শেষ পর্ব
আমরা এক ধরনের রেশনকার্ডের ডেমোক্রেসিতে আছি
প্রথম পর্বের পর:
বীর মুক্তিযোদ্ধা জেড আই খান পান্না। প্রবীণ আইনজীবী। আইনি সহায়তা সংস্থা ‘আইন ও সালিশ কেন্দ্র’-এর চেয়ারম্যান। মুক্তিযুদ্ধসহ এদেশের সব আন্দোলন-সংগ্রাম ও গণঅভ্যুত্থানে তার রয়েছে বলিষ্ঠ অবস্থান। গত জুলাই-আগস্টের ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানেও ছাত্রদের হয়ে প্রত্যক্ষ ভূমিকা পালন করেন। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কার্যক্রম, আইন, সংবিধান ও রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ বিষয়ে ‘ভিউজ বাংলাদেশ’-এর মুখোমুখি হয়েছেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন গিরীশ গৈরিক ও হাসান শাহাদাত তৌহিদ।
ভিউজ বাংলাদেশ: আপনার বিরুদ্ধে খিলগাঁও থানায় হত্যাচেষ্টা মামলা হলো, জামিনও পেয়েছেন। এ মামলা নিয়ে আপনার অভিব্যক্তি কী?
জেড আই খান পান্না: কী বলব- হত্যাচেষ্টার মামলা হলো, জানি না, শুনি না। আংশিক সত্যিও যদি হতো, তাহলেও আমার আপত্তি ছিল না। ওই লোক (বাদী) তো বলছেন, আমাকে চেনেনও না, জানেনও না। প্রথমে আমার ধারণা ছিল যে, হয়তো সরকার করেছে। কিন্তু পরে সরকারি কিছু আইন কর্মকর্তার আচার-আচরণে বুঝলাম যে, তারাও অসন্তুষ্ট। তারাও এটা জানেন না। তাদের আচরণে বুঝছি, তারা আসছেন, দেখা করছেন, দুঃখিত বলছেন, দেখি কী করা যায় ইত্যাদি। আমি কিন্তু কারও কাছে যাইনি। আমার অভ্যাস হচ্ছে, আমি কিন্তু তদবির করতে পারি না। নিজের কথাতো বলতেই পারি না। পরে দেখলাম, আমার মামলার বিষয়ে তারা কিন্তু অপোজ করেননি। ওপেন কোর্টে তারা বলছেন।
এটাতো ক্লিয়ার, তারা ইনভলব নন। তাহলে কারা ইনভলব? ওইখানে যারা পলিটিক্স করছেন, তাদের মধ্যে কেউ ইনটেনশনালি (ইচ্ছাকৃত) হয়তো এটা করছেন। শোনা কথা, অনেকে বলছেন, কেউ বলেন, জামায়াতের উকিল, কেউ বলেন, ওখানে ছিল ইত্যাদি। বিএনপি করছে, আমি বিশ্বাস করি না। বিএনপি আমার বিরুদ্ধে মামলা করতে যাবে কেন? আর জামায়াতও বা করতে যাবে কেন? কারণ, ওই এলাকায় তো আমার কোনো কিছু নেই। মেরাদিয়ায় আমি কখনো গিয়েছি কী না, মনে পড়ে না। অনেককে জিজ্ঞেস করলাম, তারা বললেন যে, বনশ্রীর পরে। তো বনশ্রীতেই গিয়েছি, এক দিন না দুদিন।
একটা মামলা, যেটিতে ৩০৭ ধারা, ৩২৬ ধারা দিয়েছে- এগুলো এটেম টু মার্ডার, ধারালো অস্ত্র দিয়ে হত্যাচেষ্টা। একদম জেনুইন ফ্রিডম ফাইটার হয়ে এতদিন পর হলেও এটেম ভুল হবে, এটা আমার কাছে অন্যরকম লাগছিল যে, কী দিল যে, এটেম ভুল হয়ে গেছে এবং তাও কি বাঁশ, রড এসব ধারালো অস্ত্র নিয়ে মারতে গিয়েছি। আমার বদনাম বা নাজেহাল করতে কেউ না কেউ তো করছেন। কে করছেন, আমি জানি না, তো দোষারোপ করব কাকে? দোষারোপ করার লোকই খুঁজে পাই না।
ভিউজ বাংলাদেশ: আপনার নামে ভুয়া মামলা হয়েছে, এভাবে তো শত শত মামলা ৫ আগস্টের পর থেকে হচ্ছে এবং সেসব মামলায় শত শত আসামি। এই মামলাগুলো আইনি প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে কীভাবে যাবে, বা টিকবে কি না?
জেড আই খান পান্না: আমরা বরাবরই বলে এসেছি যে, এই মামলার সব জায়গায় একটিই স্ক্রিপ্ট। লেখার ধরন একই রকম। কেউ লিখে দিলেন তো, ওটাই ফলো করে নাম-পরিচয় বসিয়ে মামলা দিয়ে দিচ্ছে। এটা হলো নাজেহাল করতেই। এসব মামলা প্রথম ধাপেই টিকবে না।
ভিউজ বাংলাদেশ: ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে নজিরবিহীন এত মামলা। তিনি দেশের বাইরে থেকে কীভাবে মোকাবিলা করবেন?
জেড আই খান পান্না: সেটা তো আর আমি বলতে পারব না। এটা ওনার ল-ইয়ার বা উনি বলতে পারবেন, পরিকল্পনা কী। তবে আমি বুঝি, এটা ফেইস করতে হবে রাজনৈতিকভাবে। সবই খুনের মামলা এবং এক নম্বর আসামি শেখ হাসিনা। কী বলব, রাজনৈতিক কারণেই এ খুনগুলো হয়েছে, তাই রাজনৈতিকভাবেই মোকাবিলা করতে হবে, আইনিভাবেও।
ভিউজ বাংলাদেশ: শেখ হাসিনার পদত্যাগপত্র ইস্যুতে রাষ্ট্রপতি বলেছেন, প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগের দালিলিক কোনো প্রমাণ নেই তার কাছে। এ বিষয়ে আইন উপদেষ্টা বলছেন, তিনি রাষ্ট্রপতি থাকার যোগ্য কি না- সেটা তারা ভেবে দেখবেন। এ এখতিয়ার একজন উপদেষ্টার আছে কি না?
জেড আই খান পান্না: এটা বাড়াবাড়ি হচ্ছে। তাদের উচিত, নিজেদের মধ্যে কোনো কথা থাকলে আলাপ-আলোচনায় মীমাংসা করা। কেউ যদি পদত্যাগপত্র দেখতে চান, তাহলে বলবেন, আছে। আমি বলব, যেটা নিয়ে ডিবেট করছেন, এটা ইনমেটরিয়াল। প্রাক্টিক্যালি যদি থাকেও, তাতে কি? পদত্যাগপত্র থাকলেও কি, না থাকলেও কি- ফলাফল শূন্য। ডিবেট শুরু করে দিয়েছেন, নিজেদের ভেতরে পাবলিকলি। এটা তাদের ক্ষতি করছে। ভীষণ ক্ষতি করতেছে।
রাষ্ট্রপতি হয়তো সঠিকভাবেই বলছেন যে, তার কাছে নেই; কিন্তু তিনি তো রেফারেন্স চেয়ে পাঠিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের কাছ থেকে। তো সেক্ষেত্রে এই লেটারটাও একটা ইস্যু। তবে প্রধানমন্ত্রী ছিলেন না, এটা তো সত্যি, দেশত্যাগ করেছেন। আর রাষ্ট্রপতির সঙ্গে ডিবেটে গিয়ে আসিফ নজরুল বলছেন যে, এটার পরে রাষ্ট্রপতি থাকার আর যোগ্যতাই নেই। তাহলে রাষ্ট্রপতিকে নিয়োগ কি তারা দিয়েছেন? রাষ্ট্রপতিকে আগে পার্লামেন্ট নিয়োগ দিয়েছে। আর তাদের নিয়োগ দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি।
ভিউজ বাংলাদেশ: প্রধান বিচারপতিসহ কয়েকজন বিচারপতিকে পদত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে। আইনজীবীদের মধ্যেও বিশাল পালাবদল ঘটেছে। এই পালাবদলে আইন বিভাগ এবং বিচারিক আদালতে কোনো ব্যত্যয় ঘটেছে, কি না?
জেড আই খান পান্না: অবশ্যই ব্যত্যয় ঘটেছে। এটা বিচারাঙ্গনের বিষয়। বাইরের ছাত্ররা এসে যে মব ভায়োলেন্স করছেন, এটা আমার কাছে নিন্দনীয় মনে হয়েছে এবং বিয়ং দেয়ার জুডিস অ্যাকশন। এটা তাদের জুডিস অ্যাকশন না। তাদের স্লোগান ছিল, ১২ জন বিচারপতি আওয়ামী লীগের নিয়োগ করা। দুর্নীতিপরায়ণদের বিরুদ্ধে তো তাদের কোনো স্লোগান ছিল না। দুর্নীতিবাজরা তো এখনো আছেন বহাল তবিয়তে। যে কেউ গিয়ে জেনে আসতে পারবেন। সুপ্রিম কোটের ইট-বালু-চুন-সুরকি পর্যন্ত আপনাদের বলে দেবে যে, কে দুর্নীতিপরায়ণ। তারা (ছাত্ররা) কেন এসে আইনজীবীর গায়ে হাত দেবেন? গায়ের জোর দেখাবেন?
মব ভায়োলেন্স- এটা কোন আইনে পড়ে? ছাগল নাচে কিন্তু খুঁটির জোরে, খুঁটি ছিঁড়ে গেলে কিন্তু খবর আছে। আইনজীবীরা ছোটখাটো প্রতিবাদ করেছেন যে, আইনের শাসন এবং শৃঙ্খলা বজায় রাখতে হলে এগুলো প্রতিহত করতে হবে। সব জায়গায় দুর্নীতি থাকলেও আইন বিভাগে বিচারপ্রাঙ্গণে যদি দুর্নীতি থাকে, তাহলে সারা দেশে দুর্নীতি বহাল থাকবে। এটা ঠিক যে, এই জায়গাটাকে দুর্নীতিমুক্ত করতে হবে; কিন্তু উপায় কী? উপায় মব ভায়োলেন্স না। উপায় হলো আইনানুগভাবে যাওয়া।
ভিউজ বাংলাদেশ: আসামিদের আদালত প্রাঙ্গণে ডিম ছুড়ে মারা, শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করা হয়। এগুলো আইনি প্রক্রিয়ার মধ্যে কী ধরনের অভিঘাত সৃষ্টি করেছে?
জেড আই খান পান্না: ক্ষমতাসীন যারা তারা যখন আবার পরবর্তীতে ক্ষমতাচ্যুত হবেন এবং আদালতে দেখবেন, এটার ফল কী হয়? এখন তো ডিম ছুড়ে মারছে। পুলিশি হেফাজতে থাকাকালে গায়ে যদি একটা ফুলের টোকাও পড়ে, পুলিশ প্রশাসনের দায়িত্ব। বিচারকের কক্ষে এজলাসে ঢুকে মেরেছে। এগুলো কী এমনি এমনি শেষ হয়ে যাবে, যত বড় অপরাধীই হোক। এটাও তো বিচারবহির্ভূত কর্মকাণ্ড, না? শামছুদ্দিন চৌধুরীর সঙ্গে আমি একমত নাও হতে পারি; কিন্তু তার সঙ্গে যে অত্যাচারটা করা হয়েছে, এটা বর্বরোচিত অত্যাচার এবং বিচারাঙ্গনের কলঙ্কময় অধ্যায়। আমি শুনেছি, সত্য মিথ্যা জানি না। কিছু কিছু আইনজীবী রাশেদ খান মেনন, হাসানুল হক ইনু তাদের ইঙ্গিত করে বলেছেন যে, দেখ- ‘আমরা অমুক দলের’।
হতে পারে, তাদের পদস্খলন হয়েছে, নীতিগত দিক থেকে, এটা ঠিক। বাট ওয়ানস আপন এ টাইম দে ওয়ার মিথ। বিশেষ করে রাশেদ খান মেনন তো ডাকসুর ভিপি ছিলেন আইয়ুব খানের আমলে। এটা কোনো জোকস নয়। তার সময় কনভোকেশনে (সমাবর্তন) মোনায়েম খানকে আসতে দেননি। ব্রেক হয়েছে। কাজী জাফর, মেনন- তারা ছিলেন মিথ। কাজী জাফর হচ্ছেন প্রথম ছাত্রনেতা, যিনি ছাত্রাঙ্গন থেকে মাস্টার্স ডিগ্রি নিয়ে টঙ্গীতে গিয়ে শ্রমিক রাজনীতি করেছেন। আর সিরাজুল আলম খান, রুহুল আমিন ভূঁইয়া, মোহাম্মদ শাহজাহান আদমজীতে। তাদের নলেজ যদি দেখতেন, অবাক হওয়ার মতো। মনে হয় যেন তারা একেকজন ইতিহাসবেত্তা। আবার অঙ্কের বেলায় জিজ্ঞেস করবেন, এত সুন্দর করে বোঝাতেন, আমি অবাক হয়ে জেলে বসে বসে শুনতাম। কী চমৎকারভাবে তারা বলেন। পাবলিক মিটিংয়ে এটা পাবেন না, পাবলিক ফিগারও না এবং ওই ধরনের নেতাও আমি খুঁজে পাইনি- এটা সত্যি।
ভিউজ বাংলাদেশ: আনুপাতিক নির্বাচনের কথা বলছেন, জামায়াতও সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছে। এর প্রভাব কেমন হতে পারে বলে মনে করেন।
জেড আই খান পান্না: এটা অগ্রিম বলা কঠিন। কারণ, আমাদের দেশে চলছে এক ধরনের। তাদের হিসেব ঠিকই আছে। কারণ, তাদের (জামায়াতের) কিছু মাইনরিটি ভোটের মতো তাদের কিছু ভোট আছে। সংখ্যাভিত্তিক নির্বাচনে আওয়ামী লীগের লাভ বেশি। ব্যাখ্যাটা হলো, বিএনপি-আওয়ামী লীগ। বিএনপি জোট আর আওয়ামী লীগের একার। এখানে ওয়ান-টু পার্সেন্টের পার্থক্য। সেই জোট থেকে যদি এরা ছুটে যায়, তাইলে নির্ঘাত আওয়ামী লীগ রুল করবে।
ভিউজ বাংলাদেশ: আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের বিষয়ে সরকারে ভেতর-বাইরে থেকে আওয়াজ উঠেছে। আওয়ামী লীগ কি নিষিদ্ধ করার মতো দল?
জেড আই খান পান্না: আওয়াজ উঠতে পারে। নিষিদ্ধ করলেও কাগজপত্রে, তারপরও কি সম্ভব? আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের পরে এটা যদি গোপন সংগঠন হয়, তো খবর আছে। গোপন সংগঠন মানে কী? তার সারভাইভের জন্য হি ক্যান ডু অর আনডু এনিথিং। যে কারণে আমরা সব সময় বলি যে, প্রকাশ্য রাজনীতির একটা সুবিধা আছে। এতে বোঝা যায়, তার মতামত কী? কিন্তু যখনই আপনি গোপনে যাবেন, তখন আমাকে কোন জায়গা থেকে আক্রমণ করবেন- এটার তো কোনো ঠিক নেই। আপনার মন্তব্য-অভিমত-কৌশল তো আমি জানতে পারবো না। প্রকাশ্যে থাকলে তো বুঝতে পারব- মিছিল করে ঠেকাবেন না মিটিং করে ঠেকাবেন। রাষ্ট্রের যিনি প্রধান আইন কর্মকর্তা, তিনি তো বলছেন যে, আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধের পক্ষে নন।
ভিউজ বাংলাদেশ: ভূরাজনৈতিক অবস্থান থেকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আমেরিকার ফেভারে- এমন কথা শোনা যাচ্ছে। তাতে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির কোনো ব্যাঘাত ঘটবে কী না?
জেড আই খান পান্না: এটা তো পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলতে পারেন। আমি যেটা বুঝি যে, আত্মীয়তা পরিবর্তন করা যায়, কিন্তু প্রতিবেশী পরিবর্তন করা যায় না। আমার পাশে মিয়ানমার, ভারত দুই দেশের সাথেই সম্পর্ক ভালো রাখতে হবে। সেটা আমার সার্ভভৌমত্বের বিনিময়ে নয়। সার্বভৌমত্ব রক্ষা করে কীভাবে রাখা যায়-সেই পথটা বের করতে হবে।
ভিউজ বাংলাদেশ: অন্যায়-অত্যাচার-সংকটের বিপরীতে বাঙালিকে নানা সময়ে জাগতে দেখা গেছে; কিন্তু অন্যায় বন্ধ হয়নি, তাহলে সামনের সংকটেও বাঙালি আবারও জেগে ওঠার সম্ভাবনা আছে?
জেড আই খান পান্না: অবশ্যই। ইমিডিয়েট আমি কিছুই দেখি না। যেমন জুলাইয়ে বুঝতে পেরেছিলাম যে, যখন গোলাগুলিটা করছে, এটা এক্সট্রিম। সরকার থাকবে কী থাকবে না, সেটা বুঝতে পারিনি। পালাবে, দেশত্যাগ করবে, এটাও বুঝতে পারিনি কিন্তু সরকারের অবস্থা নড়বড়ে হয়ে গেছে, এটা বুঝতে পেরেছি। হিংস্র হয়ে গিয়েছিল শেষ সময়ে। তো বাঙালির চরিত্র হলো বঙ্গোপসাগরের মতো। বঙ্গোপসাগরের ঢেউ কিন্তু মহাসাগরের চেয়ে বেশি। নামলে বুঝবেন। সমুদ্র দিয়ে যদি জাহাজে আসেন, মহাসাগরগুলোতে ঢেউ নেই। যেই না বেঙ্গলে পড়বেন, দেখবেন যে, ঢেউ কাকে বলে। তুফানে জাহাজ উঠতে থাকে, নামতে থাকে। পৃথিবীর সবচেয়ে গভীর সমুদ্র কিন্তু বেঙ্গলে। তো সেই বাঙালি।
সিপাহী বিদ্রোহও কিন্তু শুরু হয়েছে বাঙালিদের দিয়ে। যদিও সেটা পড়েছে বারাকপুরে, মঙ্গলপাণ্ডে, ঈশ্বরপাণ্ডেদের দিয়ে। এখন পশ্চিমবঙ্গে যদিও। তারপরে এ দেশে ফকির বিদ্রোহ, ফকির মজনু শাহ, তিতুমীর, হাজী শরীয়তুল্লাহ, বরিশালের বালাকি খানের নেতৃত্বে বিভিন্ন সময়ে বিদ্রোহ হয়েছে। সাঁওতাল বিদ্রোহ, গারোদের টং বিদ্রোহ। বিদ্রোহের ইতিহাস কিন্তু বাংলাদেশে আছে। এমনকি মোগল আমলেও কিন্তু বাংলাদেশে বারোভূঁইয়ারা স্বাধীন ছিলেন। কখনোই খুব একটা পরাধীনতার ভেতরে ছিলাম, তাও না। স্বচ্ছল একটা দেশ ছিল। তা না হলে ব্রিটিশরা শাহজাহানের কাছে পারমিশন চেয়েছে বেঙ্গলে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ট্যাক্সবিহীন ব্যবসার জন্য। কারণ, বেঙ্গলে তখন মসলিন ছিল। মসলিনের চাহিদা সারা পৃথিবীতে ছিল। দুটি জিনিসের নাম সবাই জানে, মসলিন অব ঢাকা, জামদানি অব ঢাকা।
ভিউজ বাংলাদেশ: দেশভাগের সময় তো বাঙালির শক্তি বোঝা যায়নি।
জেড আই খান পান্না: ছেচল্লিশে রায়টের পরেই বোঝা গেল যে, কলকাতা তো আমাদের নেই। তখন তাদের মাথায় উঠলো যে, যুক্ত বাংলা করতে হবে। কই এটা তো আগে আসেনি? যেই দেখছেন, কলকাতা ছুটে গেছে, বেঙ্গল দুটি ভাগ হয়ে গেছে, তখন এলো। পার্টিশন অব ইন্ডিয়া বলে না, ভারত ভাগ হয়েছে? ভারত তো ভাগ হয়নি। ভাগ হয়েছে বাংলা আর পাঞ্জাব দুইটি। তো অদ্ভুত বিষয় হলো, জিন্নাহ কিন্তু উর্দু জানতেন না। জিন্নাহর বাড়িও গুজরাট, গান্ধীর বাড়িও গুজরাট, মোদির বাড়িও গুজরাট, নেহেরুর বাড়িও গুজরাট, গুজরাটিরাই রুল করছেন সব সময়। তাই বাঙালি শক্তি দেখানোর সুযোগই পায়নি।
ভিউজ বাংলাদেশ: সুফিবাদী ইসলাম বনাম কট্টরপন্থার সংঘর্ষ চলছে। এ নিয়ে আপনি কী বলবেন?
জেড আই খান পান্না: মূলত আমাদের দেশে ইসলাম প্রচার করেছেন সুফিরা। বাগেরহাটের খানজাহান আলী, সিলেটের হযরত শাহজালাল, শাহপরাণ, যশোরের গরিব শাহ, চট্টগ্রামের ১২ আউলিয়ার দরগাহ- তারাই তো সুফিজম। শুধু বেঙ্গলই নয়, পুরো ইন্ডিয়াতেই ইসলাম প্রচার করেছেন সুফিরা। খাজা মঈন উদ্দিন চিশতি, নিজাম উদ্দিন আউলিয়া তারাওতো সবাই সুফি। এমনকি ইরানের যে মাওলানা রুমি, আমরা যে মিলাদ পড়ি, এগুলো শেখ সাদীর বয়ান। তারাও সুফি। তারা কট্টর ছিলেন না, সমাজের সঙ্গে মিশে ধর্মটা পালন করতেন।
ভিউজ বাংলাদেশ: স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে আমরা আন্দোলন করলাম। মতপ্রকাশের স্বাধীনতার জন্য আন্দোলন করলাম। আপনি কি মনে করেন, সেটার বাস্তবায়ন হয়েছে?
জেড আই খান পান্না: মতপ্রকাশের স্বাধীনতা আমি দেখি না। আমি বলতে পারছি আপনার কাছে, কিন্তু আপনার প্রকাশ করারই স্বাধীনতা নেই। ইচ্ছে হলে লিখতে পারি; কিন্তু একবার একটা পোস্ট দিয়েছিলাম ফেসবুক তিন দিন বন্ধ ছিল। কারণটা খুঁজে পাইনি যে, ফেসবুক বন্ধ কেন? আরেক বন্ধুর সহযোগিতা নিয়ে পরে দুটি পোস্ট ডিলিট করে ঠিক করা হয়েছে। তো এরকমের স্বাধীনতা আছে। স্বাধীনতা আছে রেশনকার্ডের মতো। আপনি কার্ড দেখালেন, পরিবারে কতজন আছে, চারজন। তাহলে চার কেজি চাল এক কেজি ডাল। আমরা এক ধরনের রেশনকার্ডের ডেমোক্রেসিতে আছি। মতপ্রকাশের স্বাধীনতাও ওই রেশনকার্ডের মতোই।
ভিউজ বাংলাদেশ: স্বৈরাচার আছে, না কি চলে গেছে?
জেড আই খান পান্না: কী আছে না আছে, সেটাইতো বুঝছি না। টক না মিষ্টি, এই আচারটাই বুঝতেছি না।
ভিউজ বাংলাদেশ: অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সম্পর্কে আপনার মন্তব্য কী?
জেড আই খান পান্না: তারা সুযোগ পেয়েছেন ক্ষমতায় থাকার। কীভাবে ব্যবহার করছেন, এটার ফলাফল পরে আমরাও পাবো, তারাও পাবেন। সৎভাবে ব্যবহার করলে সৎ ফল পাবেন আর খারাপভাবে ব্যবহার করলে পরে বাংলার জনগণ কিন্তু ছাড়ে না। আফগানিস্তানে যেরকম হয়েছে, সেরকম সুযোগও পাবে না। যদি বাঙালি কারও বিরুদ্ধে ক্ষেপে, এই সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষেপবে, সেটা বলছি না। যদি কেউ খারাপ কাজ করেন, তিনি কিন্তু ভাগবারও সুযোগ পাবেন না। অতীতেও পাননি, ভবিষ্যতেও পাবেন না।
ভিউজ বাংলাদেশ: রাজনৈতিক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের কথা বিএনপি বলছে। বিএনপি গত ১৭ বছর যে আন্দোলন করেছে, বিএনপির আন্দোলন শেষ হয়ে গেছে?
জেড আই খান পান্না: না, এই মুহূর্তে নির্বাচন যদি দেয়, তারা (বিএনপি) জয়লাভ করবে। মানুষ দল চেনে। চেনে আওয়ামী লীগ আর বিএনপি। আমার মনে হয়, ইউনূস সাহেব দুই ছাত্র উপদেষ্টাকে দিয়ে দল গড়ার চেষ্টা করছেন। কারণ, তরুণ প্রজন্ম যারা ভোট দিতে পারেননি, তারা ভোট দেবেন। একটা হিসেব-নিকেশ তার আছে, তিনি তো হিসেবি; কিন্তু দল করে, কিংস পার্টি করে যে খুব একটা লাভবান হননি কেউ, সেটা জাতীয় পার্টি দিয়েই বোঝা যায়।
(শেষ পর্ব)
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে