Views Bangladesh

Views Bangladesh Logo

আমরা আসলে একটু বেশিই পেঁয়াজ খাই

Mamun–Or–Rashid

মামুন–অর–রশিদ

শুক্রবার, ২ ফেব্রুয়ারি ২০২৪

ছেলে ভালো; কিন্তু একটু পেঁয়াজ খায়। শুধু কি দুষ্টু ছেলেরা পেঁয়াজ খায়? নাকি আমরা সবাই একটু বেশিই পেঁয়াজ খাই। বাঙালির রসনাবিলাসে পেঁয়াজ ছাড়া চলে না এ কথা সত্য; কিন্তু বাংলাদেশিরা পৃথিবীর সব চাইতে বেশি পেঁয়াজ খায় এ কথাও যে সত্য তা হয়তো অনেকে জানেন না। এ জন্যই পেঁয়াজ নিয়ে তুঘলকি এত কাণ্ড। পেঁয়াজ হয়ে উঠেছে সিন্ডিকেটের পয়সা আয়ের অন্যতম হাতিয়ার। পেঁয়াজের দাম কমাতে সরকার দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছে; কিন্তু এই দৌড়ঝাঁপ অতীতেও যেমন কোনো পণ্যের দাম কমাতে পারেনি। এবারও পারবে বলে মনে হচ্ছে না। করোনার আগে ২০১৯ এ বাজার নিয়ন্ত্রণে বোয়িং ৭৮৭ এ চড়ে পেঁয়াজ ঢাকার মাটি স্পর্শ করেছে। তখন কিছু দিন পেঁয়াজের মালা গেঁথে গলে পরে ফেসবুক ভাসিয়েছে ললনারা।

পেঁয়াজের দাম বৃদ্ধির বিষয়টি নিয়ে নানাভাবে ট্রল করা হয়েছে। প্রতি বছরের শেষে ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পেঁয়াজের বাজার একটু বেশি চড়ে থাকে। ভারত আগামী মার্চ অবধি পেঁয়াজ রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। এ জন্য বাংলাদেশের বাজারে শুক্রবার সকালে যে পেঁয়াজ ছিল প্রতি কেজি ১২০ টাকা । দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতে হতে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে কেজি প্রতি ২০০ টাকা। এটি কি অন্যায় না। ভারতের ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে কেন পেঁয়াজের দাম বাড়বে! এ প্রশ্ন ভোক্তার। যদিও এর উত্তর নিয়ে কেউ বসেনি।

সারা বিশ্বে পেঁয়াজ উৎপাদন আর ব্যবহারের চিত্র বলছে বিশ্বে বাংলাদেশ পেঁয়াজ উৎপাদেনে তৃতীয় কিন্তু খাওয়ার দিক দিয়ে এক নম্বরে। বাংলাদেশে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসাব বলছে, সারা বিশ্বে সবচেয়ে বেশি পেঁয়াজ উৎপাদন হয় চীনে। দেশটিতে প্রতি বছর ২৪৯ লাখ টন পেঁয়াজ উৎপাদন হয়। এর পরেই রয়েছে ভারতের অবস্থান। ভারত বছরে ২২৮ লাখ টন পেঁয়াজ উৎপাদন করে। বিশ্বে পেঁয়াজ উৎপাদনে তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। গত বছর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর যে হিসাব দিয়েছে, তাতে দেখা যায়, দেশে ৩৭ লাখ টন পেঁয়াজ উৎপাদন হয়েছে।

ভারত এবং চীন পেঁয়াজ রপ্তানি করে থাকে। চীন বছরে ৯ দশমিক ৮৪ লাখ টন পেঁয়াজ রপ্তানি করে। ভারতও বছরে ১৪ দশমিক ৬১ লাখ টন পেঁয়াজ রপ্তানি করে; কিন্তু তবে একটি মজার তথ্য হচ্ছে বিশ্বের শীর্ষ দশ উৎপাদনকারী দেশ না হওয়া সত্ত্বেও নেদারল্যান্ডস পৃথিবীর সব চেয়ে বেশি পেঁয়াজ রপ্তানিকারক দেশ। বছরে তারা প্রায় ১৬ লাখ টন পেঁয়াজ রপ্তানি করে।

এবার খাওয়ার প্রশ্নে যদি আসেন, তাহলে বাংলাদেশ শুধু চীন এবং ভারতের চেয়ে বেশি পেঁয়াজ খায়, তা কিন্তু নয় যুক্তরাষ্ট্রের চাইতেও আমরা ঢের বেশি পেঁয়াজ খাই। কীভাবে এই চিন্তা করছেন, তো পরিসংখ্যান বলছে যুক্তরাষ্ট্র বছরে ৩১ লাখ ৭০ হাজার টন পেঁয়াজ উৎপাদন করে। আর বছরে সাড়ে পাঁচ লাখ টনের মতো পেঁয়াজ আমদানি করে। অর্থাৎ সব মিলেয়ে ৩৭ দশমিক ২০ লাখ টন পেঁয়াজের সরবরাহ ঘটায়। অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্রের ৩৩ কোটি মানুষ বছরে যে পরিমাণ পেঁয়াজ খায়, আমরা ১৮ কোটিই সেই পরিমাণ পেঁয়াজ খাই। অর্থাৎ যুক্তরষ্ট্রের তুলনায় বাংলাদেশের মানুষের পেঁয়াজ খাওয়ার পরিমাণ দ্বিগুণ। তাহলে পেঁয়াজের দাম বাড়বে না কেন। আর পেঁয়াজ নিয়ে কারসাজি হবেই বা না কেন।

বাংলাদেশের মানুষের কথা যদি চিন্তা করেন, তাহলে তরকারিতে পেঁয়াজ দেয়ার পরও ভাতের সঙ্গে একটু পেঁয়াজ ছাড়া যেন তাদের চলেই না। বাংলাদেশিরা যেমন পানতা ভাতের সঙ্গে পেঁয়াজ খায় তেমনি গরম ভাতের সঙ্গেও খায়। তরকারিতে যেমন খায় কাঁচাও তেমন খায়। সারা বিশ্বে মসলার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয় পেঁয়াজ। শুধু মসলা নয়, অনেক দেশে এটিকে সবজি হিসেবেও খাওয়া হয়। তবে যারা সবজি হিসেবে খায়, তারাও আমাদের চেয়ে কম খায়। পেঁয়াজের বৈশ্বিক আবাদ হয় ২২ লাখ হেক্টর জমিতে। বৈশ্বিক উৎপাদন ২২ দশমিক ৯৬ বিলিয়ন টন এবং সর্বোচ্চ উৎপাদন হয় চীন এবং ভারতে।

পেঁয়াজের দেশজ চাহিদা প্রায় ২৬ দশমিক ২৫ লাখ টন এবং এর এক-তৃতীয়াংশ আমদানি দ্বারা মেটাতে হয় এবং মূল আমদানি হয় ভারত থেকে যা আমদানিকৃত পেঁয়াজের ৭৫-৮০%। ২০২০ সালে দেশীয় উৎপাদন ২ দশমিক ৫৩ লাখ হেক্টর জমিতে ৩৩ লাখ ৬২ লাখ টন এবং গড় ফলনের পরিমাণ হেক্টর প্রতি ১৩ লাখ ২৪ টন। এরপর ২০২২ এর যে হিসাব দিয়েছে তাতে দেখা যাচ্ছে দেশে পেঁয়াজের উৎপাদন হয়েছে ৩৭ লাখ টন।

রবি ও খরিপ উভয় মৌসুমে পেঁয়াজ উৎপাদন হয়। শীতকালে উৎপাদিত পেঁয়াজ সারা বছর খাওয়া যায়। রাজশাহী বিভাগে উৎপাদনের পরিমাণ সবচেয়ে বেশি ১২ দশমিক ৫৮ লাখ টন। সর্বাধিক পেঁয়াজ উৎপাদনকারী জেলা পাবনায় উৎপাদনের পরিমাণ ৭ দশমিক ১৯ লাখ টন। সর্বোচ্চ আবাদ হয়েছে ঢাকা বিভাগে ৯৬ হাজার ৩২৬ হেক্টর জমিতে। তবে হতাশার কথা হচ্ছে পেঁয়াজ সংরক্ষণ জটিল বিষয়। শীতের পেঁয়াজ সারা বছরের জন্য সংরক্ষণ করার সময় অন্তত ৩০ ভাগ পঁচে নষ্ট হয়। এ ছাড়া পেঁয়াজের একটি অংশ বীজ হিসেবে সংরক্ষণ করা হয়। কাজেই দেশে পেঁয়াজের উৎপাদন-এবং চাহিদার হিসেবের মধ্যে অনেক কিছু রয়ে গেছে।

কিন্তু হিসাবটা যদি এভাবে করা হয় ২০২২ সালে দেশে মোট ৩৭ লাখ টন পেঁয়াজ উৎপাদন হয়েছে। এর মধ্যে ৩০ ভাগ যদি পঁচে নষ্ট হয়, তাহলে ১১ দশমিক ১ লাখ টন পেঁয়াজ নষ্ট হলো। অবশিষ্ট থাকল ২৫ দশমিক ৯ লাখ টন। আমাদের চাহিদা ২৫ লাখ টন। তাহলে তো দেশে চাহিদার তুলনায় বেশি পেঁয়াজ থাকার কথা। কিন্তু উৎপাদিত পেঁয়াজের মধ্যে একটি অংশ পরের বছরের জন্য বীজ হিসেবে রাখা হয়। সরকারি হিসাব বলছে প্রতি বছর চাহিদার এক-তৃতীয়াংশ পেঁয়াজ আমদানি করা হয়। অর্থাৎ গড়ে ৮ লাখ থেকে সাড়ে ৮ লাখ টন পেঁয়াজ আমদানি করা হয়।

এই সংকট মেটাতে আমাদের কি করতে পারি সেই চিন্তা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরেকেই করতে হবে। পেঁয়াজ চাষের আওতা বাড়িয়ে পেঁয়াজের উৎপাদন বৃদ্ধি করে স্বনির্ভর হতে হবে। অথবা পেঁয়াজ আমদানির একাধিক উৎস চিহ্নিত করতে হবে।

প্রথমত, পেঁয়াজর উৎপাদন বাড়াতে হলে নতুন করে আরও ৭৫ হাজার হেক্টর জমি পেঁয়াজ চাষের আওতায় আনতে হবে। এটি রাতারাতি করা সম্ভব নয়। পদ্মা, মেঘনা, যমুনার যে চরাঞ্চল রয়েছে সেখানে পেঁয়াজ চাষের নতুন জমি চিহ্নিত করে কৃষককে প্রণোদনা দিতে হবে। ঢাকা এবং রাজশাহী অঞ্চেলের কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরকে পরিকল্পনা হাতে নিতে হবে। এটি যদি করা হয় তাহলে একটি নির্দিষ্ট সময় পর আর পেঁয়াজ আমদানির বদলে আমরা নিজেরাই স্বনির্ভর হয়ে উঠব। আমদানি করার প্রয়োজন না হলে কেউ তার দেশের ক্ষেত্রে কি নীতি গ্রহণ করল তাতে আমাদের কিছুই যাবে আসবে না।

দ্বিতীয়ত, আমদানির উৎস বহুমুখীকরণ করা খুব জরুরি। এখন আমরা যে পেঁয়াজ আমদানি করি তার ৮০ ভাগই ভারত থেকে আমদানি করা হয়। বাকি ২০ ভাগ পেঁয়াজ সাধারণত মিয়ানমার থেকে আমদানি করা হয়। মিয়ানমারের অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে তাদের ওপর নির্ভর করা কঠিন। এরপরও দেশটির সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক বৃদ্ধি করা হলে বিভিন্ন ফসল আমদানিতে বাংলাদেশ সুবিধাজনক অবস্থায় থাকবে বলে মনে করা হয়।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ