কী বলেন মুশফিক ও মাহমুদউল্লাহ?
বলছি না যে, আপনারা পুরোপুরি ফুরিয়ে গেছেন। চাইলে আরও কিছু দিন খেলতেও পারেন। আগুন নিভে গেলেও টিম টিম করে জ্বলতে থাকে। আপনারা হয়তো অনেক ইনিংস খেলার পর একটিতে জ্বলে উঠতে পারেন কিংবা না-ও পারেন। যতই মনের দৃঢ়তা থাকুক না কেন একটা সময় চাওয়ার সঙ্গে পাওয়ার হিসেব আর মিলতে চায় না। সাধারণত মেলেও না। সহজ-সরল জানা অঙ্কগুলোও ভুল হয়ে যায়। ব্যাটের সঙ্গে বলের সংযোগটা ঠিকঠাক মতো হয় না। এটাই জীবনের চিরন্তন ধর্ম। ক্রমাগতভাবে ব্যর্থ হতে থাকলে বইতে হয় গ্লানি আর অপমানের বোঝা। এটা তো কারও অজানা নয়, দর্শক বা অনুরাগীরা নগদ পয়সার খরিদ্দার। তারা চায় তরতাজা পারফরম্যান্স।
ব্যাটে রানের ফুলঝুরি ফুটবে, দর্শক-ভক্তরা আমোদিত হবেন। এটাই বিনোদনের দস্তুর। তাতে যদি গড়বড় হয়ে যায়, নিমিষেই তারা ধিক্কার জানাতে একটুও কসুর করেন না। যদিও খেলোয়াড়ি ক্যারিয়ারে এমন কঠিন ও প্রতিকূল পরিস্থিতির কখনো কখনো মুখোমুখি হতে হয় তরুণ বয়সেও। সে সময় চ্যালেঞ্জ নেয়াটা সহজ। একটা মোক্ষম জবাব চটপট দিতে পারা যায়৷ পরিপূর্ণতা থাকে শক্তি ও সামর্থ্যে। ইচ্ছেটাকে কার্যকর করতে খুব বেশি বেগ পেতে হয় না। বয়স বাড়লে তো আর সেই সক্ষমতা থাকে না। দর্শক-সমর্থকদের সেই সহানুভূতিও থাকে না। ব্যর্থ হলে কিংবা সামান্যতম ভুল করলে তার মাশুল দিতে হয় কড়ায়-গণ্ডায়। টানাটানি পড়ে যায় চৌদ্দ গোষ্ঠী নিয়ে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নামক ধারালো ছুরিতে ক্ষতবিক্ষত হতে হয়। এ বয়সে সেটা আপনাদের জন্য কতটা সম্মানজনক হবে? একজন দাঁড়িয়ে আছেন চল্লিশের সীমানায়। আরেকজনও তা থেকে খুব বেশি দূরে নন।
বলছিলাম, মাহমুদউল্লাহ আর মুশফিকুর রহিমের কথা। এই দুজন ক্রিকেটারের কাছে আমাদের অশেষ ঋণ। এ দেশের ক্রিকেটকে কত কত দিন তারা রাঙিয়ে দিয়েছেন। তিন সংস্করণের ক্রিকেটে এই দুই ভায়েরা ভাইয়ের অবদান উজ্জ্বল হয়ে আছে। এককভাবে তো বটেই, যৌথভাবে পৌঁছে দিয়েছেন জয়ের উপকূলে৷ দলের বিপর্যয়ে গড়ে তুলেছেন প্রতিরোধের দেয়াল। তাদের অনমনীয়তার কাছে প্রতিপক্ষের বোলাররা নিষ্ফল আক্রোশে মাথা কুটে মরেছেন। কত ম্যাচ জিতিয়েছেন কিংবা প্রতিকূল অবস্থায় দলের হাল ধরেছেন। দল হারলেও একাকী লড়াই চালিয়ে গেছেন। বয়সে ছোট হলেও মাহমুদউল্লাহর বছর দুয়েক আগেই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক হয় মুশফিকের। পারফরম্যান্সের দিক দিয়েও এগিয়ে তিনি; কিন্তু একটা পর্যায়ে যৌথভাবে হয়ে ওঠেন মিডলঅর্ডার ব্যাটিংয়ের পরম নির্ভরতা। হাতে হাত মিলিয়ে লড়ে গেছেন অদম্য মনোবল নিয়ে।
মুশফিক ও মাহমুদউল্লাহ-পরস্পর পরস্পরের জন্য হয়ে ওঠেন আস্থা ও নির্ভরতা। দুজনের সম্মিলিত অবদানের কথা কারও ভুলে যাওয়ার কথা নয়। ২০১৫ সালের ৯ মার্চ অ্যাডিলেডে ক্রিকেট বিশ্বকাপে এই দুজনের দায়িত্বশীল ও মূল্যবান পার্টনারশিপের কথা ক্রিকেট অনুরাগীদের স্মৃতিপটে উজ্জ্বল হয়ে থাকার কথা বৈকি। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে এই জুটির ১৪১ রানের দায়িত্বশীল পার্টনারশিপটি ক্রিকেট অঙ্গনে এখনও ঔজ্জ্বল্য ছড়ায়। টস হেরে ব্যাট করতে নেমে ৯৯ রানে ৪ উইকেট হারিয়ে বিপর্যয়ের মুখে পড়া বাংলাদেশকে টেনে তোলেন মাহমুদউল্লাহ-মুশফিক জুটি। মাহমুদউল্লাহ ১০৩ ও মুশফিক ৮৯ রান করেন। ইংল্যান্ডকে হারিয়ে দ্বিতীয় কোয়ার্টার ফাইনালে কোয়ালিফাই করে বাংলাদেশ।
২০১৪ সালের ২৮ নভেম্বর ঢাকায় জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ব্যাট করতে নেমে ৩২ রানে ৪ উইকেট পতনের পর মাহমুদউল্লাহ (অপরাজিত ৮২) ও মুশফিক (৭৭) ১৩৪ রানের জুটি দলের জয়ে বড় অবদান রাখে। ২০২১ সালের ২৩ মে মিরপুরে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে জয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন মুশফিক (৮৪) ও মাহমুদউল্লাহ (৫৪)। ২০১৯ সালের ২০ জুন নটিংহামে ক্রিকেট বিশ্বকাপে অস্ট্রেলিয়ার দেয়া ৩৮২ রানের টার্গেটের সামনে মুশফিক (অপরাজিত ১০২) ও মাহমুদউল্লাহ (৬৯) প্রতিরোধ গড়ে তুলেও শেষ পর্যন্ত কামিয়াব হতে পারেননি। এমনটি অনেকবারই হয়েছে। তবে ২০১৬ সালের ২৩ মার্চ ব্যাঙ্গালুরুতে টি-২০ বিশ্বকাপে স্বাগতিক ভারতের বিপক্ষে ১ রানের পরাজয় হৃদয়বিদারক হয়ে আছে। শেষ ওভারের চতুর্থ ও পঞ্চম বলে মুশফিক ও মাহমুদউল্লাহ ফিরে গেলে তীরে এসে তরী ডুবে যায় বাংলাদেশের।
ব্যতিক্রমী কারও কারও কাছে বয়স একটা সংখ্যা হলেও বয়সের ছোবলকে এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। এটা অনেকেই বুঝতে চান না। এ কারণে তার খেসারত দিতে হয়। দীর্ঘদিনের অর্জিত খ্যাতি ও সম্মান গড়াগড়ি খায় ধুলোয়। কথায় আছে, Better to leave before anyone says goodbye. বাংলাদেশের ক্রিকেটে এ বিষয়টি খুব একটা চর্চিত নয়। ফর্মহীন হয়ে যাওয়ার পরও দলে খেলার অপেক্ষা যেন ফুরাতেই চায় না। ফলে কখন কে যে হারিয়ে যায়, তার খোঁজ কেউ রাখে না।
বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসে সেরা ক্রিকেটার হিসেবে সবার আগে আসে ‘পঞ্চপাণ্ডব’খ্যাত মাশরাফি বিন মর্তুজা, মুশফিকুর রহিম, সাকিব আল হাসান, তামিম ইকবাল ও মাহমুদউল্লাহর নাম। প্রায় কাছাকাছি সময়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষিক্ত হওয়ার পর তারা বাংলাদেশের ক্রিকেটকে নিয়ে যান নতুন উচ্চতায়; কিন্তু জনপ্রিয়তার তুঙ্গে থাকা এই ক্রিকেটারদের বিদায়টা বর্ণাঢ্য ও বর্ণিল হচ্ছে না।
মাশরাফি খেলতে খেলতে রাজনীতির আড়ালে ঢাকা পড়ে গেছেন। অবসর নেওয়ার কথা মনেও করেননি। সাকিব আল হাসানও রাজনীতির কোপানলে বিসর্জিত হয়েছেন। এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে অবসরের ঘোষণা দেননি। তামিম ইকবালের বিদায়ও মধুরেণ সমাপয়েৎ হয়নি। অবসরের ঘোষণা দিয়েছেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। এখন আছেন মুশফিক আর মাহমুদউল্লাহ। এই দুজনের বেলা ফুরিয়ে যাচ্ছে।
মাহমুদউল্লাহ যদিও টেস্ট ক্রিকেট থেকে নাটকীয়ভাবে অবসর নিয়েছেন এবং কিছু দিন আগে ছেড়েছেন টি-২০ ক্রিকেট থেকে। এখন শুধু ওয়ান ডে ক্রিকেট খেলছেন। টি-২০ ক্রিকেট থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন মুশফিক। খেলছেন টেস্ট এবং ওয়ান ডে ক্রিকেট। এই দুইজন খেলা থেকে অবসর নেওয়ার ব্যাপারে কোনো আভাস-ইঙ্গিত দেননি। তাদের খেলতে দেখে অবাক হয়েছেন ক্রিকেট বিশ্লেষক ও ধারাভাষ্যকার দীনেশ কার্তিক। কার্তিক হয়তো মুখ ফুটে বলেছেন; কিন্তু অনেকেই হয়তো সেটা বলছেন না। এটাও ঠিক, আরেকজন মুশফিক ও মাহমুদউল্লাহর বিকল্প পাওয়া মোটেও সহজ নয়; কিন্তু তারা তো আর চিরদিন খেলবেন না। আজ হোক কাল হোক, অবসর নিতেই হবে। সে ক্ষেত্রে সময়ের কাজ সময়ে করাটাই কি উত্তম নয়? কী বলেন মুশফিক এবং মাহমুদউল্লাহ?
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে