বিএসইসির ‘ইনভেস্টমেন্ট ম্যানেজমেন্ট সামিট’ কী ফল আনবে?
২০২২ সালে ৩১ জুলাই অব্যহত দরপতন ঠেকাতে দ্বিতীয় বারের মতো ফ্লোর প্রাইস আরোপ করে পুঁজিবাজারে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। এরপরের দুইমাস (আগস্ট ও সেপ্টেম্ব) পুঁজিবাজারে সূচক বাড়ার পাশাপাশি লেনদেনও বেশ গতি ফেরে। সেই ধারাবাহিকতা ওই বছরের ২০ সেপ্টেম্বর ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) লেনদেন হয় ২ হাজার ৮৩২ কোটি টাকা। যা ছিল ডিএসইর ইতিহাসে সবোর্চ্চ ৫টি লেনদেনের একটি।
কিন্তু ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরের পর থেকে মূল্যসূচক কমার পাশাপাশি লেনদেনও কমতে শুরু করে। পরবর্তী দুইমাসের ব্যবধানে লেনদেন নেমে আসে ৩০০ কোটির ঘরে। আর ডিএসইর প্রধান সূচক ৬ হাজার ৬০০ পয়েন্টের থেকে নেমে আসে ৬ হাজার ১ পয়েন্টের ঘরে। এতে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত বেশিভাগ কোম্পানির শেয়ার দর আটকে যায় ফ্লোর প্রাইসে। একই সাথে আটকে যায় ছোট বড় বিনিয়োগকারী সবাই। এই অবস্থা থেকে উত্তরণে বেশ কয়েক দফায় মার্চেন্ট ব্যাংক, পোর্টফোলিও ম্যানেজার, স্টক ব্রোকার, বীমা কোম্পানি ও বাণিজ্যিক ব্যাংকের কর্তাব্যক্তিদের সাথে বসেছে নিয়ন্ত্রক সংস্থার চেয়ারম্যান ও কমিশনাররা। এসব উদ্যোগের ফলে দুই একদিন পুঁজিবাজারে ইতিবাচক ভাব দেখা গেলেও, টেকসই হয় করেনি সেই প্রবণতা।
এক দিকে দেশের বৈদেশ্বিক মুদ্রার রিজার্ভ, মুদ্রাস্ফীতিসহ অর্থনীতিতে নানা সংকট পুঁজিবাজারকে ফেলেছে আরও বেকাদায়। সেইসাথে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের রক্ষাকবচ হিসেবে আরোপ করা ফ্লোর প্রাইস পুঁজিবাজারের বিনিয়োগকারীদের গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে ডিএসই, মার্চেন্ড ব্যাংক ও ফান্ড ম্যানেজারদেরসহ বাজার সংশ্লিষ্টদের পক্ষ থেকে এসেছে ফ্লোর প্রাইস উঠিয়ে নেয়ার চাপ। কিন্তু এতে রাজি হয়নি নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি। তাদেরকে বারবার আশস্ত করা হয়েছে, বাজারে একটু গতি ফিরলেও প্রত্যাহার করা হবে ফ্লোর প্রাইস।
১১ মাস ধরে ছোট ছোট উত্থান ও পতনের মধ্যে দিয়ে একটি নির্দিষ্ট গণ্ডিতেই লেনদেন হচ্ছে দেশের পুঁজিবাজারে। এই পরিস্থিতিতে ১৬ সেপ্টেম্বরে অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি, ফান্ড ম্যানেজার, ট্রাস্টি, কাস্টডিয়ান, অডিটরসহ পুঁজিবাজারে সংশ্লিষ্টদের নিয়ে ‘ইনভেস্টমেন্ট ম্যানেজমেন্ট সামিট’ করার উদ্যোগ নিয়েছে বিএসইসি। এতে প্রধান অতিথি হিসেবে থাকবেন নিয়ন্ত্রক সংস্থার চেয়ারম্যান শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম।
এই সামিটকে ঘিরে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আগ্রহী তৈরি হয়েছে। তারা জানতে চাইছেন কি বিষয়ে আলোচনা হবে এই সামিটে। বিএসইসি উদ্দেশ্য কী? ফ্লোর প্রাইস প্রত্যাহার নিয়ে অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি ও পোর্ট ফোলিও মানেজমেন্ট কোম্পানির কর্তাব্যক্তি কোন চাপ দিবেন কিনা? কারণ প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীসহ পুঁজিবাজারের বড় একটি অংশ ফ্লোর প্রাইস প্রত্যাহার করানোর চেষ্টা করছে বেশ কয়েকমাস ধরে। সর্বপরি এরফলে বাজারে কোন ইতিবাচক প্রভাব পড়বে কিনা?
সাধারণ বিনিয়োগকারীদের মধ্য নানা প্রশ্ন থাকলেও বিএসইসি মুখপাত্র মো. রেজাউল করিম বলছেন, এই সম্মেলন হবে অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি, ফান্ড ম্যানেজার, ট্রাস্টি, কাস্টডিয়ান, অডিটরদের কমপ্লাইন্স ইস্যুতে। এখানে কিভাবে বাজার সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান আরও স্বচ্ছতার সাথে নিজেদের কাজ করতে পারে সে বিষয়ে মতবিনিময় হবে। সাথে স্বচ্ছতার প্রশ্নে প্রযুক্তির ব্যবহার নিয়ে আলোচনা হবে।
এদিকে আসন্ন জাতীয় নির্বাচনকে সামনে পুঁজিবাজারে কেন্দ্রীক নানামুখি তৎপরতা দেখা দিতে পারে। এর আগের জাতীয় নির্বাচনের সময় পুঁজি বাজারে স্থিতিশীলতা ধরে রাখার জন্য নানা উদ্যোগ নিতে দেখা গেছে। বাজারকে গতিশীল করা ও নিজেদের সক্ষমতা বাড়াতে এরইমধ্যে সরকারের কাছে ৫ হাজার কোটি টাকা চেয়েছে ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি)। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবুল হোসেন জানিয়েছে তারা সরকারের কাছে অর্থ চেয়ে আবেদন করেছেন। সেইসাথে সম্ভাব্য অন্যান্য খাত থেকে ঋণ নেয়ার চেষ্টা করছেন।
ডিএসই ও সিএসইর পক্ষ থেকে আসন্ন জাতীয় নির্বাচন ঘিরে কিছু পদক্ষেপ নেয়ার ঘোষণা দেয়া হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গুজব প্রতিহত করতে কার্যাকর পদক্ষেপ নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে দুই স্টক এক্সচেঞ্জের কর্তাব্যক্তিরা। ডিএসইর চেয়াম্যান জানিয়েছেন, শিগগিরি শীর্ষ ৫০ স্টক ব্রোকারকে বসবেন তারা। নির্বাচনের আগে কিভাবে বাজারকে স্থিতিশীল করা যায় তারজন্য সবার সাথে সবে করণীয় ঠিক করবেন।
ডিমিউচুয়ালাইজেশনের আগে পুঁজিবাজার অস্থিতিশীল হলে সর্বপ্রথম উদ্যোগ নিতে দেখা যেতো ডিএসই কর্তৃপক্ষকে। সে সময় বিভিন্ন দাবি দাওয়া নিয়ে অর্থমন্ত্রী , বাংলাদেশ ব্যাংক, বিএসইসির কাছে দৌড়ঝাঁপ করতেন ডিএসই প্রেসিডেন্টের নেতৃত্ব পরিচালনা পর্ষদ। কিন্তু ডিমিচুলাইজেশনের পর এই উদ্যোগ অনেকেটাই কমে গেছে। এখন মূলত যেসব উদ্যোগ নেয়া হয়, তার বেশিভাগই হয় নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির পক্ষ থেকে।
বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে ৯৬ সারের ধসের ঘটনার পর দীর্ঘ সময়ে নিয়ে ঘুরে দাঁড়াতে। কিন্তু ২০১০ সালের ধসের এখনও বাজার গতিশীল হয়নি। কিন্তু এরইমধ্যে অতিবাহিত হয়েছে একযুগ। কবে পুঁজিবাজারে বাংলাদেশের অর্থনীতির সাথে তাল মিলিয়ে চলবে, দেশের ব্যবসা বাণিজ্যের বড়ধরণের প্রভাব ফেলবে তার উত্তর নেই কারও কাছে। দেশের পুঁজিবাজারের সংকট কাটিয়ে বিনিয়োগের মূল প্লাটফর্ম হবে এই প্রত্যাশা বাজার সংশ্লিষ্টদের।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে