Views Bangladesh Logo

মার্কিন ডলারের বিনিময় হার বাজারভিত্তিক করলে যে ধরনের অভিঘাত সৃষ্টি হবে

M A  Khaleque

এম এ খালেক

ন্টারন্যাশনাল মানিটারি ফান্ড (আইএমএফ) বাংলাদেশ ব্যাংক অবশেষে মার্কিন ডলারের বিনিময় হার বাজারভিত্তিক করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবং ১৫ মে থেকে সিডিউল ব্যাংকগুলো মার্কিন ডলারের বিনিময় হার নিজেরাই নির্ধারণ করছে। এর আগে আইএমএফ একাধিকবার মার্কিন ডলারের বিনিময় হার বাজারভিত্তিক করার পরামর্শ বা শর্ত দিলেও বাংলাদেশ ব্যাংক তা মানতে সম্মত হয়নি। তার পরিবর্তে বাংলাদেশ ব্যাংক ক্রলিং পেগ পদ্ধতিতে মার্কিন ডলারের বিনিময় হার নির্ধারণ করে আসছিল। ক্রলিং পেগ পদ্ধতি ফিক্সড রেট ও বাজারভিত্তিক বিনিময় হারের মাঝামাঝি একটি অবস্থা।


এতে বাংলাদেশ ব্যাংক মার্কিন ডলারের বিনিময় হারের ‘মধ্য দর’ নির্ধারণ করে দেয়। সিডিউল ব্যাংক এবং মার্কিন ডলার ক্রয়-বিক্রয়ের সঙ্গে যুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলো তার সঙ্গে আড়াই শতাংশ বেশি বা কমে মার্কিন ডলার ক্রয়-বিক্রয় করতে পারত। অর্থাৎ মার্কিন ডলারের বিনিময় হারের ঊর্ধ্বসীমা এবং নিম্নসীমা বাংলাদেশ ব্যাংক নির্ধারণ করে দিত। সিডিউল ব্যাংকগুলো মার্কিন ডলারের ঊর্ধ্বমূল্যের সঙ্গে আরও এক টাকা বাড়িয়ে বিক্রি করতে পারত।

সর্বশেষ বাংলাদেশ ব্যাংক প্রতি মার্কিন ডলারের ঊর্ধ্বমূল্য নির্ধারণ করে দিয়েছিল ১৯ টাকা। ব্যাংকগুলো সাধারণভাবে প্রতি মার্কিন ডলার ১২৩ টাকায় বিক্রি করছিল। মার্কিন ডলারের বিনিময় হার বাজারভিত্তিক করার ফলে এখন থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক মার্কিন ডলারের বাজারমূল্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে কোনো নিয়ন্ত্রণ আরোপ করবে না। তবে কোনো কারণে যদি মুদ্রাবাজারে অস্বাভাবিক অবস্থার সৃষ্টি হয় তাহলে বাংলাদেশ ব্যাংক তাৎক্ষণিকভাবে বাজারের ওপর হস্তক্ষেপ করতে পারবে। অর্থাৎ দূরবর্তী অবস্থান থেকে হলেও বাংলাদেশ ব্যাংক মুদ্রাবাজারের ওপর পরোক্ষ নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখবে।

মার্কিন ডলারের বিনিময় হার বাজারভিত্তিক করা নিয়ে অনেক দিন ধরেই আলোচনা হচ্ছিল; কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক এ ব্যাপারে ইতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। কারণ মার্কিন ডলারের বিনিময় হার যদি বাজারভিত্তিক করা হয় তাহলে স্থানীয় মুদ্রা টাকার মূল্যমান ব্যাপকভাবে কমে যাবার আশঙ্কা রয়েছে। যদি স্থানীয় মুদ্রা টাকার বিনিময় হার কমে যায় তাহলে আমদানি পণ্যের মূল্য বেড়ে যাবে। এতে গণদুর্ভোগ সৃষ্টি হবে। কারণ বিগত প্রায় তিন বছর ধরে দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারে উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিরাজ করছে। মূল্যস্ফীতির হার ৯ শতাংশের উপরে রয়েছে। আইএমএফ তাদের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, এ বছর (২০২৫) বাংলাদেশের সার্বিক মূল্যস্ফীতির হার ১০ শতাংশের কাছাকাছি থাকতে পারে। বিশ্বব্যাংক বলেছে, বাংলাদেশের বর্তমান খাদ্য মূল্যস্ফীতি দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সবার শীর্ষে রয়েছে। এই অবস্থায় বাংলাদেশ ব্যাংক মার্কিন ডলারের বিনিময় হার বাজারের ওপর ছেড়ে দিয়ে নতুন করে আরও উচ্চ মূল্যস্ফীতির ঝুঁকি নেবে না এটাই স্বাভাবিক; কিন্তু প্রশ্ন হলো, আমাদের দেশে উচ্চ মূল্যস্ফীতির জন্য কি শুধু মার্কিন ডলারের বিনিময় হারই দায়ী? নাকি অন্য কারণ রয়েছে?

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারে যে উচ্চ মূল্যস্ফীতি প্রবণতা প্রত্যক্ষ করা গেছে সে জন্য বাংলাদেশে ব্যাংকের ভুল নীতিই দায়ী। করোনা-উত্তর বিশ্ব অর্থনীতি যখন উত্তরণের পর্যায়ে ছিল ঠিক তখনই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হয়। ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্বব্যাপী জ্বালানি তেলের মূল্য অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায়। ফলে সাপ্লাই চেইন ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়। বিশ্বব্যাপী প্রতিটি দেশেই উচ্চ মূল্যস্ফীতি প্রবণতা শুরু হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো শীর্ষ অর্থনীতিতে মূল্যস্ফীতির হার ৯ দশমিক ১ শতাংশে উন্নীত হয়। এটা ছিল দেশটির বিগত ৪০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতি। সেই সময় ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব আমেরিকা (ফেড) একাধিকবার পলিসি রেট বৃদ্ধি করে। পলিসি রেট বৃদ্ধির ফলে ব্যাংক ঋণের সুদের হার আনুপাতিকভাবে বৃদ্ধি পায়। ঋণ গ্রহীতাদের মাঝে আগের তুলনায় উচ্চ সুদে ঋণ গ্রহণের আগ্রহ কমে যায়। বাজারে অর্থ সরবরাহ ভাটা পড়ে। ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব আমেরিকার দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে বাংলাদেশসহ ৭৭টি দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক পলিসি রেট বৃদ্ধি করতে থাকে। বাংলাদেশ ব্যাংক পলিসি রেট বৃদ্ধি করলেও ব্যাংক ঋণের সর্বোচ্চ সুদহার অনেক দিন ধরেই ৯ শতাংশে ফিক্সড করে রাখে।

এমনকি মূল্যস্ফীতির হার যখন সাড়ে ৯ শতাংশের উপরে উঠে যায় তখনও ব্যাংক ঋণের সুদের হার ৯ শতাংশই নির্ধারিত ছিল। বাংলাদেশ ব্যাংক না বুঝে এমন একটি কাজ করেছে তা মনে করার কোনো কারণ নেই। তারা সরকার সমর্থক একটি বিশেষ ব্যবসায়ী মহলকে তুষ্ট করার জন্যই এমন একটি ধ্বংসাত্মক উদ্যোগ নিয়েছিল। উচ্চ মূল্যস্ফীতির মধ্যেই ব্যাংক ঋণের সুদের হার তুলনামূলকভাবে কম হবার কারণে এই ব্যবসায়ী মহল ব্যাপক হারে ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণ করে তা নির্দিষ্ট খাতে বিনিয়োগ না করে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করে। এমনকি বিদেশে পাচার করেছে বলেও অভিযোগ রয়েছে।

এই গোষ্ঠীকে তুষ্ট করার জন্য মার্কিন ডলারের বিনিময় হার ১০ শতাংশ নির্ধারিত করে রাখা হয়েছিল। বাজারে মার্কিন ডলারের ব্যাপক ক্রাইসিস দেখা দিলে কার্ব মার্কেটে প্রতি মার্কিন ডলার ১২২/১২৩ টাকায় বিক্রি হতে থাকে। ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তারা ব্যাংক থেকে মার্কিন ডলার ক্রয় করতে পারছিল না। তারা বাধ্য হয়ে কার্ব মার্কেট থেকে উচ্চমূল্যে মার্কিন ডলার ক্রয় করতে বাধ্য হন। সরকার সমর্থক ব্যবসায়ী-গোষ্ঠী ব্যাংক থেকে মার্কিন ডলার ক্রয় করে তাদের প্রয়োজন মেটাতে থাকে। পণ্য আমদানিকালে ওভার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে মার্কিন ডলার বাইরে পাচার করতে থাকে। ব্যাংকিং চ্যানেলে বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার কম থাকার কারণে প্রবাসী বাংলাদেশিরা কার্ব মার্কেটে উচ্চমূল্য পাবার প্রত্যাশায় হুন্ডির মাধ্যমে রেমিট্যান্স প্রেরণ করতে থাকে। ফলে রেমিট্যান্স আহরণের পরিমাণ প্রত্যাশিত মাত্রায় বৃদ্ধি পাচ্ছিল না। পণ্য রপ্তানিকারকগণ তাদের অর্জিত রপ্তানি আয় দেশে না এনে বিভিন্নভাবে তা বিদেশেই রেখে দেয়া শুরু করে। পরবর্তীতে হুন্ডির মাধ্যমে সেই রপ্তানি আয় দেশে নিয়ে আসতে থাকে। এতে বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের ওপর চাপ পড়ে।

গত বছর জুলাই-আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে সরকার পরিবর্তন হলে বাংলাদেশ ব্যাংকে নতুন গভর্নর নিয়োগ দেয়া হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের শীর্ষ পর্যায়ে রদবদলের পর নতুন ম্যানেজমেন্ট ব্যাংক ঋণের সুদের সর্বোচ্চ হার (৯ শতাংশ) প্রত্যাহার করে নেয়। এখন সিডিউল ব্যাংকগুলো বাজার চাহিদার ভিত্তিতে সুদের হার নির্ধারণ করতে পারছে। এতে ব্যক্তি খাতে ব্যাংক ঋণের প্রবাহ সাংঘাতিকভাবে কমে গেছে। কিছু দিন আগের এক পরিসংখ্যানে উল্লেখ করা হয়েছিল, ব্যক্তি খাতে ব্যাংক ঋণের প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে ৭ দশমিক ২৮ শতাংশ। অথচ উচ্চ মূল্যস্ফীতি চলাকালে এক মুদ্রানীতিতে ব্যক্তি খাতে ব্যাংক ঋণের প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল ১৪ দশমিক ১ শতাংশ; কিন্তু ব্যক্তি খাতে ব্যাংক ঋণের প্রবৃদ্ধি ঘটেছিল ১৪ দশমিক ৭ শতাংশ। অথচ একই সময়ে শিল্পে ব্যবহার্য ক্যাপিটাল মেশিনারিজ আমদানি কমেছিল ৭৬ শতাংশ। কাঁচামাল ও মধ্যবর্তী পণ্য আমদানি কমেছিল ১৪ শতাংশ করে। তাহলে ব্যক্তি খাতে যে ঋণ দেয়া হয় তা কোথায় গিয়েছিল?

আশঙ্কা করা হয়, মার্কিন ডলারের বিনিময় হার বাজারভিত্তিক করা হলে স্থানীয় মুদ্রা টাকার মূল্যমান সাংঘাতিকভাবে কমে যাবে। ফলে আমদানি ব্যয় ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়ে উচ্চ মূল্যস্ফীতিকে আরও উচ্চমাত্রায় নিয়ে যাবে; কিন্তু প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বাজারে উচ্চ মূল্যস্ফীতির জন্য কি শুধু মার্কিন ডলারের বিনিময় হার বেড়ে যাওয়াটাই দায়ী। নাকি এর পেছনে অন্য কোনো কারণ রয়েছে? বাংলাদেশ মোট ব্যবহার্য পণ্যের ২৫ শতাংশ আমদানির মাধ্যমে পূরণ করে থাকে। অবশিষ্ট ৭৫ শতাংশ পণ্য স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত হয়। তাহলে সব পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পায় কেন? বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বাজারে উচ্চ মূল্যস্ফীতি প্রবণতার জন্য মূল দায়ী হচ্ছে বাজার ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা। প্রতিটি সরকার আমলেই দলীয় সমর্থন শ্রেণির আদলে বাজারে শক্তিশালী ব্যবসায়ী সিন্ডেকেট গড়ে ওঠে। কোনো সরকারই এই ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করে না। বরং বাজারে সিন্ডিকেট আছে এটাই স্বীকার করতে চান না। পণ্য পরিবহনকালে রাস্তায় রাস্তায় চাঁদাবাজি চলে। এতে পরিবহন ব্যয় বৃদ্ধি পায়। পণ্য পরিবহনকালে হওয়া চাঁদাবাজি বা সিন্ডিকেটের কারণে পণ্য মূল্য বৃদ্ধি পেলে তার চূড়ান্ত দায়ভার কিন্তু ভোক্তাকেই বহন করতে হয়।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উদ্যোগে গঠিত শ্বেতপত্র কমিটি তাদের প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, ২০০৯ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত সময়ে বাংলাদেশ থেকে ২৩ হাজার ৪০০ কোটি মার্কিন ডলার সমতুল্য ২৮ লাখ কোটি টাকা বিদেশে পাচার করা হয়েছে। বর্তমান সময়ে কেউ বস্তায় ভরে টাকা পাচার করে না। তারা হুন্ডির মাধ্যমে অর্থ পাচার করেন। অথবা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের আড়ালে অর্থ পাচার করে থাকে। গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইনটিগ্রিটি (জিএফআই) কয়েক বছর আগে তাদের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছিল, বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের আড়ালে ৬৪ হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের আড়ালে অর্থ পাচার রোধ করার জন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা অসম্ভব নয়। কারণ কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান বিদেশ থেকে যে পণ্য আমদানির ঘোষণা দেবে সেই পণ্যের মূল্য সঠিকভাবে যাচাই করা হলে ওভার ইনভয়েসিংয়ের বিষয়টি ধরা পড়বে। তথ্য-প্রযুক্তির কল্যাণে যে কোনো পণ্যের আন্তর্জাতিক বাজারমূল্য যাচাই করা যেতে পারে। এমনকি বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশি দূতাবাসের সহায়তা গ্রহণ করা যেতে পারে। আসলে গোড়াতেই গলদ রয়ে গেছে। যারা আমদানি পণ্যের মূল্য যাচাই করবেন তারা কি সততার সঙ্গে তাদের দায়িত্ব পালন করছেন? আরও একটি সমস্যা রয়েছে। যারা ওভার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে পণ্য আমদানি করেন তারা কৌশলগত কারণেই আমদানিকৃত পণ্য সঠিক মূল্যে বিক্রি করতে পারেন না। এতে তাদের কারসাজি ধরা পড়ে যেতে পারে। যেমন কোনো ব্যক্তি হয়তো ১০০ টাকা মূল্যের একটি পণ্য আমদানিকালে ১২৫ টাকা মূল্য প্রদর্শন করলেন। তিনি সেই পণ্য স্থানীয় বাজারে নিশ্চয়ই ১০৫ টাকায় বিক্রি করতে পারবেন না। তাহলে তিনি ধরা পড়ে যাবেন। তাই তাকে বাধ্য হয়েই পণ্যটি অন্তত ১৩৫ টাকা থেকে ১৪০ টাকায় বিক্রি করতে হবে। বিশ্বব্যাংক তাদের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, আগামী বছর (২০২৬) আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলসহ অন্যান্য পণ্যের মূল্য ১০ থেকে ১২ শতাংশ কমে যাবার সম্ভাবনা রয়েছে; কিন্তু আমরা কি আশা করতে পারি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বাজারে সংশ্লিষ্ট আমদানি পণ্যের মূল্য হ্রাস পাবে?

বিশ্বব্যাংকের একজন সাবেক কর্মকর্তা, যিনি একজন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ তিনি বলেছেন, বাংলাদেশের অর্থনীতি যেভাবে ঘুরে দাঁড়ানো শুরু করেছে সেই প্রেক্ষিতে বলা যায় এখনই মার্কিন ডলারের বিনিময় হার বাজারভিত্তিক করা উপযুক্ত সময়। সরকার পরিবর্তনের পর রপ্তানি বাণিজ্যে ইতিবাচক প্রবণতা শুরু হয়েছে। জনশক্তি রপ্তানি খাতের আয় অতীতের যে কোনো সময়ের তুলনায় বৃদ্ধি পেয়েছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে ২৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স আহরিত হয়েছে। ১০ মাসে আহরিত রেমিট্যান্সের পরিমাণ অতীতের যে কোনো পুরো অর্থবছরের চেয়ে বেশি। মে এবং জুন মাসের প্রবাসী আয় যোগ করা হলে চলতি অর্থবছরে রেমিট্যান্স আয়ের পরিমাণ ৩০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের ল্যান্ডমার্ক স্পর্শ করতে পারে। ক্রলিং পেগ পদ্ধতিতে মার্কিন ডলারের বিনিময় হার নির্ধারণের ফলে কার্ব মার্কেটের সঙ্গে ব্যাংকিং চ্যানেলে বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হারের পার্থক্য ন্যূনতম পর্যায়ে নেমে এসেছে। প্রবাসী বাংলাদেশিরা এখন বৈধ চ্যানেলে রেমিট্যান্স দেশে প্রেরণ করছে। মার্কিন ডলারের বিনিময় হার বাজারভিত্তিক করার ফলে আগামীতে হুন্ডির মাধ্যমে রেমিট্যান্স প্রেরণ কমে যাবে। বাংলাদেশ থেকে সাধারণত অদক্ষ এবং প্রশিক্ষণবিহীন ব্যক্তিরাই অধিকহারে বিদেশে গমন করে। যে কোনো দেশে প্রশিক্ষিত এবং দক্ষ জনবলের চাহিদা বেশি। তাই আমাদের আগামীতে বিশেষ পরিকল্পনার আওতায় দক্ষ এবং পেশাজীবীদের বিদেশে রপ্তানির উদ্যোগ নিতে হবে। একই সঙ্গে জনশক্তি রপ্তানির জন্য নতুন নতুন গন্তব্যস্থল খুঁজে বের করতে হবে।

প্রবাসী বাংলাদেশিরা সাধারণত ব্যাংকিং সুবিধা গ্রহণের ক্ষেত্রে ঝামেলায় পড়েন। চাইলেই কর্মস্থল থেকে ছুটি নিয়ে ব্যাংকে গিয়ে রেমিট্যান্স দেশে প্রেরণ করা তাদের পক্ষে সম্ভব হয় না। তাই বিদেশে বাংলাদেশের যেসব ব্যাংকের শাখা রয়েছে তাদের অতিরিক্ত লোকবল নিয়োগ দিয়ে হলেও প্রবাসী বাংলাদেশিদের আবাসস্থলে গিয়ে রেমিট্যান্স সংগ্রহের ব্যবস্থা করতে হবে। প্রয়োজন আরও অধিকসংখ্যক ব্যাংকের প্রবাসী শাখা খুলতে হবে। পণ্য রপ্তানিকারকদের মধ্যে যারা অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রার পুরোটা দেশে না এনে বিদেশে রেখে দেন তারাও মার্কিন ডলারের বিনিময় হার বৃদ্ধি পেলে তাদের অর্জিত রপ্তানি আয় তাৎক্ষণিকভাবে দেশে নিয়ে আসার ব্যাপারে আগ্রহী হবেন।

পণ্য মূল্য বৃদ্ধির অজুহাতে বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার বেঁধে রাখা ঠিক হবে না। বর্তমানে বাংলাদেশের অর্থনীতি যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছে তাতে মার্কিন ডলারের বিনিময় হার বাজারভিত্তিক করার কারণে খুব একটা অসুবিধা হবে বলে মনে হয় না। বাজারে পণ্য মূল্য বৃদ্ধি পাবার জন্য মার্কিন ডলারের বিনিময় হারের ওপর দোষ চাপিয়ে কোনো লাভ হবে না। বাজার নিয়ন্ত্রণের জন্য সরকারি মহল থেকে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। মার্কিন ডলারের বিনিময় হার নিযন্ত্রণ করে কোনো সুফল পাওয়া যাবে না।

এম এ খালেক: অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার ও অর্থনীতি বিষয়ক লেখক।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ