পলিথিনের দূষণ থেকে উত্তরণের উপায়
পলিথিন ও প্লাস্টিক আধুনিক জীবনের বহুল ব্যবহৃত উপাদান হলেও, পরিবেশের জন্য তা ভয়াবহ ক্ষতির কারণ। পলিথিনের বহুল ব্যবহার ও অব্যবস্থাপনার ফলে মাটি, পানি, এবং বায়ুদূষণের পাশাপাশি জীববৈচিত্র্যও হুমকির মুখে পড়েছে। সাম্প্রতিক বিশ্বব্যাংকের এক সমীক্ষায় দেখা যায়, বাংলাদেশের ২৫ শতাংশ প্লাস্টিক অপরিবর্তিত থাকে অর্থাৎ পুনর্ব্যবহার হয় না এবং পরিশেষে তা সমুদ্রে পতিত হয় । ফলে প্রতি বছর প্রায় ২ লাখ ৭ হাজার ৬৮৫ টন প্লাস্টিক সমুদ্রে যাচ্ছে। যত্রতত্র প্লাস্টিক বর্জ্য ফেলার ফলে বর্ষাকালে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয় এবং নদী-নালার ধারণক্ষমতা কমে যায়।
পরিবেশের পাশাপাশি পলিথিন মানুষের স্বাস্থ্যের ওপরও দীর্ঘমেয়াদি এবং ভয়াবহ প্রভাব ফেলে। পলিথিন প্রস্তুত করতে ব্যবহৃত বিভিন্ন বিষাক্ত রাসায়নিক খাবার বা পানির সংস্পর্শে এলে ধীরে ধীরে খাদ্যে মিশে যায়। এই রাসায়নিকগুলো মানবদেহে ক্যান্সার, হরমোনগত অসামঞ্জস্য, এবং প্রজনন সমস্যার কারণ হতে পারে। পলিথিন পোড়ালে বিভিন্ন প্রকার ক্ষতিকর গ্যাস নির্গত হয়। এগুলো শ্বাসনালির প্রদাহ, অ্যাজমা, এবং ফুসফুসের ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়। পলিথিন ধীরে ধীরে ছোট ছোট মাইক্রোপ্লাস্টিকে পরিণত হয়, যা খাদ্য ও পানির মাধ্যমে মানুষের দেহে প্রবেশ করে। মাইক্রোপ্লাস্টিক অন্ত্রের ক্ষতি, রক্তে প্রদাহ, এবং দীর্ঘমেয়াদি বিষক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে। নদী-নালা বা সমুদ্রের পলিথিন বর্জ্য জলজ প্রাণী ও উদ্ভিদকে বিষাক্ত করে তুলছে। এই দূষিত জলজ প্রাণী যখন মানুষ গ্রহণ করে, তখন তা মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি সৃষ্টি করে। প্লাস্টিক খেলনা, প্যাকেটজাত খাদ্য, বা পানির বোতল থেকে নির্গত বিষাক্ত পদার্থ শিশুদের স্নায়ুতন্ত্র ও মস্তিষ্কের বিকাশে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে।
পলিথিন সহজে মাটিতে মিশে না। এটি মাটির উপরে একটি আস্তরণ তৈরি করে, যার ফলে মাটির স্বাভাবিক শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে যায়। পলিথিনের উপস্থিতি মাটিতে উপকারী জীবাণু ও কীটপতঙ্গের বৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত করে, ফলে মাটির উর্বরতা কমে যায়। পলিথিনের কারণে মাটিতে পানি জমে থাকে, ফলে ফসল নষ্ট হয় এবং জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। পলিথিন উৎপাদনের সময় ব্যবহৃত রাসায়নিক পদার্থ মাটিতে মিশে গিয়ে মাটির গুণাগুণ নষ্ট করে। পলিথিনের কণা বৃষ্টির পানির সঙ্গে নদী, হ্রদ ও সমুদ্রে চলে যায়, ফলে জলাশয় দূষিত হয়। জলজ প্রাণীরা পলিথিনকে খাবার ভেবে খেয়ে ফেলে, ফলে তাদের শ্বাসকষ্ট হয় এবং মৃত্যু হয়। পলিথিন পানিতে বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক পদার্থ নিঃসৃত করে, ফলে পানির গুণাগুণ নষ্ট হয় এবং মানুষের জন্য পানের অযোগ্য হয়ে পড়ে। পলিথিনের ক্ষতিকর দিক বিবেচনা করে বাংলাদেশ সরকার ২০০২ সালে পলিথিন শপিংব্যাগ উৎপাদন, আমদানি, বাজারজাতকরণ, বিক্রয় বা বিক্রয়ের জন্য প্রদর্শন, মজুদ, বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে পরিবহন, ব্যবহারকে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করেছে।
পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানের নেতৃত্বে মন্ত্রণালয় পলিথিনদূষণ রোধে নানা কার্যক্রম হাতে নিয়েছে। পলিথিন উৎপাদনের বিরুদ্ধে সরকার জিরো টলারেন্স ঘোষণা করা করেছে। ১ অক্টোবর থেকে সুপার শপগুলোতে এবং ১ নভেম্বর থেকে কাঁচাবাজারসহ সারা দেশে পলিথিন শপিংব্যাগের ব্যবহারের বিদ্যমান নিষেধাজ্ঞা বলবৎ করার কাজ ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে। গত ৩ নভেম্বর থেকে এ পর্যন্ত বাংলাদেশে নিষিদ্ধ ঘোষিত পলিথিন উৎপাদন বিক্রয়, সরবরাহ ও বাজারজাত করার দায়ে ১৯৮টি মোবাইল কোর্ট অভিযান পরিচালনা করে ৪১৩টি প্রতিষ্ঠান থেকে মোট পঁচিশ লাখ সত্তর হাজার টাকা জরিমানা আদায়সহ আনুমানিক ৫০ হাজার ৫৫২ কেজি নিষিদ্ধ ঘোষিত পলিথিন জব্দ করা হয়েছে এবং ৪টি পলিথিন উৎপাদনকারী কারখানার সেবা তথা গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানি সংযোগ বিচ্ছিন্ন ও সিলগালা করে দেয়া হয়েছে।
ইতোমধ্যে পলিথিন ও পলিপ্রপাইলিন শপিংব্যাগবিরোধী সচেতনতামূলক কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। বাজার মনিটরের জন্য উচ্চপর্যায়ের মনিটরিং কমিটি গঠন করা হয়েছে। এ কমিটি নিয়মিত বাজার মনিটর কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছে। ঢাকা মহানগরের বাজারে বাজারে সচেতনতামূলক অনুষ্ঠান আয়োজন, ক্লিনআপ প্রোগ্রামসহ বিকল্প বিতরণ করা হয়েছে। পরিবেশ আইন অমান্য করে অর্থাৎ অবৈধ পলিথিন শপিংব্যাগ যারা উৎপাদন, পরিবহন, বিক্রয় এবং মজুদদারকে মোবাইল কোর্টের আওতায় এনে নিয়মিত জরিমানা ধার্য ও আদায় করা হচ্ছে এবং অবৈধ পলিথিনসামগ্রী জব্দ, কারখানাগুলো বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে।
পলিথিনের বিকল্প সোনালি ব্যাগের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য জলবায়ু ট্রাস্ট ফান্ডের মাধ্যমে প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। এ ছাড়া, বায়োডিগ্রেডেবল মোড়কের ব্যবহার বৃদ্ধি এবং এ-সংক্রান্ত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য সংশ্লিষ্ট অংশীজনের সমন্বয়ে পৃথক একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় পলিথিনসহ সব প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় ১০ বছর মেয়াদি অ্যাকশন প্ল্যান তৈরি করা হয়েছে। ইতোমধ্যে, ঢাকা, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার শহরের প্লাস্টিক বর্জ্য দ্বারা নদীদূষণের হট স্পটগুলো চিহ্নিত করা হয়েছে। অচিরেই সেগুলো অপসারণ এবং প্রয়োজনীয় পরিবেশসম্মত ব্যবস্থাপনা গ্রহণ করা হবে।
হাইকোর্টের নির্দেশনা মোতাবেক একবার ব্যবহার্য প্লাস্টিকজাত পণ্য ব্যবহার বন্ধে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় কর্তৃক তিন বছর মেয়াদি বিশেষ কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। হাইকোর্টের নির্দেশনা মোতাবেক সমুদ্রসৈকত, সৈকত-সংলগ্ন হোটেল মোটেলে সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিকের বিভিন্ন আইটেম পর্যায়ক্রমে বন্ধের বিষয়ে কার্যক্রম চলমান। আশা করা যায় যে, দেশে প্রথমবারের মতো ইপিআরের আওতায় স্থানীয় সরকার বিভাগের সঙ্গে বিভিন্ন দেশি ও বিদেশি ব্র্যান্ডের মালিকরা বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় অর্থায়নসহ সার্বিক বাস্তবায়নে অংশগ্রহণ করবেন। মহামান্য হাইকোর্ট উপকূলীয় এলাকায় সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিকসহ সারা দেশে পলিথিন শপিংব্যাগ বন্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য নির্দেশনা প্রদান করেছেন।
বাঁশ ও বেত দিয়ে তৈরি ব্যাগ, ঝুড়ি বা অন্যান্য পণ্য পরিবেশবান্ধব এবং দীর্ঘস্থায়ী। এগুলো কৃষিপণ্য পরিবহন ও সাজসজ্জায় ব্যবহৃত হয়। কর্নস্টার্চ বা ভুট্টার গুঁড়া থেকে তৈরি বায়োডিগ্রেডেবল প্লাস্টিক পলিথিনের কার্যকর বিকল্প হতে পারে। এটি দ্রুত পচনশীল এবং পরিবেশে কোনো ক্ষতি করে না। নারিকেলের খোসা বা ধানের ছোবড়া থেকে তৈরি পণ্য প্যাকেজিং এবং ব্যাগ হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে। এটি সহজে মাটিতে মিশে যায়। বিকল্প পণ্যের ব্যবহার বাড়ানোর ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ যেমন রয়েছে, তেমন সম্ভাবনাও রয়েছে। সচেতনতার অভাব, খরচ বেশি হওয়া এবং সহজলভ্যতার সীমাবদ্ধতা চ্যালেঞ্জ তৈরি করলেও, প্রচারণা, নীতিমালা বাস্তবায়ন এবং প্রযুক্তির উন্নয়নের মাধ্যমে এসব পণ্যকে জনপ্রিয় করা সম্ভব।
পলিথিনের বিকল্প টেকসই প্রযুক্তির উন্নয়নের জন্য গবেষণা ও উন্নয়নে বিনিয়োগ বাড়ানো উচিত। সরকার, শিল্প খাত এবং সাধারণ মানুষ সবাই মিলে কাজ করলে পলিথিনের বিকল্প টেকসই প্রযুক্তির উন্নয়ন সম্ভব। নতুন প্রযুক্তি উন্নয়নে বিনিয়োগের জন্য যথেষ্ট অর্থ বরাদ্দ করতে হবে। পলিথিনের বিকল্প টেকসই প্রযুক্তির উন্নয়ন একটি জটিল প্রক্রিয়া, তবে এটি আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বিনিয়োগ। অন্যদিকে, আইনের পরিধি আরও বাড়িয়ে পলিথিন ব্যবহারের জন্য জরিমানা এবং অন্যান্য শাস্তির পরিমাণ বাড়িয়ে দিয়ে দোষীদের কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে পলিথিন ব্যবহারকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে উৎসাহিত করতে হবে। পলিথিন উৎপাদনকারী এবং বিক্রেতাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিয়ে বাজার থেকে পলিথিন উঠিয়ে আনার উদ্যোগ নিতে হবে।
পলিথিনদূষণ রোধে জনসচেতনতা বৃদ্ধির প্রচেষ্টা সফল করতে সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে। সরকারি, বেসরকারি এবং ব্যক্তিগত উদ্যোগের মাধ্যমে মানুষকে সচেতন করা গেলে একটি পরিচ্ছন্ন ও স্বাস্থ্যকর পরিবেশ নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। পলিথিনের ব্যবহার কমানো গেলে পরিবেশদূষণ কমবে। পলিথিনের বিকল্প ব্যবহার করে আমরা আমাদের স্বাস্থ্য রক্ষা করতে পারি। তাই আজ থেকেই আমরা সবাই মিলে পলিথিনের বিকল্প ব্যবহার করার অভ্যাস গড়ে তুলি। সাধারণ মানুষকে পলিথিনের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে জানানো এবং তাদের জীবনযাত্রায় পলিথিনের বিকল্প ব্যবহার উৎসাহিত করা হলে এ সমস্যা সমাধানে কার্যকর ভূমিকা রাখা সম্ভব হবে।
দীপংকর বর: উপ-প্রধান তথ্য অফিসার, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে