুণ্ডির মাধ্যমে সব অর্থ বিদেশে পাচার করছে। যে সকল প্রবাসী সরকারের তরফ থেকে বিভিন্ন প্রকল্পে প্লট পেয়েছে তারাও প্লটগুলো বিক্রি করে হুণ্ডির মাধ্যমে বিদেশে অর্থ নিয়ে যাচ্ছে। এদের অর্থ পাচারে ডলারের দর কখনো গুরুত্ব পায়নি। ডলার-সংকট কাটানোর নিমিত্তে অবমূল্যায়ন জরুরি ছিল; কিন্তু পাকিস্তানের রুপির বিরাট অবমূল্যায়ন হলেও তাদের বৈদেশিক মুদ্রার সংকট কাটছে না।
প্রকৃতপক্ষে আমদানি নির্ভর দেশের জন্য স্থানীয় মুদ্রার অবমূল্যায়ন খুব বেশি কাজে আসে না। অবমূল্যায়নের পাশাপাশি অর্থ পাচার রোধ করা জরুরি। ব্যাংক থেকে গৃহীত ঋণের টাকা বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে বলেই খেলাপি ঋণ বৃদ্ধি পাচ্ছে- এই কথাটি আজকাল অহরহ উচ্চারিত হচ্ছে। বর্তমানে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৯ শতাংশ; কিন্তু নব্বই দশকের পরেও খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৩৫ শতাংশ। অবশ্য ব্যালেন্সশিট ক্লিন করতে গিয়ে কী পরিমাণ মন্দ ঋণ ‘রাইট অব’ করা হয়েছে তা জানা নেই। নানাবিধ সংকটে দেশের অর্থনীতি চাপে রয়েছে; সরকার এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের গৃহীত নানামুখী উদ্যোগের পরও সংকট থেকে উত্তরণ সম্ভব হচ্ছে না, অর্থনীতি করোনা পূর্ব অবস্থায় ঘুরে দাঁড়ানোর সুযোগ পাচ্ছে না। নীতি-পদ্ধতির প্রয়োগের পাশাপাশি বাংলাদেশ ব্যাংককে তাই নির্মোহ হয়ে কাজ করতে হবে।
এক সময় ডেপুটি গভর্নর না কি নথির ওপর পেনসিল দিয়ে কোম্পানির মালিকের নাম লিখে অনুমোদনের জন্য গভর্নরের কাছে পাঠাতেন, অর্থাৎ অনিয়ম থাকলেও অনুমোদন দিতে হবে; শোনা কথা, সত্য নাও হতে পারে। অনিয়ম বিচারে ব্যক্তির সঙ্গে কারও বা সম্পর্ক বিবেচ্য হওয়া উচিত নয়। অসৎ লোকজন ক্ষমতাধারী ব্যক্তিদের সঙ্গে সুসম্পর্ক থাকার সুসমাচার প্রচার করে নীতি নির্ধারকদের বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করে থাকে। ব্যাংকের চেয়ারম্যানের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর সুসম্পর্ক থাকার বিভ্রমকে গুরুত্ব দিয়ে বেসিক ব্যাংকটি ধ্বংস করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক, শুধু এইজন্যই বাংলাদেশ ব্যাংককে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো দরকার। ঋণের টাকা বিদেশে পাচার হওয়া রোধ করা অতি জরুরি।
খেলাপি ঋণ গ্রহীতাকে জেলে প্রেরণ না করে ঝণের টাকা আদায়ের ব্যবস্থা করা অধিকতর শ্রেয়, বাংলাদেশ ব্যাংকের এই উদ্যোগ প্রশংসনীয়। তবে অনিয়মের সঙ্গে জড়িত ব্যাংক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া ফরজ। ত্বরিৎ ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষেত্র বাংলাদেশ ব্যাংককে আরও তৎপর হতে হবে, বিনা কারণে নথি ধরে রাখার চেয়ে ঘুষ খাওয়া কম অপরাধ।
লেখক: বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক ও টাকশালের সাবেক এমডি
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে