Views Bangladesh Logo

লুটপাট কোন ধরনের প্রতিবাদ?

ন্দেহ নেই গাজায় শতাব্দীর সেরা হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছে দখলদার ইসরায়েল। একেবারেই পরিকল্পিত গণহত্যা। ইসরায়েলি আগ্রাসন এখন আর কেবল দখলদারিত্বের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই; ফিলিস্তিনিদের সম্পূর্ণভাবে নিশ্চিহ্ন করার সুপরিকল্পিত নীলনকশা। গাজা এখন এক বিশাল গণকবর। ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়েছে একেকটি পরিবার।

প্রতি মুহূর্তে আকাশ থেকে আগুন ঝরছে, প্রতিটি ঘরে শোকের ছায়া। হাসপাতালগুলোর মেঝেতে সারি সারি রক্তাক্ত লাশ। নবজাতক শিশুরা অক্সিজেনের অভাবে মায়ের কোলে মারা যাচ্ছে, হাসপাতালের ধ্বংসস্তূপের নিচে চিকিৎসকরা চাপা পড়ে যাচ্ছেন, অথচ বিশ্বের ক্ষমতাধর রাষ্ট্রগুলো নীরব দর্শকের ভূমিকায়। শিশুদের কান্না, মায়েদের আর্তনাদ, ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়েছে মানবতা।

এই পৃথিবীর বাসিন্দা হিসেবে মনে হচ্ছে- যেন আমার হাতে রক্ত, আমার বাহুতে রক্ত, আমার মুখে রক্তে, আমার চোখে রক্ত। রক্তের জন্য আমি কোনোদিকে তাকাতে পারছি না। উত্তর-দক্ষিণ-পূর্ব-পশ্চিম কোনোদিকেই না। এ রক্তপাতের জন্য আমিও দায়ী। আমিও অপরাধী। কারণ, আমার বিদ্বেষের জন্য, আমার হিংসার জন্য এই রক্তপাত। এই ভয়াবহ তীব্রতা থেকে অনুভব করে হয়ত পৃথিবীর কবি জীবনানন্দ দাশ লিখেছিলেন, ‘মানুষ মেরেছি আমি, তার রক্তে আমার শরীর ভরে গেছে/পৃথিবীর পথে এই নিহত ভ্রাতার/ভাই আমি; আমাকে সে কনিষ্ঠের মতো জেনে তবু/হৃদয়ে কঠিন হয়ে বধ করে গেল/ আমি রক্তাক্ত নদীর কল্লোলের কাছে শুয়ে অগ্রজপ্রতিম বিমূঢ়কে বধ করে ঘুমাতেছি।’

২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে ইসরায়েলের গণহত্যামূলক আগ্রাসনে গাজায় মোট মৃতের সংখ্যা বেড়ে ৫০ হাজার ৭৫২ জনে পৌঁছেছে বলে সোমবার (৭ এপ্রিল) গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে। জাতিসংঘের মতে, ইসরায়েলের বর্বর আক্রমণের কারণে গাজার প্রায় ৮৫ শতাংশ ফিলিস্তিনি বাস্তুচ্যুত হয়েছিলেন। এছাড়া অবরুদ্ধ এই ভূখণ্ডের ৬০ শতাংশ অবকাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত বা ধ্বংস হয়ে গেছে। গাজায় পোলিওজনিত পঙ্গুত্বের ঝুঁকিতে ৬ লক্ষাধিক শিশু। বিশেষ করে শিশুহত্যা সারা পৃথিবীর মানুষের বিবেককে নাড়িয়ে দিয়েছে।

গত ১৮ মার্চ থেকে গাজায় নতুন করে ইসরায়েলি হামলা শুরু হওয়ার পর থেকে প্রায় ১৪০০ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। এর প্রতিবাদে দেশে দেশে বিক্ষোভ জানিয়েছে সর্বশ্রেণির মানুষ। যুক্তরাষ্ট্র, তুরস্ক, মরক্কো, জার্মানি, বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশজুড়ে বিক্ষোভ জানিয়েছে।

সবার প্রতিবাদের ধরন ছিল শান্তিপূর্ণ-পরিশীলিত। অথচ বাংলাদেশের এক শ্রেণির নাগরিকদের প্রতিবাদের ধরণ খুব-ই বিশ্রি। খুবই নোংরা। প্রতিবাদের নামে তারা চালিয়েছে ধ্বংসযজ্ঞ-লুটপাট। গত সোমবার (৭ এপ্রিল) রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ করে নানা শ্রেণির পেশার মানুষ। ইসরায়েলি পণ্য মনে করে বাটা শোরুম, কেএফসির কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ভাঙচুর ও লুটপাট চালিয়েছে কিছু উচ্ছৃঙ্খল ব্যক্তি। প্রশ্ন হলো, এভাবে প্রতিবাদ জানিয়ে আসলে তারা কি চায়? গাজায় গণহত্যা বন্ধ চায় না কি আরও উস্কে দিতে চায়? প্রশ্ন জাগে, যে লুটেরার দল যারা জুতার লোভ সামলাতে পারে না, তারা কি করে ইসরায়েলের গণহত্যার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করবে? ফিলিস্তিনের অসহায় মানুষের সঙ্গে এর চেয়ে বড় প্রতারণা আর হয় না। তবুও মনকে বুঝানো যেত যদি ওগুলো ইসরায়েলি পণ্য হতো।

গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে ভাঙচুর ও চরম ঘৃণা বিদ্বেষের মুখে পড়া বাটা জুতা, কেএফসি, সেভেন আপ ও কোকাকোলা এসব কোম্পানির উৎপত্তি ইসরায়েলে নয়। এ কারণেই হয়তো কবিগুরু লিখেছেন, ‘সাত কোটি সন্তানেরে, হে মুগ্ধ জননী, রেখেছ বাঙালী করে, মানুষ করনি।’

জেনে নেয়া যাক পণ্যগুলোর উৎপত্তস্থল:
বাটা (Bata Shoes) ১৮৯৪ সালে চেক প্রজাতন্ত্রে (সাবেক অস্ট্রো-হাঙ্গেরি সাম্রাজ্য) প্রতিষ্ঠিত হয়। এর প্রতিষ্ঠাতা থমাস বাটা (Tomáš Baťa) বর্তমানে যদিও এর সদর দপ্তর সুইজারল্যান্ডে, তবে বাটার উৎপত্তি চেক প্রজাতন্ত্রে।

দ্বিতীয়ত, কেএফসির (KFC-Kentucky Fried Chicken) উৎপত্তিস্থল যুক্তরাষ্ট্র, কেনটাকি রাজ্যে। ১৯৩০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিষ্ঠাতা কর্নেল হারল্যান্ড স্যান্ডার্স। ফাস্ট ফুড চেইন হিসেবে বিশ্বজুড়ে সমাদৃত।

তৃতীয়ত, সেভেন আপের (7UP) উৎপত্তিস্থল যুক্তরাষ্ট্র। ১৯২৯ সালে প্রথম উৎপাদন শুরু হয়। বর্তমানে এটি কিউরিগ ডক্টর পিপারের (Keurig Dr Pepper) মালিকানাধীন (যুক্তরাষ্ট্রে) এবং পেপসিকো (PepsiCo) আন্তর্জাতিকভাবে বাজারজাত করে।

চতুর্থত; কোকাকোলার (Coca-Cola) উৎপত্তিস্থল যুক্তরাষ্ট্র, আটলান্টা, জর্জিয়া। ১৮৮৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিষ্ঠাতা জন স্টিথ পেম্বারটন। বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় সফট ড্রিংক ব্র্যান্ড।

এসব কোম্পানির ফ্রাঞ্চাইজি বাংলাদেশের মতো ফিলিস্তিন বা ইসরায়েলেও আছে। কিন্তু কোম্পানিগুলো ইসরায়েলের না। যদি ইহুদিদের পণ্য বয়কট করতে হয় তাহলে সবার আগে বাদ দিতে হবে ফেসবুক, গুগল, ইউটিউব, উইন্ডোজ, মাইক্রোসফট, ইন্টেল, অ্যান্ড্রয়েড ও অ্যাপল। অথচ বাংলাদেশের উন্মাদ কিছু মানুষ ইহুদিদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে ফেসবুকে এসে। অথচ এই ফেসবুকই ইহুদির তৈরি।

অপরদিকে, ইসরায়েল বিশ্বে সবচেয়ে বেশি স্টার্টআপ উৎপন্ন করে এমন দেশগুলোর একটি। AI, Machine Learning, Robotics-এর অনেক কোর টেকনোলজি এখানে তৈরি হয়, যেগুলো গুগল (Google), মাইক্রোসফ্ট (Microsoft), মেটার (Meta) মতো কোম্পানি ব্যবহার করে। ফেসবুকের মাদার অর্গানাইজেশন ওই মেটা। সুতরাং প্রতিবাদের ভাষা হতে হবে পরিশীলীত। পরিচ্ছন্ন, যৌক্তিক।

পৃথিবীর একজন বাসিন্দা, একজন মানুষ হিসেবে আমি এ গণহত্যা বন্ধ চাই। বলতে চাই, মানুষে মানুষে এই হত্যাযজ্ঞ, এই রক্তপাত বন্ধ হোক। সবাই মিলে আমরা শান্তি-সম্প্রীতির গান গেয়ে যাই।

লেখক: সাংবাদিক, সংস্কৃতিকর্মী।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ