তামাক নিয়ন্ত্রণে কর দক্ষতা অর্জন:
বৈশ্বিক উদ্যোগগুলো থেকে বাংলাদেশ কী শিখতে পারে?
তামাক সেবন জনস্বাস্থ্যের জন্য একটি উল্লেখযোগ্য চ্যালেঞ্জ, যা শুধু ইউরোপীয় অঞ্চলেই বছরে ১৬ লাখ মানুষের মৃত্যুর কারণ হয়ে থাকে। এই বৈশ্বিক সমস্যাটি বাংলাদেশেও গভীরভাবে বিদ্যমান। এখানে বছরে আনুমানিক ১ লাখ ৬২ হাজার মানুষ তামাকজনিত রোগে মারা যায়। এটি চিকিৎসা ব্যয়বৃদ্ধি ও উৎপাদনশীলতা হ্রাসজনিত কারণে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৩০ হাজার ৫৬০ কোটি টাকার বড় আর্থিক বোঝার কারণ হয়েছিল। এই মহামারি মোকাবিলায় তামাক পণ্যের ওপর কর বৃদ্ধি একটি উল্লেখযোগ্য গুরুত্বপূর্ণ কৌশল।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) তামাকের ওপর কর বাড়ানোর লক্ষণীয় সুবিধাগুলো তুলে ধরে। বিশ্বব্যাপী সিগারেটের প্যাকেটের ওপর আবগারি কর ৫০ শতাংশ বাড়ালে ধূমপায়ীর সংখ্যা ৪ কোটি ৯০ লাখ হ্রাস পাবে এবং কমপক্ষে ১ কোটি ১০ লাখ মানুষের তামাকজনিত মৃত্যু এড়ানো যেতে পারে। উল্লেখ্য, অস্ট্রেলিয়া, লিথুয়ানিয়া, নিকারাগুয়া এবং ভানুয়াতুর মতো দেশগুলো তামাক সেবন হ্রাস করার ক্ষেত্রে সাফল্যজনক বাস্তব অগ্রগতি দেখিয়ে সেরা চর্চার স্তরে তাদের কর বৃদ্ধি করেছে।
এই সাফল্য সত্ত্বেও, চ্যালেঞ্জগুলো রয়ে গেছে, বিশেষ করে ডব্লিউএইচও-এর ইউরোপীয় অঞ্চলে। ৫৩টি দেশের মধ্যে ২৬টি তামাকের খুচরা মূল্যের প্রস্তাবিত ৭৫ শতাংশ করের হিস্যা অর্জন করলেও, অসঙ্গতি রয়ে গেছে। কমনওয়েলথ অব ইন্ডিপেনডেন্ট স্টেটসের (সিআইএস) অগ্রগতি এক্ষেত্রে অপেক্ষাকৃত ধীর৷ প্রধান প্রতিবন্ধকতাগুলোর মধ্যে রয়েছে দেশগুলোর অভ্যন্তরীণ ও পারস্পরিক মূল্য বৈষম্য, যা বিভিন্ন মন্ত্রণালয় এবং প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে সমন্বিত প্রচেষ্টার প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেয়৷
বাংলাদেশের ক্ষেত্রে কর ব্যবস্থা ও তামাক সেবনের মধ্যে জটিল সম্পর্কের একটি প্রাসঙ্গিক উদাহরণ জোগায়। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে জাতীয় বাজেটে নিম্নস্তরের সিগারেটের জন্য কর সুপারিশকৃত ৩৭ দশমিক ৫ শতাংশের তুলনায় ১২ দশমিক ৫ শতাংশ বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়েছে, যাকে ‘সাহসী’ পদক্ষেপ হিসেবে খুব একটা বিবেচনা করা যায় না। বিশেষজ্ঞরা মনে করে, এতে করে সিগারেটের বিক্রি খুবই অল্প কমবে এবং ধুমপায়ীর হার কমবে মাত্র দশমিক ৫৩ শতাংশ। সুপারিশকৃত সুনির্দিষ্ট কর কমালে এই হার ১ দশমিক ২৮ শতাংশ কমানো যেত।
যাই হোক, একটি বৈশ্বিক পরিপ্রেক্ষিত থেকে জানা যায় যে, ৪১টি দেশে বসবাসকারী বিশ্বের জনসংখ্যার মাত্র ১২ শতাংশ সর্বাধিক জনপ্রিয় সিগারেট ব্র্যান্ডের মূল্যের ৭৫ শতাংশ বা তার চেয়ে বেশি হারে করের হার থেকে উপকৃত হয়। অস্ট্রেলিয়া সিগারেটের ওপর প্রশংসনীয় ৮৯ দশমিক ৪ শতাংশ কর আরোপ করে সবচেয়ে এগিয়ে রয়েছে। ফলে ধূমপানের হার ১৯৯১ সালের ২২ দশমিক ১ শতাংশ থেকে ২০১৭ সালে ১০ দশমিক ৬ শতাংশে নাটকীয়ভাবে হ্রাস পেয়েছে। একইভাবে, এক দশকেরও বেশি সময় ধরে থাইল্যান্ডে পর্যায়ক্রমে কর বৃদ্ধির ফলে কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে ধূমপানের হার লক্ষণীয়ভাবে ৭০ শতাংশ কমে গেছে। এসব সাফল্যের গল্প শক্তিশালী তামাক কর আরোপের রূপান্তরমূলক প্রভাবের গুরুত্ব তুলে ধরে।
এ ছাড়া, পেরু তামাক কর আরোপের ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাপী অগ্রণী হয়ে উঠেছে। ৯০-এর দশক থেকে পেরু নিজেদের তামাক কর নীতিগুলো বিকশিত করেছে। এর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ২০১০ সালে একটি নির্দিষ্ট আবগারি উপাদান প্রবর্তন ও ২০১৬ সালে নির্দিষ্ট আবগারি করের ঐতিহাসিক ১৫০ শতাংশ বৃদ্ধি৷ তামাক নিয়ন্ত্রণে অবদানের জন্য ডব্লিউএইচও-এর স্বীকৃতি লাভকারী পেরু বর্তমানের ৭৩ দশমিক ৩ শতাংশ মোট কর হিস্যাসহ নিজেদের নীতিগুলো আরও জোরদার করে চলেছে।
দুর্ভাগ্যবশত, বাংলাদেশের প্রস্তাবিত করের হার সুপারিশের চেয়ে কম, যা ধূমপানের প্রকোপ হ্রাসের অগ্রগতিকে বাধাগ্রস্ত করে। বাংলাদেশ তার নিজ চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করার সময়, আন্তর্জাতিকভাবে আন্তর্জাতিকভাবে প্রয়োগকৃত কর কৌশলের সঙ্গে সামঞ্জস্যবিধান এবং কার্যকরভাবে তামাক সেবন হ্রাস করা যাবে। এ লক্ষ্যে করের হার যথেষ্ট বাড়ানোর প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেয়ার জন্য এসব দেশ থেকে মূল্যবান শিক্ষা নিতে পারে।
বিশ্বব্যাপী তামাকের ব্যবহার হ্রাসে তামাক কর আরোপ একটি ‘কার্যকরী পদক্ষেপ’। বিভিন্ন দেশ যখন কার্যকর কর ব্যবস্থা বাস্তবায়নের জন্য প্রচেষ্টা চালাচ্ছে, তখন বাংলাদেশের কাছে তার পদ্ধতির পুনর্মূল্যায়ন এবং আন্তর্জাতিক সেরা অনুশীলনের সঙ্গে সামঞ্জস্যবিধানের একটি মূল্যবান সুযোগ রয়েছে। তামাকজাত দ্রব্যের ওপর ডব্লিউএইচও-এর সুপারিশকৃত ৭৫ শতাংশ কর হিস্যা বাস্তবায়ন বাংলাদেশের লক্ষ্য হওয়া উচিত। এই সাহসী পদক্ষেপ জনস্বাস্থ্য এবং অর্থনৈতিক মঙ্গলের প্রতি অঙ্গীকারের একটি স্পষ্ট বার্তা পাঠাবে। এ ছাড়াও, জটিল চার স্তরীয় ব্যবস্থা থেকে প্যাকেট মূল্যের ভিত্তিতে একটি স্বচ্ছ, একক স্তরের নির্দিষ্ট কর ব্যবস্থায় সরে গিয়ে কর কাঠামোকে সরলীকরণ করতে হবে। এটি পরিচালনা সহজ করার পাশাপাশি ব্র্যান্ড জুড়ে ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করে। স্বাস্থ্য এবং অর্থনীতি উভয়ের জন্যই কর বৃদ্ধির সুবিধা সম্পর্কে জনসাধারণকে শিক্ষিত করাও গুরুত্বপূর্ণ। তামাক শিল্পের দেনদরবার প্রচেষ্টা মোকাবিলায় স্বাস্থ্যবিষয়ক পেশাজীবী, নাগরিক সমাজ-সংক্রান্ত সংস্থা এবং এমনকি ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের সমর্থনের একটি বিস্তৃত জোট গড়ে তোলার মাধ্যমে ২০৪০ সালের মধ্যে একটি ‘তামাকমুক্ত বাংলাদেশ’ হওয়া সম্ভব হতে পারে।
কর দক্ষতাকে অগ্রাধিকার দিয়ে, বাংলাদেশ সরকার কেবল জনস্বাস্থ্য লক্ষ্যমাত্রা অর্জনই নয়, বাজেট-সংক্রান্ত সমস্যাগুলোরও সমাধান এবং সামগ্রিক কল্যাণের প্রচার করতে পারে। একটি স্বাস্থ্যকর এবং তামাকমুক্ত ভবিষ্যতের পথ প্রশস্ত করার লক্ষ্যে নীতিনির্ধারকদের অবশ্যই প্রমাণভিত্তিক কর ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য সিদ্ধান্তমূলকভাবে কাজ করতে হবে।
লেখক: জননীতি গবেষক
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে