Views Bangladesh

Views Bangladesh Logo

আর শুনতে চাই না ‘টার্গেট নেক্সট বিশ্বকাপ’

Ekramuzzaman

ইকরামউজ্জমান

রবিবার, ৭ জুলাই ২০২৪

দ্য সমাপ্ত টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ক্রিকেট প্রেমিকরা দৃষ্টিনন্দন ব্যাটিং থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। আইসিসির বিশ্বকাপ টুর্নামেন্টে স্বাগতিক দুই দেশের (যুক্তরাষ্ট্র ও ওয়েস্ট ইন্ডিজ) উইকেটে দুই রকম আচরণ করেছে। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ইতিহাসে এর আগে আর কখনো দুটো সেমিফাইনাল এতো বিবর্ণ হয়নি। তবে এশিয়া এবং আফ্রিকা এই দুই মহাদেশ নবম টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে যে-বার্তা দিয়েছে সেটি খুব গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্বকাপে ভালো খেলতে হলে, জয় পেতে হলে জয়ের ক্ষুধা নিয়ে চাপ সামাল দিয়ে পুরো দলকেই ভালো খেলতে হবে। খেলোয়াড়দের আত্মবিশ্বাস থাকতে হবে। সাহস থাকতে হবে। পাশাপাশি নিজের খেলার ওপর বিশ্বাস এবং সামর্থের ওপর আস্থা রাখা জরুরি। ভারত যে এতগুলো বছর পর অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হয়েছে, তার কারণ তারা টিম হিসেবে দুর্দান্ত ইতিবাচক ক্রিকেট খেলেছে। প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত গতিটা ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছে ভারত।

দর্শকরা বরাবর উত্তেজনা চায়। ক্রিকেট সাহিত্যিক অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত লিখেছেন, ‘জনতাকে দোষ দিয়ো না। সে নগদ সওদার খরিদদার। তার একমাত্র পণ্য উত্তেজনা। দর্শককে তুমি দার্শনিক হতে বলো না। তাকে তুমি শুধু জাগিয়ে রাখো, দাঁড় করিয়ে রাখো। যে পরিতৃপ্ত হতে চায় না, সে প্রজ্বলিত হতে চায়।’

ক্রিকেট মাঠে দর্শকরা আগ্রাসী ব্যাটিংয়ের পুজারী সেই প্রথম থেকেই। স্যার ডন ব্র্যাডম্যানের তিরিশ দশকের কথা চিন্তা করুন। টেস্ট ক্রিকেটে একদিনে তিনশতের বেশি রান তখন দর্শকদের টেনেছে। অস্ট্রেলিয়ার ডন ব্র্যাডম্যান আউট হলে অনেক দর্শক মাঠ ছেড়ে চলে যেতেন। তাদের কথা হলো খেলা দেখে আর মজা নেই।

বিশ্বকাপ শুরু থেকে ভারতকে বিভিন্নভাবে সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয়েছে, নেতিবাচক এই অভিযোগ আইসিসি হজম করেছে। বণিকবৃত্তি আর স্বার্থ উদ্ধারের জন্য ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডকে যে কোনোভাবে খুশি রাখার খেলা ক্রিকেট বিশ্বে দেশে দেশে সাধারণ মহল বুঝলেও তাতে বিব্রত হয়নি আইসিসি। বৈশ্বিক টুর্নামেন্টে ভারত না থাকলে যে দুধ সেবন সম্ভব হবে না। মানুষের রচিত ক্রিকেটের নাটক রীতি নীতিতে পার্থক্য আছে।

বিশ্বকাপের চারটি খেলার মধ্যে বাংলাদেশ দল জিতেছে তিনটি খেলায়। শ্রীলঙ্কা, নেদারল্যান্ডস এবং নেপালের বিপক্ষে। তীরে এসে তরী ডুবেছে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে। চার রানে হেরেছে বাংলাদেশ দল। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে এবারই প্রথম গ্রুপ এইটে স্থান করে নিয়েছে আমাদের ক্রিকেট দল। অপ্রিয় শোনালেও সত্যি দুর্বল মানসিক বল, খেলোয়াড়দের সামর্থকে সঠিকভাবে পড়তে না পারার অক্ষমতা, তাদের প্রতি বিশ্বাসে ঘাটতি এবং দেশ ছাড়ার আগে টপ-অর্ডার ব্যাটসম্যানদের ফর্মহীনতায় ভোগার পরিপ্রেক্ষিতে টিম ম্যানেজমেন্ট সাহস এবং আত্মবিশ্বাস নিয়ে বলতে পারেনি- ‘আমাদের প্রাথমিক লক্ষ্য হলো গ্রুপ এইটে ওঠা।’

বাংলাদেশ দল গ্রুপ এইটে উঠেছে, এ ক্ষেত্রে বোলারদের অবদান নব্বই ভাগ। টপ-অর্ডার ব্যাটসম্যানরা বিশ্বকাপ খেলতে নেমে ছন্দ ফিরে পাননি। সিনিয়র খেলোয়াড়রা বিশ্বকাপের ‘অ্যাসাইনমেন্টে’ প্রত্যাশিত পারফরম্যান্স প্রদর্শনে নিদারুণভাবে ব্যর্থ হয়েছেন। তিনচারজন জুনিয়র খেলোয়াড় রিশাদ হোসেন, তাওহিদ হৃদয়, তানজিম হাসান এবং অন্যরা দলকে দায়িত্বশীল আচরণের মাধ্যমে টেনে নিয়ে গেছেন। এটি অনেক বড় প্রাপ্তি এবং সন্তুষ্টি। সিনিয়র খেলোয়াড় সাকিব, মাহমুদউল্লা, লিটন দাস, সৌম্য সরকার, নাজমুলের যে ধরনের ভূমিকা পালন করা প্রত্যাশা ছিল তা তারা করতে ব্যর্থ হয়েছেন।

সুপার এইটে অস্ট্রেলিয়া এবং ভারতের বিপক্ষে বাংলাদেশ দল কোনো ধরনের প্রতিদ্বন্দ্বিতা সৃষ্টি করতে পারেনি এটাই বাস্তবতা। কিন্তু শেষ খেলায় আফগানিস্তানের বিপক্ষে যখন বিভিন্ন সমীকরণের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের সেমিফাইনালে খেলার সমূহ সম্ভাবনা জেগে উঠেছিল তখন দলটি এই সম্ভাবনা গ্রহণ করতে নিদারুণভাবে ব্যর্থ হয়েছে। ১২ দশমিক ১ ওভারে ১১৬ রান প্রয়োজন ছিল। বাংলাদেশ দলের তিন উইকেট পড়ে যাবার পর দল নেতিবাচক চিন্তায় আক্রান্ত হয়ে লড়াই বাদ দিয়ে দিয়েছে। অথচ তারা যদি সাহসের সঙ্গে লড়াই করতো তা হলে হয়তো আমাদের ক্রিকেট একটি নতুন অধ্যায়ের সৃষ্টি হওয়ার অবকাশ ছিল। মানসিক দুর্বলতা নিয়ে খেলে শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ আফগানিস্তানের কাছে আম-ছালা দুটোই তুলে দিয়েছে। এই বিষয়টি শুধু দেশের মানুষকে ধাক্কা দিয়েছে তা নয়- ক্রিকেট বোর্ড এবং তার প্রেসিডেন্ট নাজমুল হাসানকে অসন্তুষ্ট এবং বিব্রত করেছে। দলের অধিনায়ক শান্তর স্ববিরোধী বক্তব্য রসিক মহলকে অবাক করেছে। বিশ্বকাপের পারফরম্যান্সে তিনি অধিনায়ক হিসেবে সন্তুষ্ট আবার অসন্তুষ্ট। এটি কী ধরনের কথা!

দেশের ক্রিকেটের অনেকগুলো সমস্যার একটি হলো ব্যক্তি এবং সমষ্টির স্বার্থে মিডিয়াতে ভিত্তিহীন নিত্যনতুন স্টোরি তৈরি করিয়ে ক্রিকেট চত্বরে ভুল বোঝাবুঝি এবং অস্থিরতা বিরাজ করানো। দেশের ক্রিকেট সংহতিতে এটি ক্ষতিকর। চিফ কোচ ভারতের বিপক্ষে তাসকিনকে দলে স্থান দেননি। হোটেল থেকে সময় মতো টিমের বাসে দলের সঙ্গে আসতে পারেননি তাসকিন। পরে এসেছেন নিজের মতো করে। সব কিছুর একটি নিয়মকানুন আছে। যখন তিনি পৌঁছেছেন তখন দল মাঠে নামতে আর কয়েক মিনিট বাকি ছিল। শ্রীলঙ্কান কোচকে বিদায় করে দেওয়ার এখতিয়ার শুধু তো আছে বোর্ডের। শ্রীলঙ্কান কোচকে বিদায় করতে পারলেই মনের আশা পূর্ণ হবে এমনটি ভাবার সুযোগ নেই। কে একনায়ক আর কে গণতন্ত্রে বিশ্বাসী ড্রেসিং রুমের এসব কথাবার্তা বাইরে কারণ জোগান দেন। কোনো কোনো খেলোয়াড়কে টিম ম্যানেজমেন্ট দেখতে পারে না- এসব গবেষণা তো দলের ঐক্যে ফাটল ধরায়।

টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে ধারাবাহিকতা আসতে অনেক পথ বাকি এখনো। অনেক রাস্তা অতিক্রম করতে হবে। অনেক মেহনত করতে হবে। দল নতুন করে পুনর্গঠন করে অনেক কাজ করতে হবে। খেলোয়াড়রা এই খেলায় অভ্যস্ত হওয়ার পাশাপাশি তাদেরকে আত্মবিশ্বাসী, সাহসী এবং শক্ত মানসিকতাসম্পন্ন হতে হবে।

দল অনেক আগেই দেশে ফিরে এসেছে। পুরো সফরের প্রাপ্তি এবং অপ্রাপ্তি, সফলতা এবং ব্যর্থতা নিয়ে হাতে সময় নিয়ে পর্যালোচনা এবং আলোচনার দরকার আছে। দরকার আছে সম্ভাবনা, দুর্বলতা এবং হুমকি নির্ণয় করা। প্রয়োজন নেই তথাকথিত ‘তদন্ত কমিশন’ গঠন। মাঠে এবং মাঠের বাইরে কী ঘটেছে এখন সব কিছুই স্পষ্ট। ক্রিকেটে স্বপ্ন হোক ঐক্যবদ্ধ এবং সুসংঘটিত। সময় দ্রুত চলে যাচ্ছে। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বিভিন্ন ধরনের সীমাবদ্ধতার মধ্যেও অন্যরা এগিয়ে চলেছে। আমাদের উচিত ক্রিকেটে ধর্মসমতুল্য নির্দিষ্ট লক্ষ্য নির্ধারণ। আর এই লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য দায়বদ্ধতার সঙ্গে কাজ করা।

আমরা বার বার বলতে পারব না ‘আমাদের টার্গেট নেক্সট বিশ্বকাপ।’ পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য এই আশ্বাস তো ইতোমধ্যেই আলোচনার জন্ম দিয়েছে। ২০২৮ সালে ভারত ও শ্রীলঙ্কায় অনুষ্ঠিত হবে পরবর্তী বিশ্বকাপ টি-টোয়েন্টি। আমাদের টার্গেট হোক এই টুর্নামেন্টে আমরা সেমিফাইনালে খেলব। আর সেই লক্ষ্যে এখন থেকেই কাজ শুরু করা হোক।

লেখক: কলামিস্ট ও বিশ্লেষক। সাবেক সিনিয়র সহ-সভাপতি, এআইপিএস এশিয়া। আজীবন সদস্য বাংলাদেশ স্পোর্টস প্রেস অ্যাসোসিয়েশন।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ