Views Bangladesh

Views Bangladesh Logo

ক্যাঙ্গারু কোর্ট বলতে কী বোঝায়

 VB  Desk

ভিবি ডেস্ক

রবিবার, ১ ডিসেম্বর ২০২৪

ইন বা ন্যায়বিচারের স্বীকৃত মান উপেক্ষা করা হলে সেই আদালতকে ‘ক্যাঙ্গারু কোর্ট’ বলা হয়। এটি আদালতের অনানুষ্ঠানিক অবমাননাকর শব্দ। যে কোর্ট বা আদালত প্রতিষ্ঠিত আইন-কানুনের কোনো তোয়াক্কা না করে স্বেচ্ছাচারমূলক রায় দেন, তাকেই ব্যঙ্গ করে ক্যাঙ্গারু কোর্ট বলে অভিহিত করা হয়।

অস্ট্রেলিয়ার জাতীয় প্রাণী ক্যাঙ্গারু তার পেটের থলিতে বাচ্চাকে বহন করে। ক্যাঙ্গারু কোর্টও তাই অন্য কারো পকেটে রয়েছে বলে মনে করা হয়। বিচারকরাও অন্যের ক্রীড়নক বা হাতের পুতুল। অর্থাৎ, এ ধরনের বিচারকের কোর্ট স্বাধীন ও নিরপেক্ষ রায় দিতে অক্ষম বা ইচ্ছাকৃতভাবে দেন না। বাদী না বিবাদীর পক্ষে কী রায় ঘোষণা করা হবে, তা আগে থেকেই নির্ধারিত থাকে।

ঊনবিংশ শতকের প্রথমার্ধে ক্যাঙ্গারু কোর্টের অভিব্যক্তির উৎপত্তি যুক্তরাষ্ট্রে। ১৮৪৯ সালে ক্যালিফোর্নিয়ায় সোনার খনির মালিকানার সঙ্গে জড়িত শব্দটি। সে সময় সোনার খনির স্থায়ী স্বত্বাধিকারী হতে সংক্ষিপ্ত বিচারব্যবস্থা প্রচলিত ছিল। ক্যাঙ্গারু প্রাণীটি লাফিয়ে লাফিয়ে চলে। ওই সময়ের সংক্ষিপ্ত বিচারব্যবস্থাও প্রচলিত নিয়ম-কানুনের তোয়াক্কা না করে বিচারের রায় ঘোষণায় অভ্যস্ত ছিলেন।

ক্যালিফোর্নিয়ার সীমান্তবর্তী অঞ্চলে যখন সোনার খনির স্বত্ব নিয়ে দাঙ্গা-ফ্যাসাদ শুরু হয়, তখন অনিয়মতান্ত্রিক আদালতের সৃষ্টি হয়। স্থানীয় প্রয়োজনেই আদালত ভ্রাম্যমাণ ছিল। আদালতের বিচারকর্তা এসব ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করতেন। তবে তাদের বেতন মামলা নিষ্পত্তির সংখ্যায় নির্ভরশীল ছিল। ক্ষেত্রবিশেষে সাজা প্রদানের মাধ্যমে যে জরিমানা আদায় হতো, সে অর্থ থেকেই বিচারকদের বেতন দেয়া হতো। ফলে এ ব্যবস্থায় প্রচলিত নিয়ম-কানুন না মেনেই রায় ঘোষণার প্রবণতা বেড়ে যায়। রায়ে ন্যায়বিচার বঞ্চিত কোনো বিবাদী লেখক বা গবেষক ক্যাঙ্গারু কোর্ট শব্দটি অবজ্ঞার সুরে এ ধরনের আদালত সম্পর্কে ব্যবহার শুরু করেন, যা আজও প্রচলিত।

১৮০০ সালের প্রথমার্ধ্বে লেখক স্যামুয়েল অ্যাডামস হ্যামেট ছদ্মনাম ব্যবহার করে একটি সাময়িকী প্রকাশ করতেন। তার একটি লেখায় বলা হয়, ‘সর্বসম্মতিক্রমে বিচারক 'জি'- নির্বাচিত হয়েছেন এবং এর ফলে মাস্টাং বা ক্যাঙ্গারু কোর্টের নিয়মিত বিচারিক কাজ শুরু হলো’। এ থেকে দাবি করা হয় যে, ক্যাঙ্গারুর লাফিয়ে চলার সঙ্গে শব্দটির সাদৃশ্য আপাতদৃষ্টিতে গ্রহণযোগ্য হলেও মাস্টাং কোর্টের বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্রে প্রচলিত হয়। ক্যাঙ্গারু কোর্টও একই অর্থে ব্যবহৃত হয়। মাস্টাং একটি আমেরিকান বুনো ঘোড়া। আকারে ছোট।

যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্ট ১৯৬৭ সালে এক কিশোর অপরাধীর বিচার সম্পর্কেও ক্যাঙ্গারু কোর্ট শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন। এ রায়ে বলা হয়েছিল, কিশোরদের বিচারের ক্ষেত্রেও সাংবিধানিক নিয়ম-কানুন অবশ্যই থাকবে। যেকোনো মামলায় বিচারিক আদালত বা মামলা পরিচালনাকারী কৌঁসুলি প্রতিষ্ঠিত নিয়ম-কানুনের বিষয়টি বলে থাকেন ইংরেজিতে, যাকে বলা হয় Due process of law. রায়টিতে এমনই নীতি ঘোষণা করা হয়। কারণ, যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আদালত মনে করেছিলেন, কিশোর অপরাধীর বিচারে প্রতিষ্ঠিত নিয়ম অমান্য করা হয়েছে। রায়ে তাই স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয় যে, কিশোর অপরাধীরাও প্রতিষ্ঠিত নিয়ম-কানুনে বিচার পাওয়ার অধিকারী। এ নিয়মের ব্যত্যয় করে ক্যাঙ্গারু কোর্টের মাধ্যমে বিচারের কোনো অবকাশ নেই।

১৯৫১ সালে এ ধরনের বিচারের আরও অধিকতর ব্যাখ্যা এক রায়ে সহযোগী বিচারক দিয়েছিলেন। তিনি এ প্রসঙ্গে গ্রেপ্তারকৃত আসামিকে যে পুলিশ নির্যাতন করে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়, সে বিষয়টির অবতারণা করেন। এ ক্ষেত্রেও সহযোগী বিচারক ক্যাঙ্গারু কোর্ট শব্দটি ব্যবহার করেন। তার ভাষায়, পুলিশি নির্যাতনের মাধ্যমে বিচার পক্ষপাতদুষ্ট করা হয়। জন্ম হয় ক্যাঙ্গারু কোর্টের।

বাংলাদেশেও অনিয়মতান্ত্রিক আদালতের বহু নজির সময় সময় গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে উচ্চ আদালত এসব ঘটনা জানার পর উপযুক্ত ব্যবস্থা নিলেও এ ধরনের অদ্ভুত ও মধ্যযুগীয় বিচারব্যবস্থা বন্ধ হয়নি। এর একটি হচ্ছে ফতোয়া ও গ্রাম্য সালিস প্রথা। ফতোয়ার বিষয়ে অবশ্য উচ্চ আদালত বহু বছর আগেই এ প্রথা নিষিদ্ধের রায় দিয়েছেন। তা সত্ত্বেও ফতোয়া ঘোষণা সম্পূর্ণ বন্ধ হয়নি। কারণ, এ ধরনের 'বিচারকদের' উপযুক্ত শাস্তি হয় না।

ক্যাঙ্গারু কোর্ট শব্দটি ২০০৮ সালে সামরিক সাহায্যপুষ্ট কিছু বিশেষ আদালত সম্পর্কে একজন বিচারাধীন রাজনৈতিক ব্যক্তিও বলেছিলেন। তিনি এসব আদালতকে ক্যাঙ্গারু কোর্ট হিসেবেই আখ্যা দিয়েছিলেন। ওই সব আদালতের রায়ে কিছু ত্রুটি-বিচ্যুতি ছিল। ফলে প্রায় সব অভিযুক্তই হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে মামলা করেন।

মাঝে-মধ্যে নারী ধর্ষণের ঘটনায়ও অদ্ভুত ও অমানবিক বিচারের বিষয় প্রকাশিত হচ্ছে। এসব বিচারে বিচারপ্রার্থীকে বেত্রাঘাত বা জরিমানা করা হয়েছে। এ ধরনের ক্যাঙ্গারু কোর্টের বিচারে বিচারপ্রার্থী নারীরাই আক্রান্ত হন, যা একেবারেই গ্রহণযোগ্য নয়। গ্রাম পর্যায়ে ইউনিয়ন পরিষদ সীমিত আকারে বিচারের ক্ষমতাপ্রাপ্ত, তারও নিয়ম-কানুন রয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, অনেক জনপ্রতিনিধিই ক্যাঙ্গারু কোর্ট পরিচালনা করেন। গাইবান্ধায় এ ধরনের এক বিচারের বিষয় গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছিল। এক সংসদ সদস্যের বিষয়েও এ ধরনের কোর্ট পরিচালনার অভিযোগ ওঠে, যা পরে বন্ধ করা হয়েছে। কারণ, বিষয়টি নিয়ে গণমাধ্যম সোচ্চার ছিল।

এসব নজির থেকে বোঝা যায় যে, বিচারকদের নিয়োগ পক্ষপাতদুষ্ট হলেই ক্যাঙ্গারু কোর্টের আবির্ভাবের আশঙ্কা থেকেই যায়। বিচারক নিয়োগে কর্তৃপক্ষের সচেতনতা ও নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গিও কামনা করে ক্যাঙ্গারু কোর্ট।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ