ক্ষুদ্র জাতিসত্তার অধিকার স্বীকার করে একসঙ্গে থাকতে হবে
জুলাই গণপরিসর আয়োজিত ‘অভ্যুত্থান-পরবর্তী সংবিধান বিতর্ক: উৎস ও গন্তব্য অনুসন্ধান’ শীর্ষক আলোচনা সভায় কবি ও ভাবুক ফরহাদ মজহার এই বক্তব্য প্রদান করেন গত ২৩ সেপ্টেম্বর। বাংলা একাডেমি আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ মিলনায়তনে, তার বক্তব্যের লিখিতরূপ প্রকাশ করা হলো ভিউজ বাংলাদেশের পাঠকদের জন্য। আজ প্রকাশিত হলো আলোচনাটির দ্বিতীয় অংশ।
আপনি রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দিন চুপ্পুর কাছে কেন শপথ নিলেন? শেখ হাসিনার পুরো রাষ্ট্রটাই তো ওই সংবিধানে আছে? এখন খালি নিয়োগ দিচ্ছেন আর বলছেন, এখানে-ওখানে ঠিক কর। এগুলো কী? আপনি তো সেদিনই জনগণের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন, যেদিন বলেছেন, ‘আমি এই সংবিধান রক্ষা করিব?’ তাহলে আপনি এখন কী করে কমিশন করেন? এটা কি অবৈধ না? আপনি বলেছেন, সংবিধান সংরক্ষণ করবেন, তাহলে আপনি এখন কী করে সংবিধান সংস্কার করবেন? এই অধিকার কে দিয়েছে আপনাকে?
শেখ হাসিনা দিয়েছেন? দেয় নাই তো। শেখ হাসিনা তো বলছেন তিনি এখনো প্রধানমন্ত্রী। এর আগে তো আপনারা সংবিধান সংশোধন করেছিলেন, তারপর শেখ হাসিনা ফিরে এসে শেখ মুজিবুর রহমানের খুনিদের ফাঁসি দিয়েছেন না? ফলে সংবিধান বিষয়টাকে এত কৌতুক মনে করবেন না।
যেহেতু একটা সাংবিধানিক ধারাবাহিকতার নামে একটি কলোনিয়ান স্টেটকে আপনারা টিকিয়ে রেখেছেন, একটি ফ্যাসিস্ট স্টেটকে আপনারা টিকিয়ে রেখেছেন, যেহেতু এর ধারাবাহিকতা আপনারা রাখছেন, আজ থেকে ১০ বছর, ১৫ বছর, ২০ বছর পরে যে কোনো দল যদি দুই-তৃতীয়াংশ পায় আপনাদের ১৪২ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, তারা পুরো সংবিধান আবার কিন্তু সামনে আনতে পারে। ফলে এটা তো ঠাট্টা-তামাশার ব্যাপার না। এখন ফরহাদ মজহারকে পুরোনো মার্কসবাদী, মাওবাদী বলে গাল দিলে তো হবে না। আমি তো কোনো অযৌক্তিকত কথা বলিনি। যদি বলে থাকি, আপনারা বলেন না, আলোচনায় আসেন। আপনি আমাকে বোঝান, যে সংবিধানে আপনি শপথ নিয়েছেন, সেই সংবিধান আবার কী করে ভঙ্গ করেন?
তাহলে শপথটা মিথ্যা, মিছা কথা বলছেন। তাহলে কনসেপ্টটা হচ্ছে এই, আমরা যে একটি পলিটিক্যালি কমিউনিটি এটা আগে প্রতিষ্ঠা করতে হবে। দেখুন এখন কী হচ্ছে, জাতিবাদের যে লড়াইটা, আমরা কিন্তু এই লড়াইটা অতিক্রম করার চেষ্টা করছি।
পলিটিক্যাল কমিউনিটি হচ্ছে, একটি রাজনৈতিক জনগোষ্ঠীর মধ্যে বিভিন্ন ধরনের কমিউনিটি থাকতে পারে। তার মধ্যে ক্ষুদ্র জাতিসত্তা থাকতে পারে। চাকমারা থাকতে পারে, মুরংরা থাকতে পারে। সাঁওতালরা থাকতে পারবে। বাঙালি থাকবে। সব জাতিই থাকতে পারে। কিন্তু জাতীয়তাবাদী রাজনীতি থাকতে পারে না। জাতিবাদ দ্বারা এখন যে নিউ লিবারেল, বহুজাতিক কোম্পানির রাষ্ট্র, আমাদের মতো দুর্বল রাষ্ট্র টিকিয়ে রাখতে পারবেন না। এটা সব সময়ই আপনার মধ্যে বিভক্তি, বিশৃঙ্খলা, দ্বন্দ্ব লাগিয়ে যাবে।
আপনি পার্বত্য চট্টগ্রামের ব্যাপারটা দেখেন। এতদিন পর্যন্ত আমরা তাদের ওপর অত্যাচার করেছি। তাদের অধিকার হরণ করেছি। এখন বাংলাদেশকে যদি আপনি রাষ্ট্র আকারে চান, এখন তো এই কমিউনিটির সমস্যা আপনাকে সমাধান করতে হবে। আপনি কি চান পার্বত্য চট্টগ্রামে আরেকটি রাষ্ট্র গড়ে উঠুক? ফেনীতে যে ছোট্ট অঞ্চলটা আছে, আপনারা কি চান এটা আলাদা হয়ে যাক?
ওটা যদি না চান, তাহলে এটা পলিটিক্যাল ইস্যু। আপনাকে পলিটিক্যাল কথা বলতে হবে তাদের সঙ্গে। আপনি যে ওখানে ক্যান্টনমেন্ট বসিয়ে এটাকে একটি সামরিক সমস্যা হিসেবে হাজির করেছেন, এটা তো ঠিক করছেন না।
আপনি এর আগে ওদের বলেছেন, তোমরা বাঙালি হয়ে যাও। তারই ধারাবাহিকতায় আপনি ওখানে গিয়ে একটি ক্যান্টনমেন্ট বানালেন। আর এখন কিছু অতি বাম আছেন, কথায় কথায় অতি দরদে স্বাধীনতার কথা, তাদের জন্য জাতিসত্তার কথা বলেন। যেহেতু আপনারা বাঙালি জাতিবাদ করেন। ভাবেন, ওটা তো জাতিবাদ, ওটাকে সমর্থন করতে হবে।
আজকে দিল্লি প্রতিটি মুহূর্তে গণঅভ্যুত্থানকে নস্যাৎ করে দেয়ার চেষ্টা করছে। সেখানে আমাদের অনেক অনেক বেশি সতর্ক অবলম্বন করতে হবে। আমাদের সত্যিকারের বৈপ্লবিক রাজনীতিকে নতুন করে গঠন করতে হবে। আমাদের ভুল চিন্তা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। জাতিবাদ ফ্যাসিজম। সেটা জম্মু জাতিবাদ হোক, আর বাঙালি জাতিবাদ হোক। পার্থক্য শুধু একটা জাতিবাদ নিপীড়িত, তার পক্ষে আমাদের দাঁড়াতে হবে। তাদের প্রতি আজকে যারা দাঁড়াচ্ছেন, সমর্থন দিচ্ছেন আমি তাদের সমর্থন করি।
আমরা পার্বত্য চট্টগ্রাম চাই, কোনো সন্দেহ নেই; কিন্তু এটা করতে গিয়ে আপনি যখন বাংলাদেশের সৈনিকদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন, আপনি যখন আমাদের বাংলাদেশের সেনাবাহনীকে ছোট করেন, এর কারণ কিন্তু রাজনৈতিক জনগোষ্ঠীর ধারণাটা আপনার দুর্বল। আগামী দিনে আপনাকে দিল্লির বিরুদ্ধে লড়তে হবে, আজ হোক, কাল হোক। এটা শুধু সময়ের ব্যাপার। ফলে ইচ্ছে করলেই আপনি প্রতিষ্ঠানগুলোকে ছোট করতে পারেন না, যেমন করে আপনি আমাদের অন্যান্য প্রতিষ্ঠান, যেমন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করতে পারেন না। তেমনি আপনার যে সৈনিকতা, সৈনিকতার যে প্রতিষ্ঠান, যার দ্বারা রাষ্ট্র তার সার্বভৌমত্ব রক্ষা করে, জীবন দিয়ে, তাদের ছোট করতে পারেন না। গণঅভ্যুত্থানেও সৈনিক ভাইদের সহযোগিতা ছিল।
সৈনিকদের সঙ্গে আজকে যে বিরোধ লাগানোর চেষ্টা চলছে, এই যে ফাঁদ তৈরি হয়েছে চট্টগ্রামে, এই ফাঁদের মধ্যে আমরা কেউ কিন্তু পা দেব না। সৈনিকদেরও আমরা অনুরোধ করব, আপনারাও এ ফাঁদে পা দেবেন না। এই ফাঁদে পা দিলে আমরা বিপদে পড়ব। আমরা পলিটিক্যাল কমিউনিটি, আমরা মনে করি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তার অধিকার স্বীকার করে আমরা একসঙ্গে থাকতে পারব। কারণ, আমি যদি বাঙালি, আমার জাতিসত্তার অধিকার স্বীকার করি, আমি তোমার অধিকারও স্বীকার করতে পারব।
তাহলে কী করে সমাধানটা করব? আসুন আমরা এমন একটি রাষ্ট্র গড়ে তুলি, যে রাষ্ট্রটা একটা শক্তিশালী বাংলাদেশ গড়ে তুলবে। আমরা যে অধিকার বঞ্চিত হয়েছি, তুমিও সেই অধিকার আদায়ে আমার সঙ্গে শামিল হও। আমার রাষ্ট্র তো দুর্বল। আমি নিজেই তো অধিকারহীন। আমার নাগরিকত্বই এখনো আমি দাঁড় করাতে পারিনি, আমি নিজেই একটা সংবিধান বানাতে পারি নাই, তাহলে তুমি আমার সঙ্গে লড়তে আসো কী জন্যে? তোমার আর আমার লড়াই তো একই।
আসো তুমি আমার সঙ্গে। আমরা কী করে রাষ্ট্রটা তৈরি করতে পারি, এই রাষ্ট্র তৈরি করার ক্ষেত্রে, অন্যান্য সাংবিধানিক বা তার জাতিসত্তার অধিকার অস্বীকার করার চেয়েও আরও ভয়ংকর অধিকার অস্বীকার করা হয়েছে, যেটা আপনারা খেয়াল করেন না। সেটা হলো যে গোষ্ঠীর মালিকানা। গোষ্ঠীর মালিকানাও ১৯৭২ সালের সংবিধানে অস্বীকার করা হয়েছে। আপনি বনরক্ষাকারীদের অধিকার হরণ করেন। যারা বনরক্ষাকারী তাদের জীবনব্যবস্থাকে ধ্বংস করেছেন।
নির্বাচনকেই অনেকে গণতন্ত্র মনে করেন। নির্বাচন হচ্ছে একটি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া মাত্র। বহুরকম নির্বাচন আছে। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের আলাদা নির্বাচন আছে। নির্বাচন মানে আপনি একটি পরিচালনা পর্ষদ বেছে নেবেন।
বিএনপিকে আমি প্রশ্ন করেছিলাম, কীসের নির্বাচন চান আপনি? নির্বাচন যদি হয় জনপরিসরের ভিত্তিতে, তাহলে আমি আছি। এখানে তো জনপরিসরই নেই। জনপরিসর গঠন করতে হলে আগে জনগণের অভিপ্রায় বুঝতে হবে। জনগণের অভিপ্রায় বোঝার একমাত্র উপায় হচ্ছে এ ধরনের আলোচনার আয়োজন করা। জেলা পর্যায়ে, উপজেলা পর্যায়ে, গ্রাম পর্যায়ে- যত দ্রুত আপনি এ ধরনের আলোচনা করতে পারবেন, তত দ্রুত আপনার রাষ্ট্রগঠন প্রক্রিয়া তরান্বিত হবে।
আপনার পছন্দের লোকজন একেকজন ধরে ধরে একেক জায়গায় বসিয়ে দিলেন এভাবে তো রাষ্ট্র গঠন হয় না। সরকারও চলে না। আমরা যাদের বসিয়েছি এরই মধ্যে তাদের ব্যর্থতা প্রমাণিত হয়েছে। তার মানে কি আমাদের গণঅভ্যুত্থান মিথ্যা হয়ে গেছে। গণঅভ্যুত্থান কিন্তু মিথ্যা হয়ে যায় নাই।
শুধু তাই না, এখন কিন্তু ছাত্রদের ছোট করার জন্য নানারকম চক্রান্ত চলছে। সম্প্রতি আমি এক বক্তৃতায় বলেছি, ভাইরা, যেসব ছাত্র আমাদের এতটুকু এনে দিয়েছে তাদের পেছনে আর প্রপাগান্ডা করবেন না। ওরা তো এনে দিয়েছে, বাকিটা তো আপনাদের করার কথা ছিল। ওদের কাছে আর কী চান? শেখ হাসিনাকে তাড়িয়ে দিয়েছে দিল্লিতে, ওদের কাছে আর কী চান?
ফরহাদ মজহার: কবি ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে