ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের প্রধান দুর্যোগ কী?
দেশের উপকূলীয় এলাকায় ঘূর্ণিঝড় রিমাল আঘাত হানার কয়েক ঘণ্টা পরে মোবাইল ফোনে ছোট বোনের এসএমএস: ‘দাদা, ঘরের ভেতরে পানি উঠে গেছে। ছোট কাকার ঘরে হাঁটুসমান পানি। ফ্রিজ খাটের ওপরে ওঠানো হয়েছে। আব্বু-আম্মু খাটের ওপরে বসে আছে। আব্বু অস্থির। পানি কি খাটের ওপরেও উঠে যাবে?’
ঝালকাঠি শহরে আমাদের বাসার ভেতরে পানি উঠেছে- এ খবরটি বিশ্বাস করার জন্য আমাকে অনেকক্ষণ চুপ করে থাকতে হয়। তারপর আব্বা-মা-চাচা-চাচাতো ভাইসহ একে একে অসংখ্য মানুষকে ফোন করি। সবার ফোন বন্ধ অথবা ‘সংযোগ দেয়া সম্ভব হচ্ছে না’। হঠাৎ করে ছোট চাচার ফোনে কল ঢুকে যায়। তিনিও বিস্মিত যে কীভাবে আমি তার ফোনে ঢুকতে পারলাম!
তিনি ঝড়, বাতাস, বৃষ্টি ও ঘরের ভেতরে পানির যে বর্ণনা দিলেন এবং তার কথার ভেতরে যে আতঙ্ক, ভয় ও শঙ্কা প্রকাশিত হলো- তা আমার শৈশব-কৈশোরের প্রবল বন্যার স্মৃতিকেও হার মানায়। কেননা ১৯৮৮ এবং ১৯৯৮ সালের ভয়াবহ বন্যার সময়ও আমাদের ঘরের ভেতরে পানি ওঠেনি। এমনকি উঠানে এবং বাড়ির সামনের রাস্তায় পানি উঠলেও কিছু সময় পরে তা নেমে গেছে।
২০০৭ সালের ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় সিডরেও ঝালকাঠি শহরের ক্ষয়ক্ষতি ছিল যথেষ্ট কম। একটি দৈনিক পত্রিকার রিপোর্টার হিসেবে টানা তিন সপ্তাহ উপকূলের নানা এলাকায় ঘুরে ঘুরে সিডরের সংবাদ কাভার করে যখন নিজের জেলা শহরে প্রবেশ করি, তখন মনেই হয়নি এই শহরের ওপর দিয়ে কোনো ঘূর্ণিঝড় বয়ে গেছে।
ব্স্তুত ঝালকাঠি শহরটি বরিশাল বিভাগের মধ্যবর্তী এমন একটি সুবিধাজনক স্থানে অবস্থিত, যার চারপাশে নদী। শহরের দক্ষিণ কোল ঘেঁষে প্রমত্তা সুগন্ধা, পশ্চিমে বাসন্ডা খাল (নদী), উত্তর ও পূর্বেও একাধিক নদী ও খাল। আবার সুগন্ধার সঙ্গে যুক্ত বিষখালী, গাবখান চ্যানেল ও ধানসিঁড়ি নদী। ফলে পানি যতই উঠুক, ভাটার টানে সে নেমে যায়। অতএব, শহরের ভেতরে কারও বাড়িঘরে পানি ওঠে বা উঠলেও তা অনেক সময় ধরে থাকে- এমন দৃশ্যের সঙ্গে ঝালকাঠি শহরের অধিকাংশ মানুষই পরিচিত নন; কিন্তু এবার সেই বিশ্বাসের ভিত ভেঙে গেছে। এবার এমন অনেকেরই বাড়িঘরের ভেতরে পানি ঢুকে গেছে যারা পানি ঢোকার আধা ঘণ্টা আগেও কল্পনা করেননি যে তাদের খাটের ওপরে উঠে বসে থাকতে হবে! এটি তাদের জন্য একেবারেই নতুন অভিজ্ঞতা।
১৯৯৮ কিংবা ১৯৯৮ সালের বন্যায়ও কেন আমাদের ঘরের ভেতরে পানি উঠল না- সেই প্রশ্নের নির্মোহ উত্তর খুঁজতে গেলে দেখা যাবে তার জন্য দায়ী আমরাই। আমাদের গ্রামের বাড়ির সামনে পৌরসভা যে রাস্তাটি বানিয়েছে, সেটি আগে ছিল সরু কাঁচা রাস্তা। পরে ইট বিছানো হেরিংবন এবং তারপর এখন পাথর ঢালাই। আগে ওই রাস্তা দিয়ে মানুষ হাঁটতে পারতো আর বড়জোর বাইসাইকেল; কিন্তু এখন মোটরসাইকেল, ইজিবাইক এমনকি ইট-বালু-সিমেন্টবোঝাই ছোট ছোট লরিও ঢুকে যায় গ্রামের ভেতরে। আর এই রাস্তাটি হওয়ার পর থেকে গ্রামে দালান তৈরির সংখ্যা বেড়ে গেছে কয়েক গুণ। অধিকাংশ টিনের বাড়ি পরিণত হচ্ছে দালানে। এটি হলো মুদ্রার একপিঠ।
অন্যপিঠ হলো, এই রাস্তাটি বানাতে গিয়ে একটি লম্বা খালের বিরাট অংশ বালু দিয়ে ভরাট করা হয়েছে। একাধিক পুকুর ভরাট করা হয়েছে। যারা রাস্তার সুবিধা কাজে লাগিয়ে টিনের ঘরগুলোকে দালান বানাচ্ছেন কিংবা নতুন করে যারা বাড়িঘর তুলছেন, তাদের অনেকেই বাড়ির সামনে বা পেছনের পুকুর ভরাট করে ফেলেছেন। এখানে বড় ভূমিকা রাখছেন বালু ও বলগেট ব্যবসায়ীরা। কেননা তারা খুব দ্রুত ও সস্তায় বালু দিয়ে পুকুর, জলাশয় ও জলাধার এমনকি ফসলি জমিও ভরাট করে দিচ্ছেন। এত সহজে বালু দিয়ে জলাধারগুলো ভরাট করার সুযোগ না থাকলে কিছু পুকুর, জলাশয়, নদী, খাল ও জলাধার হয়তো টিকে যেত; কিন্তু প্রযুক্তি ও সড়ক যোগাযোগের উন্নয়ন সবচেয়ে বড় বিপদ বয়ে আনছে পরিবেশ ও প্রাণপ্রকৃতির জন্য। পানির দেশকে পানিশূন্য করার এ এক আত্মঘাতী আয়োজন!
গ্রামের বাড়িতে আমাদের নতুন যে ঘরটা বানানো হয়েছে, সেখানেও একসময় একটি পুকুর ছিল। এই পুকুরেই সাঁতার শিখি। পুকুরটি ছিল জোয়ার-ভাটার। বড় নদীর জোয়ারের পানি পুকুর সংলগ্ন ছোট খাল দিয়ে প্রবেশ করত; কিন্তু রাস্তা বানাতে গিয়ে ওই খালটি ভরাট করে ফেলায় পুকুরের সঙ্গে নদীর সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। পুকুরটি ধীরে ধীরে একটি বদ্ধ জলাশয় বা ডোবায় পরিণত হয়। পরে সেটি বালু দিয়ে ভরাট করে সেখানে দালান বানানো হয়। জলাধার ভরাট করে নির্মাণ করা ঘরের ভেতরে এখন জল। খাল ভরাট করে নির্মাণ করা রাস্তার উপরে এখন হাঁটু পানি। চাইলে নৌকাও চালানো যায়।
নদীমাতৃক দেশের সমস্ত যোগাযোগ এখন সড়কনির্ভর। গ্রামাঞ্চলের ছোট ছোট নদী ও খালগুলোয় এখন আর নৌকা চলে না। উদ্ভট নকশায় এমন সব বক্স কালভার্ট বানানো হয়েছে যে, তার নিচ দিয়ে ডিঙি নৌকাও চলে না। উপরন্তু ওই কালভার্ট ও ছোট ছোট সেতু বানাতে গিয়ে নদী ও খালের প্রস্থ কমিয়ে ফেলা হয়েছে। ফলে কমেছে তার প্রবাহ। কোনো একটি জলাধার, সেটি হোক নদী কিংবা খাল- তাতে পানির প্রবাহ বাধাপ্রাপ্ত হলে তার নিচে পলি ও মাটি জমতে জমতে গভীরতা কমে যায়। গভীরতা কমে গেলে সে আর অতি বৃষ্টি কিংবা বন্যার পানি ধরে রাখতে পারে না। উপচে পড়ে।
সেই পানি তখন গিয়ে প্রবেশ করে মানুষের ঘরের ভেতরে। অর্থাৎ যে উন্নয়নের জন্য নদী-খাল-পুকুর-জলাশয় ও ফসলের জমি ভরাট করা হলো-সেই উন্নয়নের খেসারত দিতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে। তারা এখন খাটের ওপরে বসে থাকে। কেননা তার ঘরে গোড়ালিসমান পানি। অর্থাৎ বাড়ির আশেপাশের পুকুর, খাল, জলাধার ও নিচু জায়গা এমনকি ফসলি জমি বালু দিয়ে ভরাট করে রাস্তা বানাবেন, বাড়ি বানাবেন, সরকারি অফিস বানাবেন, কল-কারখানা বানাবেন আর তার ফলে অতি বৃষ্টি ও জলোচ্ছ্বাসের পানি ঘরের ভেতরে উঠে গেলে বলবেন এটি জলবায়ু পরিবর্তনের ফল- তার সুযোগ নেই। বরং এটি মানুষের পাপের শাস্তি। আপনি জলাধার মারবেন, তো জল আপনাকে মারবে। হিসাব পরিষ্কার। প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক দেবেশ রায়ের ‘তিস্তাপুরাণ’ উপন্যাসের একটি সংলাপ এরকম: ‘নদীকে তুমি মনে না রাখলে, নদী তোমাকে মনে রাখে। নদী ভুলে তুমি যদি পথে পা দাও, নদী তাহলে তোমার পথে উঠে আসবে।’
ঘূর্ণিঝড় রিমালের কারণে ভারী বৃষ্টিতে চট্টগ্রাম নগরের বিভিন্ন এলাকা পানিতে তলিয়ে যায়। বিভিন্ন স্থানে তৈরি হয় জলাবদ্ধতা। চলতি মৌসুমে এ নিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো জলাবদ্ধতার শিকার হয় বন্দর নগরী। চকবাজার, ডিসি সড়ক, কে বি আমান আলী সড়ক, বাকলিয়া, দুই নম্বর গেট, মুরাদপুর, বহদ্দারহাট, মেহেদীবাগ, চান্দগাঁও আবাসিক এলাকা, প্রবর্তক মোড়, কাপাসগোলা, কাতালগঞ্জ, এম এম আলী সড়ক, হালিশহরসহ বিভিন্ন এলাকায় জলাবদ্ধতা দেখা দেয়। এর জন্য ঘূর্ণিঝড় রিমালের প্রভাবে ভারী বৃষ্টিই কি শুধু দায়ী? অপরিণামদর্শী উন্নয়ন কর্মকাণ্ডও কি এর জন্য দায়ী নয়? বছরের পর বছর ধরে রাস্তা ও ভবন বানাতে গিয়ে চট্টগ্রাম শহরের পানি প্রবাহের খালগুলো ভরাট করা হয়েছে। দখল করা হয়েছে। দূষণে বিপর্যস্ত হয়েছে। ফলে এখন একটু বেশি বৃষ্টি হলেই জলাবদ্ধতায় নাকাল হতে হয় দেশের দ্বিতীয় প্রধান এই মহানগরীর মানুষকে। সুতরাং এর জন্য শুধু ঘূর্ণিঝড়, অতিবৃষ্টি কিংবা বন্যাকে দায়ী করে লাভ নেই। কেননা দুর্যোগপ্রবণ দেশ হিসেবে বাংলাদেশে এরকম প্রাকৃতিক দুর্যোগ হবেই। কিন্তু সেই দুর্যোগ মোকাবিলার পথও খোলা রাখতে হবে। পানি উঠবে। কিন্তু সেই পানি দ্রুত নেমে যাওয়ার রাস্তা পরিষ্কার রাখতে হবে। কিন্তু তা রাখা হয়নি। ফলে জলাবদ্ধতাই এখন এই নগরীর ভবিতব্য। ভবিষ্যতে এই দুর্ভোগ যে আরও বাড়বে তাতে সন্দেহ কম।
একই অবস্থা রাজধানী ঢাকারও। চারপাশে বেড়িবাঁধ দিয়ে শহর সুরক্ষিত করা হয়েছে এটা যেমন ঠিক, তেমনি অতি বৃষ্টির কারণে বিভিন্ন এলাকা থেকে দ্রুত পানি সরে যাওয়ার জন্য যেসব খাল ছিল সেগুলো দখল হয়ে গেছে। কিছু খাল উদ্ধার করা গেলেও বিরাট অংশই এখনও বেদখল। ফলে ভবিষ্যতে এই জাতীয় দুর্যোগ যদি আরও বাড়ে তখন রাজধানীবাসীকে দীর্ঘমেয়াদি জলাবদ্ধতায় নাকাল হতে হয় কি না- সেটি বিরাট প্রশ্ন। অর্থাৎ বাংলাদেশকে যখন দুর্যোগ মোকাবিলায় রোলমডেল বলা হচ্ছে; যখন ঘূর্ণিঝড়ে প্রাণহানি অনেক কমিয়ে আনা সম্ভব হচ্ছে; যখন দুর্যোগের বেশ আগে থেকেই মানুষকে সতর্ক করা এবং পরিস্থিতি মোকাবেলায় নানা ধরনের প্রস্তুতি নেয়া সম্ভব হচ্ছে- তখন নতুন উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে জলাবদ্ধতা, যার জন্য দায়ী প্রধানত জলাধার ও নিচু এলাকা ভরাট করে রাস্তাঘাটসহ নানা ধরনের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড। অথচ এইসব উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের পরিকল্পনা প্রণয়নের সময়েই পানি প্রবাহের পথ যাতে কোনোভাবে ব্যহত না হয়, সেটি বিবেচনায় নেয়া উচিত ছিল।
সমাধান কী?
১. বালু দিয়ে পুকুর নদী খাল জলাশয় ভরাট করা আইন করে নিষিদ্ধ করতে হবে। অর্থাৎ জলাধার ভরাট করার বিষয়টি সহজলভ্য রাখা যাবে না।
২. দখল হয়ে যাওয়া খাল ও ছোট নদীগুলোর নাব্যতা ফিরিয়ে আনতে কার্যকর ড্রেজিং ও খনন করতে হবে। নদী খননের টাকা যাতে নদীতেই চলে না যায় সেটি নিশ্চিত করতে হবে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকারের শূন্য সহনশীল নীতির নির্মোহ বাস্তবায়ন হতে হবে।
৩. নতুন করে কোনো পুকুর, সেটি ব্যক্তি মালিকানাধীন হলেও ভরাট নিষিদ্ধ করতে হবে।
৪. কোনো নিচু এলাকা ও ফসলের জমি ব্যক্তি মালিকানাধীন হলেও সেখানে কোনো ধরনের অবকাঠামো নির্মাণ নিরুৎসাহিত করতে হবে। যারা বিকল্প নেই বলে ফসলি জমি ও জলাধার ভরাট করে বাড়ি নির্মাণ করতে চান, তাদের জন্য রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে উত্তম বিকল্পের ব্যবস্থা করতে হবে।
৫. জলাধার, পুকুর, নিচু এলাকা ও ফসলি জমি সুরক্ষায় কঠোর আইন প্রণয়ন এবং তার প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে।
৬. আধুনিক নগর পরিকল্পনায় এখন গড়ে তোলা হচ্ছে ‘স্পঞ্জ সিটি’। যে শহর স্পন্জের মতো পানি শুষে নেবে। শহরের ভেতরে নদী নালা জলাশয় তৈরি করে এ ধরনের শহর গড়ে তোলা প্রয়োজন।
৭. জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ভবিষ্যতে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ বাড়বে বলে বিজ্ঞানীরা সতর্ক করছেন। সুতরাং সেই বাস্তবতা মাথায় রেখে নগর পরিকল্পনা করতে হবে। প্রয়োজনে বিদ্যমান অনেক অবকাঠামো ভেঙে ফেলতে হবে।
৮. খাল-নদী-পুকুর-জলাশয় ভরাট করে নির্মিত অবৈধ ভবনগুলো পক্ষপাতহীনভাবে ভেঙে ফেলে সেখানে জলাধার নির্মাণ করতে হবে।
৯. উপকূলের ঘরবাড়িগুলো আরও উঁচু করে নির্মাণ করতে হবে। যেসব বাড়িঘর এরই মধ্যে নির্মিত হয়ে গেছে কিন্তু জলাবদ্ধতার ঝুঁকিতে রয়েছে, সেগুলো উঁচু করা তথা সংস্কারের জন্য সরকার বিনা সুদে বা সহজ শর্তে স্বল্প আয়ের মানুষদের ঋণ দিতে পারে।
এখনই এসব উদ্যোগ গ্রহণ করা না হলে ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের জন্য ঘূর্ণিঝড়, ভূমিকম্প, অতিবৃষ্টি বা বন্যা নয়- বরং জলাবদ্ধতাই হবে প্রধান দুর্যোগ, যার হাত থেকে শহর ও নগর তো বটেই- গ্রামাঞ্চলও বাঁচানো যাবে না।
আমীন আল রশীদ: সাংবাদিক ও লেখক
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে