Views Bangladesh

Views Bangladesh Logo

একাত্তরের প্রশ্নে আমাদের এক থাকতেই হবে

Badiul Alam Majumdar

বদিউল আলম মজুমদার

মঙ্গলবার, ৩ ডিসেম্বর ২০২৪

(প্রথম পর্বের পর)

নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান ড. বদিউল আলম মজুমদার। তিনি একাধারে অর্থনীতিবিদ, উন্নয়নকর্মী, রাজনীতি বিশ্লেষক, স্থানীয় সরকার ও নির্বাচন বিশেষজ্ঞ। গত ২৯ নভেম্বর তিনি নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার, নতুন নির্বাচন কমিশন ও নির্বাচনের রূপরেখা বিষয়ে ‘ভিউজ বাংলাদেশ’-এর মুখোমুখি হয়েছেন। দুই পর্বের সাক্ষাৎকারের আজ প্রকাশিত হলো শেষ পর্ব। তার সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ‘ভিউজ বাংলাদেশ’-এর সম্পাদক রাশেদ মেহেদী

ভিউজ বাংলাদেশ: গত কয়েক দিন ধরে দেখা যাচ্ছে, ধর্মীয় সংঘাত ও সাম্প্রদায়িকতার দিকে অসহিষ্ণু দুটি পক্ষ দেখা যাচ্ছে। আমাদের বন্ধুরাষ্ট্রগুলো তারাও এটা নানাভাবে চিহ্নিত করছে। একই সঙ্গে সংবাদপত্র অফিসের সামনে একদল মানুষকে অরাজকতা সৃষ্টি করতে দেখা যাচ্ছে। আপনি দীর্ঘদিন রাজনীতি পর্ববেক্ষণ করেন, আপনার কী মতামত?

বদিউল আলম মজুমদার: আশা করি, আমাদের সবার স্বার্থে, আমাদের ভবিষ্যৎ-প্রজন্মের স্বার্থে, আমাদের বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্বার্থে আমরা সবাই দায়িত্বশীল আচরণ করব। যারা এসব পরিস্থিতির সৃষ্টি করছে, উসকানি দিচ্ছে, আমরা সবাই যদি ঐক্যবদ্ধ হই, তাহলে এই বিষয়টি সুরাহা করা সম্ভব। আর আমরা যদি বিভক্ত হই, একে-অপরের সঙ্গে দ্বন্দ্ব, হানাহানিতে লিপ্ত হই, একটি সুস্পষ্ট লক্ষ্য নিয়ে আমরা যদি সবাই অগ্রসর না হই, তাহলে আমাদের জন্য পরিস্থিতি জটিল হতে পারে। সুষ্ঠু নির্বাচন ব্যাহত হতে পারে। এটা নির্ভর করবে আমাদের সবার সদিচ্ছার ওপর।

ভিউজ বাংলাদেশ: বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ভিত্তি হচ্ছে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ; কিন্তু অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কারও কারও কথায়, আচরণে বোঝা যাচ্ছে, তারা আসলে চিহ্নিত করতে পারছে না কোনটা ১৯৭১, আর কোনটা ফ্যাসিস্ট সরকার। বিষয়টি কীভাবে দেখছেন?

বদিউল আলম মজুমদার: ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ আমাদের জাতীয় জীবনের সবচেয়ে গৌরবময় অধ্যায়, এ ব্যাপারে কারও দ্বিমত থাকার কথা না। হয়তো কারও কারও চিন্তার অস্পষ্টতা থাকতে পারে। তার জন্য জটিলতার সৃষ্টি হতে পারে। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে অনেক তরুণ যুক্ত আছেন, যাদের কিছু বক্তব্য হয়তো বিতর্ক সৃষ্টি করতে পারে। আমি মনে করি, বিভ্রান্তি সৃষ্টি হওয়ার কোনো সুযোগ নেই আমাদের। কেউ যদি বক্তব্য পরিষ্কার করে বলতেও না পারে, আমার মনে হয় একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ আমাদের রক্তের মধ্যেই আছে। আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মত্যাগ সর্বদাই আমাদের স্মরণে থাকে। যে লক্ষ্যে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল, সেটা হলো আমাদের আত্মপরিচয়ের অধিকার প্রতিষ্ঠা- সাম্য, মানবিক মর্যাদাবোধ ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা। একটি শান্তিপূর্ণ ভবিষ্যৎ প্রতিষ্ঠা। আমার মনে হয় এ ব্যাপারে দ্বিমত নেই। হয়তো বক্তব্যে অস্পষ্টতা থাকতে পারে। একটি বিষয় দেখে আমি আশান্বিত হচ্ছি, সাম্প্রতিক যে সাম্প্রদায়িক অবস্থার সৃষ্টি হচ্ছে, এর বিরুদ্ধে কিন্তু সবাই এগিয়ে আসছে। দলমত নির্বিশেষে সবাই এগিয়ে আসছে। জাতীয় ঐক্যের কথা হচ্ছে এবং সবাই সম্মিলিতভাবে এই পরিস্থিতিটাকে মোকাবিলার কথা বলছে। এতে আশাবাদী হওয়ার কারণ রয়েছে। আর জাতি-দল-মত-বর্ণ নির্বিশেষে যে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে আমাদের তো সেই গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস আছে। এখন বিভিন্ন স্বার্থান্বেষী মহল আমাদের সেই ঐতিহ্য নষ্ট করেছে; কিন্তু একাত্তরের প্রশ্নে আমাদের এক থাকতেই হবে। তা না হয়ে উপায় নেই।

ভিউজ বাংলাদেশ: ফ্যাসিস্ট সরকারের যেসব আচরণের কারণে জনগণ ক্ষুব্ধ হয়েছে, তারা যেসব ভুল করেছে সেরকম দু-একটি আচরণ বর্তমান সরকারের সিদ্ধান্তের মধ্যে দেখছি। যে মামলার কারণে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হলো, সেই মামলাটি কিন্তু সঠিকভাবে করা হয়নি। বাংলাদেশের কোনো ব্যক্তি রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা করতে পারে না, করতে হয় রাষ্ট্রের দায়িত্ব নিয়ে। এটা হয়নি। আমরা দেখছি যে, সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ঢালাওভাবে হত্যা মামলা দেয়া হচ্ছে, এ কারণে কিন্তু বর্তমান সরকার বিতর্কিতও হচ্ছে, রক্ত দিয়ে একটি ফ্যাসিস্ট সরকারকে আমরা সরিয়েছি; কিন্তু এই সরকারের কোনো আচরণ ফ্যাসিস্ট সরকারের মতো হয়ে যাচ্ছে বলে আপনি মনে করেন কি না?

বদিউল আলম মজুমদার: ভুল কিছু হয়েছে, হতে পারে, ভুল হবেই। কারণ, সবচেয়ে বিজ্ঞলোক, সবচেয়ে প্রজ্ঞাবন লোকদের নিয়েও যদি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হতো তাদের পক্ষেও এই পরিস্থিতিতে ভুল সামাল দেয়া সম্ভব হতো না। কারণ পরিস্থিতি এত জটিল। সব প্রতিষ্ঠা ভেঙে গিয়েছে। বাংলাদেশ দুর্নীতি-দুর্বৃত্তায়নের স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়েছে। অনেক গোষ্ঠী এই দেশটাকে তাদের আপন সম্পত্তি ধরে নিয়ে লুটপাট চালিয়েছে। এগুলো ঠিক করা চাট্টিখানি কথা না। তো কিছু ভুল হয়েছে; কিন্তু আমাদের প্রধান উপদেষ্টা তো সুস্পষ্টভাবে বলেছেন, যদি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কোনো ভুল করে, তাহলে যেন নাগরিকরা তা ধরিয়ে দেন। যে ভুলগুলো হয়েছে আমি মনে করি সেগুলো শোধরানো যাবে। এবং এই ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে ভবিষ্যতে যেন আর ভুল না হয়, সেটা নিশ্চিত করবে। ভুল হবেই; কিন্তু অতীতে যেটা ছিল, তারা কোনো ভুল করেনি। তারা যা করেছে, সেটাই সঠিক ছিল। তারপর আরও ভুল করেছে এবং তারা কখনো ভুল স্বীকার করেনি। তারা যা করেছে সেটাকেই সঠিক বলে প্রচার করেছে। অনেক কাজই তারা জনকল্যাণে করেনি। ব্যক্তিস্বার্থে, দলীয় স্বার্থে, গোষ্ঠী স্বার্থে করেছে। এই সরকারের যেটা গুরুত্বপূর্ণ দিক, এখানে কোনো দলীয় স্বার্থ নেই, ব্যক্তি স্বার্থ নেই। এখানে আছে জনস্বার্থ। আমি মনে করি, তারা যদি ভুলও করে, ভুল স্বীকার থেকেই তারা শিখবে।

ভিউজ বাংলাদেশ: আমাদের যে তরুণসমাজ আজকে জুলাই গণঅভ্যুত্থান করেছে, গণঅভ্যুত্থানের পরে এখন পর্যন্ত আমরা তাদের যে অবস্থা দেখছি, এই তরুণসমাজ ভবিষ্যতে একটা সুখী-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ উপহার দিতে পারবে বলে কি আপনি আশাবাদী?

বদিউল আলম মজুমদার: এই তরুণসমাজকে যখন আমরা দোষারূপ করি, আমরা কিন্তু এই দায় এড়াতে পারি না। আমরা যারা বয়স্ক, আমরা যারা তাদের অভিভাবক সমতুল্য, আমরা তাদের পথ দেখাতে পারিনি। আমরা তাদের ব্যবহার করতে পারিনি। আমরা তাদের অপব্যবহার করেছি। আমার মনে হয়, আমরা যদি দায়িত্বশীল আচরণ করি তাদের আরও ভালোভাবে গড়ে তোলা সম্ভব। আমাদের বয়স্কদের ধারণা ছিল, তারা শুধু মোবাইল নিয়ে থাকে, ইন্টারনেট নিয়ে থাকে, ফেসবুক নিয়ে থাকে, তারা কিন্তু আমাদের ভুল প্রমাণ করেছে। জেন-জি যাদের বলে, তারা কিন্তু রাষ্ট্র সম্পর্কে চিন্তা করে, ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা করে। তারা কিন্তু জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দেশকে স্বৈরাচার মুক্ত করেছে। আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা যেমন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যুদ্ধ করেছে, তারাও কিন্তু সেরকম জীবনের ঝুঁকি নিয়েছে।

আমরা কিন্তু এটা দেখেছি, তাদের যে জীবন দেয়ার আকাঙ্ক্ষা, তাদের যারা যারা মারতে চেয়েছিল তার চেয়ে বেশি ছিল। তাই তারা এই মনোবলের যুদ্ধে জয়ী হয়েছে। আমি আশাবাদী। তবে তাদের আমাদের সঠিকভাবে পথ দেখাতে হবে, সহায়তা করতে হবে। তাদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করতে হবে। তাদের জন্য সঠিক পথ প্রদর্শন করতে হবে। তাহলে আমি নিশ্চিত, তারা একটি সুন্দর বাংলাদেশ গড়ে তুলবে। স্বৈরাচার মুক্ত করে ৫৩ বছর পর তারা একটি নতুন বাংলাদেশ গড়ার দ্বার উন্মোচন করেছে। আমি নিশ্চিত এটা যেন বাস্তবে রূপায়িত হয়, তার জন্য তাদের যা করণীয় করবে। এখন আমাদের করণীয় আমাদের করতে হবে। আমরা যদি সবাই আমাদের করণীয় ঠিক করি, তাহলে আমরা একটি গণতান্ত্রিক, সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়তে পারব। এ ব্যাপারে আমার সামান্যতম সন্দেহ নেই।
(সমাপ্ত)


প্রথম পর্ব:  অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সহায়ক নয়

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ