সলিমুল্লাহ খান
বাংলাদেশের সাহিত্যে আমরা এখন অন্ধকার যুগে আছি, আরবিতে যাকে বলে আইয়ামে জাহেলিয়াত
দ্বিতীয় পর্বের পর
এক অভূতপূর্ব গণআন্দোলন আর জনযুদ্ধে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের অভ্যুদ্য়। এক, দুই, তিন করে এর মধ্যেই দেশটি পার করেছে স্বাধীনতার ৫২ বছর। রাষ্ট্রীয়ভাবে সাড়ম্বরে পালিত হয়েছে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী; কিন্তু এই ৫২ বছরে একটি দেশ হিসেবে বাংলাদেশ কত দূর এগোলো। শিল্প-সংস্কৃতি, সাহিত্য, বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা, বুদ্ধিজীবীতা সব কিছুতে কত পথ পাড়ি দিল বাংলাদেশ। এসব বিষয় নিয়ে দেশবরেণ্য বুদ্ধিজীবী ও চিন্তক সলিমুল্লাহ খানের সঙ্গে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক রাহাত মিনহাজের বিস্তারিত কথোপকথন হয়েছে। সেই কথোপকথনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ ধারাবাহিকভাবে তুলে ধরা হলো। আজ তৃতীয় পর্ব:
রাহাত মিনহাজ: ৫০ বছরে বাংলাদেশের শিল্প-সাহিত্যে অগ্রগতি কতটুকু। স্বাধীন দেশে আমরা কতজন মহান লেখক পেয়েছি। এ বিষয়ে আপনার মূল্যায়ন কী?
সলিমুল্লাহ খান: অন্য দেশের বড় বড় লেখকের কথা আমরা জানি। ইংল্যান্ডের শেকসপিয়ার নিয়ে আমরা উচ্ছ্বাস প্রকাশ করি; কিন্তু আমাদের দেশে রবীন্দ্রনাথ এবং নজরুল ইসলামের পরে বড় লেখক কোথায়? আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, আমাদের দেশে একজনই বড় লেখক জন্মেছেন, তিনি হচ্ছেন আহমদ ছফা; কিন্তু আহমদ ছফা বর্তমান সমাজ, রাষ্ট্রের কাছে একেবারেই গ্রহণযোগ্য নন। ফলে তার নামে তেমন কোনো কিছু করা হয় না। যেমন; পাঠ্যবইতে তার কোনো লেখা নেই। আমিতো একজন নগন্য ব্যক্তি। আমার কথার কোনো মূল্য নেই। তবুও আমি সবার প্রতি সম্মান রেখে বলছি, আহমদ ছফার চেয়ে দ্বিতীয় একজন ভালো লেখক বাংলাদেশে জন্মেছে বলে আমি জানি না। আমি শামসুর রাহমান, আল-মাহমুদের লেখা পড়েছি। আহমদ ছফা হচ্ছেন প্রথম শ্রেণির লেখক। আর উনারা হচ্ছেন দ্বিতীয় শ্রেণির। আমি বলছি আমার পড়ার ভিত্তিকে। অনেকেই একমত নাও হতে পারেন। সম্প্রতি হাসান আজিজুল হক মারা গেছেন। বেশ ভালো লেখক। কিন্তু মহৎ লেখক নন।
রাহাত মিনহাজ: আপনার দৃষ্টিতে ভালো লেখক আর মহৎ লেখকের মধ্যে পার্থক্য কী?
সলিমুল্লাহ খান: তলস্তয় মহৎ লেখক। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহৎ লেখক। তারা শুধু বই লিখে জীবন পার করেননি। নারীদের স্কুল থেকে শুরু করে বাচ্চাদের বই লেখা, হেনো কাজ তিনি বাদ রাখেননি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকেও যত দেখি, বিস্ময়ে মুগ্ধ হই। নজরুল ইসলাম মাত্র ৪১ বছর সাহিত্যচর্চা করেছেন। আমি উনাদের বলি মহৎ লেখক। নজরুল ইসলাম, মীর মশাররফ হোসেন অথবা বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়- উনারা বড় লেখক, মহৎ লেখক হিসেবে মনে করি আমি। তবে মাঝারি লেখক, ছোট লেখকও থাকে। আমি নিজে কোনো লেখকই নই। এটা আমি বলছি পাঠক হিসেবে। সে জন্য বলছি, বাংলাদেশের সাহিত্যের দিকে যদি আমরা তাকাই, আমি মনে করি, আমরা অন্ধকার যুগে আছি। আরবিতে বলে আইয়ামে জাহেলিয়াত। এরকম যুগ বাংলা সাহিত্যে আগেও হয়েছিল।
বাংলাদেশে প্রথম মহাভারতের অনুবাদ হয়, পরাগল খাঁ বা ছুটি খাঁয়ের মহাভারত যেটাকে বলে। অনেকে পরাগলী মহাভারত বলে। চট্টগ্রাম অঞ্চলে অনেক অনুবাদের কাজ হয়। কবীন্দ্র পরেমেশ্বরের অনুবাদ, পরে কাশিরাম দাসের অথবা কৃত্তিবাসের মহাভারত এবং রামায়ন অনুবাদ হয়। এগুলো ছিল বাংলা সাহিত্যের ভিত্তি। বাংলায় অন্য ধরনের সাহিত্যও আছে। যেমন শ্রীকৃষ্ণকীর্তন এক ধরনের, চর্যাপদ আরেক ধরনের। যেটাকে আধুনিক বাংলা বলে আমরা চিনতে পারি, সেটার জন্ম হয়েছে ওই সময়ে। মহাভারত বাংলা একাডেমি ছেপেছে দুই খণ্ডে। ভালো কাজ করেছে। আপনি পড়ে এখন মোটামুটি শতকরা সত্তর-আশিভাগ বুঝবেন। বেশি ডিকশনারি দেখতে হবে না; কিন্তু এগুলো অত্যন্ত সংস্কৃতবহুল। এই যে আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ অজস্র পুঁথি সংগ্রহ করেছিলেন, তার মধ্যে বড় বড় কয়েকজনের নাম আমরা জানি। শাহ মোহাম্মদ সগীর, সৈয়দ সুলতান, আলাওল, দৌলত কাজী- এরা হলেন ষোড়শ এবং সপ্তদশ শতাব্দীর কবি। তখন বাংলা সাহিত্যের সুবর্ণ দিন ছিল।
রাহাত মিনহাজ: এর আগেওতো সাহিত্যে স্থবিরতা বা অন্ধকার যুগ ছিল। বিশেষ করে মোগল আমলে?
সলিমুল্লাহ খান: মোগল আমলে চট্টগ্রাম এলাকা বাদ দিলে গোটা বাংলা সাহিত্যে আপনি বৈষ্ণব গীতিকা ছাড়া আর কিছুই পাবেন না। এটা কেন? ভারতচন্দ্র পর্যন্ত আসেন। তখন অশ্লীলতায় ছেয়ে গেছে। অথচ ময়মনসিংহ গীতিকা লিখেছেন বাংলাদেশের কৃষক। এটা পূর্ব বাংলায় ১৯২০-এর দশকে আবিষ্কার হয়েছে। দীনেশ চন্দ্র সেনকে স্মরণ করি। উনি এটা সম্পাদনা করে বের করেছেন। সেরকম সাহিত্যচর্চা আমাদের হয় না। মোগল আমলে আমাদের সাহিত্যচর্চায় একটা ঢিলা ভাব এসেছিল। উন্নত সাহিত্য হয়নি। যেটা স্বাধীন সুলতানি আমলে হয়েছিল অথবা আরাকানের রাজসভায় হয়েছিল।
রাহাত মিনহাজ: আপনি বাংলা বা বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অনেক দীর্ঘ সময়ের প্রেক্ষাপট তুলে ধরেছেন; কিন্তু ১৯৭১ সালে আধুনিক বিশ্ব সভ্যতায় রাষ্ট্র হিসেবে যাত্রা শুরুর পর শিল্প সাহিত্যের অঙ্গনে আমরা কি কিছুই অর্জন করতে পারিনি?
সলিমুল্লাহ খান: আমি দুঃখের সঙ্গে বলছি, পাকিস্তান আমলে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আমাদের একটা সংগ্রাম থাকায়, ব্রিটিশ আমলে ব্রিটিশবিরোধী সংগ্রাম থাকায় ভিন্ন সামাজিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ছিল। ধরেন ১৯২০ সালে পরে নজরুল ইসলামের আবির্ভাব। নজরুল ইসলাম পূর্ব বাংলায় সাহিত্যে রেনেসাঁ এনেছিল। তার সঙ্গে আরও অনেক ছোটখাটো সাহিত্যিকের আবির্ভাব হয়েছিল। জসীমউদদীনের কথা ভুললে চলবে না। গানের দিকে আব্বাস উদদীনের কথা ভুললে চলবে না। শিল্পী জয়নুল আবেদিন পরবর্তীতে আমরা পেয়েছি সুলতানসহ বড় বড় শিল্পীকে। সাহিত্যের কথা যদি আপনি বলেন, আমি মনে করি, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর একটা অন্ধকার যুগ শুরু হয়েছে। তবে আপনি যখন বলেন, আমরা আন্তর্জাতিক শান্তিক্ষেত্রে অবদান রাখছি, আমাদের মাথাপিছু আয় বেড়েছে; কিন্তু তখন প্রশ্ন আসবে আমাদের নিম্নতম আয় কি বেড়েছে? এই কথাটি জিজ্ঞেস করা উচিত।
বর্তমানে আমাদের যেমন জাতীয় আয় বাড়ছে। যদি জনসংখ্যা না বাড়ে, জাতীয় আয় বাড়লে মাথাপিছু আয়ও বাড়ে। কিন্তু আমাদের নিম্নতম মজুরি কি বেড়েছে? এটা বুঝলেই আমরা বুঝতে পারব বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার অর্থ আছে কী না? দেশের সব মানুষ কি লেখাপড়ার সুযোগ পাচ্ছে। সবার কি স্বাস্থ্যসেবা নেওয়ার সুযোগ আছে। আপনি এটাকে দুভাবে দেখতে পারেন। এক গ্লাস পানিকে আপনি আধা গ্লাস খালিও বলতে পারেন, আধা গ্লাস ভরাও বলতে পারেন। আপনি হয়তো আমাকে দেখে বলবেন, হতাশার দিক থেকে বলছি; কিন্তু কথা হচ্ছে, এই যে মাথাপিছু আয় আমাদের আড়াই হাজার ডলার হচ্ছে বার্ষিক, এটাকে আমরা সুসংবাদ দিয়ে জানাচ্ছি; কিন্তু দেশের সর্বনিম্ন যার আয়, তার সঙ্গে সর্বোচ্চ যার আয়, যোগ করেইতো আমরা আড়াই হাজার পেয়েছি। তাহলে সর্বনিম্ন যিনি তার আয় কত- এটাতো আপনাকে বলতে হবে।
এই ফিল্টারটা আপনি গোপন করছেন কেন? আমাদের মোট জাতীয় আয় বাড়লে মাথাপিছু আয় বাড়বে, এটা স্বাভাবিক। কাজেই এটা কোনো নতুন খবর নয়। নতুন খবর হচ্ছে, দেশের সর্বনিম্ন আয়জীবী কারা? ধরেন সর্বনিম্ন বিশ জন, তারা কি অবস্থায় আছে? সরকারি হিসাবে এখনো দরিদ্রসীমার নিচে ২০ জন আছেন। করোনায় আরও বেড়েছে। আমি করোনার হিসাব দিচ্ছি না। তাহলে এইটা কি কারণে হচ্ছে, সেটা আলোচনা করতে হবে তো। যেই দেশের বুদ্ধিজীবীরা এটা আলোচনা করে না, সেখানে বুদ্ধিজীবীতার কি হবে? এখানে বুদ্ধিজীবী নামের যারা আছেন, অর্থনীতিবিদ, সমাজতত্ত্ববিদ, ইতিহাসবিদ–তাদের আলাপ-আলোচনা শুনলে মনে হয় না, তারা দেশের বাস্তব অবস্থা সম্পর্কে কোনো জ্ঞান রাখেন।
(ধারাবাহিকভাবে চলবে)
আরও পড়ুন
প্রথম পর্ব
আমাদের বুদ্ধিজীবীদের প্রধান সমস্যা দেশের ইতিহাস সম্পর্কে খণ্ডিত ধারণা নিয়ে অগ্রসর হওয়া
দ্বিতীয় পর্ব
দেশে এখন কূটনীতিই প্রবল, রাজনীতি আর নেই
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে