Views Bangladesh

Views Bangladesh Logo

সাতক্ষীরার পানিবন্দি লক্ষাধিক মানুষের আর্তি

‘ত্রাণ চাই না, চাই জলাবদ্ধতার স্থায়ী সমাধান’

Rezaul karim

রেজাউল করিম

বৃহস্পতিবার, ১০ অক্টোবর ২০২৪

পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা না থাকায় বেতনা নদী প্লাবিত হয়ে প্রতি বছরই বর্ষা মৌসুমজুড়ে জলাবদ্ধ থাকে সাতক্ষীরার নিম্নাঞ্চলের শতাধিক গ্রাম। এ বছরের ভারি বর্ষণ ও অতি জোয়ারের পানিতে সৃষ্ট বন্যায় গ্রামগুলোর লাখো মানুষের পানিবন্দি মানবেতর জীবনযাপন আরও দীর্ঘস্থায়ী হচ্ছে। ভেঙে গেছে তাদের মাটির বসতবাড়ি ও গোয়ালঘর, ভেঙে পড়েছে স্যানিটেশন ব্যবস্থা, ক্ষেতেই পচে যাচ্ছে ধানসহ অন্য ফসল। কোটি কোটি টাকার মৎস্য ঘের ভেসে নিঃস্বও হয়ে গেছেন অনেকে। প্রয়োজনীয় ত্রাণসামগ্রীর অভাবে খেয়ে-না খেয়ে দিনাতিপাতের কথা জানাচ্ছেন অসহায় মানুষগুলো, বিশুদ্ধ সুপেয় পানির অভাবে করছেন হাহাকার, ছড়াচ্ছে পানিবাহিত রোগও। মানুষের পাশাপাশি চরম খাদ্য সংকট ও স্বাস্থ্যঝুঁকিতে বিপন্ন হাজার হাজার গবাদিপশুর প্রাণও।

সরেজমিন দেখা গেছে, নাব্য হারিয়ে নদীর তলদেশ উঁচু হয়ে থাকায় বর্ষা এলেই পানিবন্দি হয়ে পড়েন বেতনাপাড়ের সদর, আশাশুনি ও তালা উপজেলার অন্তত ১২৭টি গ্রামের বাসিন্দা। পরিকল্পিত নদীখনন না করাসহ পানি নিষ্কাশনের একমাত্র পথ মিত্রতেঁতুলিয়া স্লুইসগেটের অব্যবস্থাপনায় দুই দশক ধরে অভিশপ্ত এই জলাবদ্ধতার শিকার তারা। তবে এ বছরের অতিবৃষ্টি ও জোয়ারের পানিতে তৈরি হয়েছে ভয়াবহ বন্যা পরিস্থিতির। সবকিছু হারিয়ে ক্রমেই নিঃস্ব হচ্ছেন অন্তত সোয়া লাখ গ্রামবাসী।

আশাশুনির কাদাকাটি ও কুল্যা, সাতক্ষীরা সদরের ধূলিহর এবং তালার খেশরা ও খলিশখালী ইউনিয়নের বন্যার পানি মরিচ্চাপ নদীতে নিষ্কাশিত হওয়ার একমাত্র পথ মিত্র তেঁতুলিয়া স্লুইসগেট ঘুরে দেখা গেছে, একটি নাট-বল্টু পড়ে যাওয়ায় গেট দিয়ে প্রবল বেগে জোয়ারের পানি ঢুকে বন্যা পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতি ঘটছে। স্থানীয়দের অভিযোগ, চার দিন ধরে জোড়া-তালি দিয়ে চললেও পানি উন্নয়ন বোর্ডের কোনো কর্মকর্তা এখানে আসেননি। বার্ষিক জলাবদ্ধতা নিরসনে সংশ্লিষ্ট দপ্তর ও কর্মকর্তাদের অবহেলা এবং অপরিকল্পিত উদ্যোগেও চরম অসন্তোষ এখন ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে। অন্তত দেড় মাস ধরে পানিবন্দিরা বলছেন, ‘আমরা ত্রাণ চাই না, চাই পানি নিষ্কাশনের সুব্যবস্থায় জলাবদ্ধতার স্থায়ী সমাধান।’

সদর উপজেলার বেতনাপাড়ের ধূলিহর ও ব্রহ্মরাজপুর ইউনিয়নের শতাধিক গ্রামে বন্যা পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতি ঘটেছে। গ্রামের পর গ্রাম পানিতে থই থই করছে। পানিবন্দি লক্ষাধিক মানুষের বসতবাড়ি, রান্না ঘর, টয়লেট, গোয়ালঘর, কবরস্থানসহ সবকিছুই পানির নিচে। বাড়িঘর ছেড়ে গরু, ছাগল, হাঁস, মুরগি নিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ে ছুটছেন অনেকেই।

গত মঙ্গলবার (৮ অক্টোবর) দিনভর পরিদর্শনে অসহনীয় দুর্ভোগের কথা জানান ধূলিহর ইউনিয়নের বড়দল, গোবিন্দপুর ও বালুইগাছা গ্রামের মানুষ। গোবিন্দপুর গ্রামের আহাদ আলী বলেন, ‘ঘরবাড়িসহ সবকিছু পানির নিচে। গত সপ্তাহজুড়েই বাড়িতে কোনো রান্না হয়নি। ঘরে চাল থাকলেও রান্নার কোনো উপায়ও নেই। চিড়ামুড়ি খেয়ে কোনোরকমে দিন পার করছি। সরকারি বা বেসরকারিভাবে এখনো কোনো ত্রাণসামগ্রীও পাইনি।’

একই গ্রামের বাসিন্দা মেহেদী হাসান শিমুল জানান, এ বছর অতিবৃষ্টিতে গ্রামের পর গ্রাম জলাবদ্ধ থাকায় সবকিছু হারিয়ে মানুষ নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছেন। বড়দল গ্রামের আব্দুস সামাদ বলেন, ‘সবকিছু শেষ হয়ে গেছে। কোথাও তিল ধারণের জায়গা নেই। ভেঙে পড়েছে স্যানিটেশন ব্যবস্থাও। জলাবদ্ধ মানুষের মাঝে হাহাকার পড়ে গেছে। বাজার থেকে ভ্রাম্যমাণ চুলা এনে কেউ কেউ টিনের চালে বা ছাদে নিয়ে রান্না করতে পারলেও অধিকাংশ মানুষ খেয়ে না খেয়ে আছেন। এখন পর্যন্ত আমাদের দুঃখ-কষ্ট দেখতে কেউ আসেননি। পাইনি কোনো ত্রাণসামগ্রী। এত মানুষ না খেয়ে আছেন, যা অতীতে কখনো দেখিনি।’

সাতক্ষীরা সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সৈয়দ আহমেদ জানান, ভারি বর্ষণে প্রথমদিকে জলাবদ্ধতার কবলে পড়া গোয়ালপোতা, মাছখোলা, সানলে, নেহালপুর, আসানডাংগা, মাটিয়াডাংগা, যুগিপোতাসহ গ্রামগুলোতে ১৫ টন খাদ্যসামগ্রী দেয়া হয়েছে। নতুন করে দুর্গত মানুষের মাঝেও ত্রাণ বিতরণ চলছে। জলাবদ্ধ এলাকার পানিনিষ্কাশনে ২০ ওয়াটার পাম্প চালু আছে।

৪৫ দিন ধরে পানিবন্দি আশাশুনি উপজেলার কাদাকাটি ইউনিয়নের ১০টি গ্রামের তিন হাজার পরিবার। চরম মানবেতর জীবনযাপন করছেন পরিবারগুলোর প্রায় ১৩ হাজার মানুষ। ৯০ শতাংশই মাটির বসতঘর ও গোয়ালঘর ধসে পড়ায় গবাদিপশু নিয়ে বেশি দুর্বিপাকে বিশেষত বৃদ্ধ ও নারী-শিশুরা। সুপেয় পানির অভাবে ও সরকারি-বেসরকারি সাহায্য না পেয়ে ক্ষুব্ধ দীর্ঘদিন অনাহারে-অর্ধাহারে থাকা মানুষগুলো।

বিএনপি নেতা সাবেক ইউপি সদস্য জহিরুল ইসলাম জানান, কাদাকাটি ইউনিয়নের কাদাকাটি, পারকাদাকাটি, যদুয়ারডাঙ্গা, কবিরখনি, ট্যাংরাখালি, কর্চাখালি, ঝিকরা, তালবাড়িয়া, পূর্বকাদাকাটি ও পারখেজুরডাঙ্গা গ্রামে বসতঘর, গোয়ালঘরসহ পানিতে ডুবে আছে মসজিদ-মন্দির, স্কুল-মাদ্রাসাও। বন্যার্তদের রান্না করে খাওয়া বা ল্যাট্রিনে যাওয়ার উপায় নেই। গবাদিপশুর খাবার নেই। প্রত্যন্ত অঞ্চলে যাতায়াতে ভেলা ও নৌকা ছাড়া উপায় নেই। তাই বাড়ির বৃদ্ধ ও শিশুদের আত্মীয়স্বজনদের বাড়িতে পাঠানো হয়েছে। গবাদিপশু নিয়ে বিপদ আরও বেড়েছে। গরুগুলোকে হয় রাস্তার ওপরে, না হয় অন্যত্র পাঠানো হয়েছে। খাদ্য সংকটেও মারা গেছে অনেক।

পানি নিষ্কাশনে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়াসহ বন্যার্তদের জন্য শুকনা খাবার ও গোখাদ্যের ব্যবস্থা করতেও জেলা প্রশাসকের আশু হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন জহিরুল ইসলাম। উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা সোহাগ খান জানান, কাদাকাটি ইউনিয়নে প্লাবিত মানুষের জন্য ১২ মেট্রিক টন চালের আবেদন জানানোর পাশাপাশি ২০০ প্যাকেট শুকনো খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। সরকারিভাবে কোনো আশ্রয়কেন্দ্র আপাতত খোলা হয়নি। বিনষ্ট মাটির ঘর-বাড়ি ও ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা করে জেলা প্রশাসককে পাঠানো হবে।

উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলী মোস্তাফিজুর রহমান জানান, দিনে ৩ হাজার লিটার করে সুপেয় পানি বিতরণ করছে উপজেলা প্রশাসন। চাহিদা বাড়লে আরও বেশি করে দেয়া হবে। টানা বৃষ্টিপাত ও পাশের এলাকার পানির চাপে তলিয়ে আছে তালা উপজেলার তেঁতুলিয়া ইউনিয়নের শিরাশুনী, লাউতাড়া, পাঁচরোখি, সুভাশুনী, মদনপুর ও সুমজদিপুরসহ ১৭টি গ্রাম। বাড়িঘরের পাশাপাশি পানি উঠেছে তেরছি, কলাপোতা, হাতবাস, শিরাশুনী লাউতাড়া পাঁচরোখির সব প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং শুভাশুনি ডিগ্রি কলেজে, এমনকি মসজিদ-মন্দির-গির্জায়ও। উপজেলা সদরের সঙ্গে পুরো ইউনিয়নের যোগাযোগ ব্যবস্থাও বিচ্ছিন্ন।

পানিবন্দি ৩ হাজারেরও বেশি পরিবারের অন্তত ১২ হাজার মানুষ। সংকটময় পরিস্থিতিতে দিনাতিপাত করছেন তারা। সুপেয় পানির অভাবে পড়েছেন চরম বিপাকে। স্যানিটেশন ব্যবস্থায় পড়া বিরূপ প্রভাবে বাড়ছে চর্ম, পানি ও ডায়রিয়াজনিত রোগের প্রকোপ। কৃষকদের ফসল পানির নিচে থাকায় পচে যাচ্ছে। টানা বৃষ্টিতে প্রায় এক হাজার মৎস্য ঘের পানিতে তলিয়ে ৩-৪ কোটি টাকার ক্ষতির দাবি ঘের মালিকদের। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের শারদীয় দুর্গোৎসবও থমকে গেছে কয়েকটি পূজামণ্ডপে।

পাঁচরোখি গ্রামের আলো মতি দাশ, প্রকাশ দাশ, গণেশ দাশ ও আলাউদ্দিন গাজী, মদনপুর গ্রামের আব্দুল খালেক, সুমজদিপুর গ্রামের সুবাসী দাশ এবং শিরাশুনী গ্রামের মোমিন শেখ, শামিমা আক্তার, সালমা বেগম, আসমা বেগম, আলমগীর হোসেন ও আছিয়া বেগম জানান, জলাবদ্ধতা নিরসনে পানিবন্দি জীবনের স্থায়ী সমাধান চান তারা। টানা বৃষ্টি এমন পরিস্থিতির মূল কারণ, মন্তব্য করে তেঁতুলিয়া ইউপি চেয়ারম্যান জানান, এখানকার পানি নিষ্কাশিত হয় যশোর জেলার কেশবপুর উপজেলার ভদ্রা নদী দিয়ে। তবে সেখানকার নননিয়া খালের স্লুইসগেট পলিমাটিতে উঁচু হয়ে পানি সরতে পারছে না।

খাল ও নদীর তলদেশ উঁচু হয়েও এখন স্লুইসগেটটির ওপর চার-পাঁচ ফুট পানি। তিনি আরও বলেন, ‘টানা বৃষ্টিপাতে এই ইউনিয়নের পানি নিষ্কাশিত হতে পারছে না। পলিমাটি অপসারণ না করা হলে এ সমস্যার যৌক্তিক সমাধান হবে না।’ তালা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ মো. রাসেল বলেন, ‘পাশের জেলা যশোর থেকে আমাদের উপজেলায় পানি আসায় বেড়ে যাওয়া জলাবদ্ধতা নিরসনে কাজ চলছে। তবে বৃষ্টি না হলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে যাবে।’

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ