আমরা ব্যক্তিনির্ভর, ওরা প্রতিষ্ঠাননির্ভর
আহমাদ মাযহার প্রাবন্ধিক, অনুবাদ এবং শিশু সাহিত্যিক। সাত বছর ধরে তিনি প্রবাসী। বর্তমানে বসবাস করছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। বিদেশ বিভূঁইয়ে থাকলেও তার মন পড়ে থাকে স্বদেশে। এখনো লেখালেখি নিয়ে সক্রিয়। এবারের বইমেলায় প্রকাশিত হয়েছে তার দুটি বই: ‘স্মৃতিতে ও সান্নিধ্যে’ ও ‘মৌহূর্তিকী’। প্রতি বছর বইমেলার সময় তিনি দেশে আসেন। ভিউজ বাংলাদেশের সঙ্গে কথা হলো তার প্রবাসজীবন, লেখালেখির-ভাবনা ও নানা প্রসঙ্গ নিয়ে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন কামরুল আহসান।
ভিউজ বাংলাদেশ: কেমন আছেন? ভিউজ বাংলাদেশের পক্ষ থেকে আপনাকে স্বাগত জানাচ্ছি।
আহমাদ মাযহার: আমি ভালো আছি। প্রায় এক বছর পর দেশে আসছি, ভালো লাগছে।
ভিউজ বাংলাদেশ: আপনি এখন শুধু বইমেলা উপলক্ষেই বাংলাদেশে আসেন?
আহমাদ মাযহার: আমি প্রতি বছর বইমেলা উপলক্ষেই আসি।
ভিউজ বাংলাদেশ: আপনি আমেরিকায় গেলেন কত বছর হলো?
আহমাদ মাযহার: আমি আমেরিকায় গেছি ২০১৭ সালের মে মাসে। প্রায় ৭ বছর হতে চলল।
ভিউজ বাংলাদেশ: জানতে চাই আপনি তো বাংলাদেশে সব মিলিয়ে ভালোই ছিলেন। আমেরিকায় কেন গেলেন?
আহমাদ মাযহার: আমার আমেরিকায় যাওয়ার কারণটা একটু আকস্মিক। আমার স্ত্রীর বড় ভাই অনেক দিন ধরে আমেরিকাতে আছেন। উনি যখন নাগরিকত্ব পান, তখন তার ভাইবোনদের জন্য আবেদন করেন। এটা আমার ঠিক জানা ছিল না। ওনার ভাইবোনরা হয়তো মনে মনে জানত; কিন্তু আমি কোনোদিন শুনিনি। ২০১৫ সালে আমি একবার আমেরিকায় যাই, বইমেলায় অংশ নিতে। তখনো আমার জানা ছিল না। তখনো আমি একজন ভ্রমণকারীর চোখ দিয়ে আমেরিকা দেখি। তখন গিয়ে আমার মনে হয়েছে অল্প সময়ে আমেরিকা সম্পর্কে তেমন কিছু বোঝা যাবে না। একটা সমাজের ভেতরকার অনেক বিষয় থাকে। ২০১৬ সালে আমি জানতে পারি আমার স্ত্রী আমেরিকাতে যাবে। তখনো আমি ভাবিনি, একেবারে গিয়ে আমেরিকাতে থাকব। ভেবেছি সে যদি গ্রিনকার্ড পায়, তাহলে মাঝে মাঝে বেড়াতে যেতে পারব। ২০১৬ সালে গিয়ে আমার কাছে পরিষ্কার হয়, ওখানে গিয়ে থাকতে হবে। আমার ছেলেটাও ওখানে গিয়ে গ্র্যাজুয়েশন করত পারবে। তখন চিন্তা ছিল ছেলেকে ওখানে সেটেল্ড করে দিয়ে আমরা চলে আসব। ওখানে গিয়ে মাসখানেক থাকার পর আমার মনে হলো বাংলাদেশে যে জীবন আমরা যাপন করি, নানারকম উদ্বিগ্নতা ও অর্থসংকট নিয়ে, আমি যেরকম নিরিবিলি লেখালেখি, পড়াশোনা করতে চাই, ওটা ওখানে নিশ্চিন্তে পাব। সেই বিবেচনা করেই আমি ওখানে পার্মান্যান্ট থেকে যাই।
ভিউজ বাংলাদেশ: তাহলে বলছেন আপনি আমেরিকায় গিয়ে ভালো আছেন?
আহমাদ মাযহার: এক অর্থে ভালো আছি, যেহেতু আমার জীবনে আর কোনো প্রত্যাশা নেই। আমার ছেলে গ্র্যাজুয়েশন সম্পন্ন করে ফেলেছে। আমার চিন্তা ছিল, আমার ছেলে যখন গ্র্যাজুয়েশন সম্পন্ন করে ফেলবে, চাকরি-বাকরি করবে তখন আমি আর কোনো আর্থিক সংকট মাথায় নেব না। আমার বাবার অনেক বয়স হয়ে গেছে, ওনার আর কোনো প্রত্যাশা নাই, আমার নিজের কোনো প্রত্যাশা নাই, অনেকের যেমন অনেক কিছু পাওয়ার প্রত্যাশা থাকে, আমার তেমন কোনো প্রত্যাশা নেই, আমি একটা সাধারণ মানুষের জীবন কাটাতে চাই।
ভিউজ বাংলাদেশ: লেখালেখি থেকে আপনার প্রত্যাশা কী?
আহমাদ মাযহার: আমি যখন কলেজে পড়ি, তখন ঠিক করেছিলাম, আমার প্রতিভা থাকুক বা না থাকুক, আমার লেখালেখি সমাজে গৃহীত হোক বা না হোক, আমি একজন সাহিত্যিকের জীবনযাপন করব। আমি সেই জীবনযাপন করতে পারছি। এমন কি আমি যখন চাকরি করেছি, যখনই যা করেছি, সব সময়ই নিজেকে তিরস্কার করেছি, এটা তোর কাজ না। এ কারণে লক্ষ্য করবেন, আমি পেশাগত জীবনে ভালো করিনি।
ভিউজ বাংলাদেশ: বর্তমানে আপনার প্রবাস-সাহিত্যজীবন কীরকম কাটছে?
আহমাদ মাযহার: আমি ওখানে গিয়ে বোঝার চেষ্টা করেছি আমাদের সাহিত্যজীবনের সঙ্গে ওখানের সাহিত্যজীবনের পার্থক্যটা কীরকম। যেমন আমাদের পুস্তক প্রকাশনার জগৎ ওখানে কীরকম আর এখানে কীরকম, আমাদের বইমেলার সঙ্গে ওখানের বইমেলার গুণগত বা বৈশিষ্ট্যগত বা মর্মগত পার্থক্য কীরকম, ওখানকার সাহিত্য-সংগঠন বা লেখালেখি-সংক্রান্ত যেসব প্রতিষ্ঠান সেগুলো বোঝার চেষ্টা করেছি। এমন কি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গিয়ে প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে অনেক কিছু জেনেছি।
ভিউজ বাংলাদেশ: কী পার্থক্যগুলো দেখলেন?
আহমাদ মাযহার: পার্থক্যগুলো হলো আমরা নৈর্বিত্তিক হতে পারি না, সাংগঠনিক হতে পারি না। এর কারণ হচ্ছে আমাদের জীবন-প্রণালি এখন পর্যন্ত নৈর্ব্যাত্তিক নাই। আমরা ব্যক্তিনির্ভর, ওরা প্রতিষ্ঠাননির্ভর। ওরা প্রতিষ্ঠানকে ব্যক্তির ওপরে জায়গা দেয়। অনুশীলনটা তাই ওইভাবে হয়। আমাদের অনুশীলন ওইভাবে হয় না। এমন না যে গুণগত মান অর্জনের লোকজন আমাদের নেই। তা আছে; কিন্তু তাদের কাজে লাগানোর মতো প্রাতিষ্ঠানিক বিবেচনাবোধ নেই। বাংলাদেশ রাষ্ট্রটিও কিন্তু ব্যক্তিনির্ভর। এর জন্য যে ব্যক্তিরাই দায়ী তা না, আমাদের সমাজ-গঠনের মধ্যেই এটা আছে।
ভিউজ বাংলাদেশ: ওখানকার পাঠকদের সঙ্গে আমাদের পাঠকদের পার্থক্যগুলো কী?
আহমাদ মাযহার: ওদের স্কুলগুলোতে পাঠ্যপুস্তকের সঙ্গে একটা মুক্তপাঠের ব্যবস্থা থাকে। কিছু নির্দিষ্ট বই ওরা স্কুল থেকেই ঠিক করে দেয়, এই ধরনের বইগুলো বড় হতে হতে পড়তে হবে। ফলে ওদের একটা নিজস্ব জীবনদৃষ্টি, বা মূল্যবোধ তৈরি হয়ে যায়।
ভিউজ বাংলাদেশ: ওখানকার বাঙালিপাঠকরা কীরকম বই পড়ে?
আহমাদ মাযহার: অনেকেই পড়ে। যারা পড়ে তারা আর সাধারণ বাঙালিদের সঙ্গে মিশতে চায় না। তারা বরং আমেরিকান কালচারেই অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। কেউ যদি শিল্প-সাহিত্য করতে চায়, তারা ওখানকার সাংস্কৃতিকজগতের সঙ্গে মিশে যায়।
ভিউজ বাংলাদেশ: নিউইয়র্কে বাংলাদেশের যে বইমেলা হয়, সে সম্পর্কে কিছু বলুন। কেমন হয় সেই আয়োজন?
আহমাদ মাযহার: নিউইয়র্কে যে বইমেলা হয় ওটা বাংলাদেশি আদলেই হয়। ওটাকে আমেরিকান বইমেলা বলার কোনো কারণ নাই। বাঙালিদের, বাংলাদেশিদের বইমেলা। তবে, অনুষ্ঠানগুলো ওখানে যেভাবে হয় তার সঙ্গে এর কিছু পার্থক্য আছে। তারা চেষ্টা করে আমেরিকান যে নিয়মকানুন, কালচার সেটা রক্ষা করতে।
ভিউজ বাংলাদেশ: এই বইমেলার কোনো প্রভাব কি পড়ে ওখানকার বাঙালি সমাজে?
আহমাদ মাযহার: একটা প্রভাব তো আছেই। বাংলা বইয়ের বিক্রি বাড়ছে। অনেক প্রকাশক যাচ্ছেন। তবে, ব্যবসার কথা চিন্তা করে গেলে হবে না। ব্যবসা তেমন হয় না। তবে, একটা যোগাযোগ স্থাপন, সম্মিলন হয়।
ভিউজ বাংলাদেশ: ওখানে বাংলাদেশ থেকে যাদের নিয়ে যাওয়া হয়, বেশির ভাগ সময় দেখা যায় স্বজনপ্রীতির ছাপ থাকে। এটা কেন?
আহমাদ মাযহার: এর একটা কারণ, যে কেউ ভিসা পাবে না। ওদের একটা কমিটি আছে, তারা ঠিক করে কাদের কাদের নিয়ে যাবে। যে পরিমাণ লেখক তাদের নিয়ে যেতে হয়, যে পরিমাণ অর্থ খরচ করতে হয়, ওই অর্থ খরচ করার মতো সক্ষমতা তাদের নাই। তারা করে কি, কোনো কারণে ওইদিকে কোনো লেখক যাচ্ছেন, তাদের খোঁজ করে। তবে, তারা চেষ্টা করে দুজন খ্যাতিমান লেখককে দাওয়াত দিয়ে নিয়ে যেতে। যাতে পাঠক দর্শক আকৃষ্ট হয়ে মেলায় আসে।
ভিউজ বাংলাদেশ: এক বছর পর পর আপনি যখন বাংলাদেশে আসেন, কী কী পরিবর্তন লক্ষ্য করেন?
আহমাদ মাযহার: আমি যেহেতু প্রতি বছর আসি, তেমন কোনো পরিবর্তন লক্ষ্য করি না। অবকাঠমোগত কিছু পরিবর্তন লক্ষ্য করি; কিন্তু কোনো সাংস্কৃতিক পরিবর্তন লক্ষ্য করি না।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে