Views Bangladesh Logo

অমর একুশে বইমেলা: বঙ্গবন্ধু সম্পর্কিত বই নিয়ে এবার কী হবে?

Amin Al  Rasheed

আমীন আল রশীদ

বাঙালির প্রাণের মেলা ও প্রাণের উৎসব বললে যে দুটি আয়োজনের কথা আমাদের চোখে ভাসে, তার একটি অমর একুশে বইমেলা- যেটি প্রতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসজুড়ে চলে বাংলা একাডেমি এবং সংলগ্ন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। অন্যটি পয়লা বৈশাখ। পয়লা বৈশাখের কিছু আয়োজন নিয়ে রাজনৈতিক ও সামাজিক বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে মতভিন্নতা থাকলেও বইমেলার প্রশ্নে কোনো বিভক্তি নেই। কেননা এই আয়োজন ও উৎসবের সঙ্গে কোনো ধর্ম বা রাজনীতির গন্ধ নেই। বইমেলার ভেতরে মাঝে-মধ্যে কিছু রাজনৈতিক গন্ধ ছড়ানো হলেও বা যখন যে সরকার ক্ষমতায় থাকে তাদের কিছু প্রভাব থাকলেও সামগ্রিকভাবে বইমেলাকে দল-মত-ধর্ম ও বয়স নির্বিশেষে সব মানুষের প্রাণের মেলা বলে স্বীকার করে নিতে কারো দ্বিধা নেই। এমনকি একুশের চেতনায় গড়ে ওঠা এই আয়োজনকে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সাংস্কৃতিক উৎসব বললেও ভুল হবে না।

অমর একুশে বইমেলা ১৯৮৬। ছবি: সংগৃহীত


বস্তুত বাংলা একাডেমির আয়োজনে এই মেলাকে কেন্দ্র করেই দাঁড়িয়ে আছে দেশের প্রকাশনা শিল্প। পাঠ্যপুস্তকের বাইরে সৃজনশীল ও মননশীল বই সারা বছর খুব বেশি বিক্রি হয় না। সরকারি ক্রয় তালিকায় থাকা কিছু বই বিক্রি হয় বটে, সেটি সামগ্রিক বিক্রির তুলনায় খুবই কম। ফলে প্রকাশকরা সারা বছর ফেব্রুয়ারি মাসের জন্য অপেক্ষায় থাকেন।

পাঠক সৃষ্টিতেও বইমেলার রয়েছে দারুণ ভূমিকা। সেইসঙ্গে বইমেলা লেখক সৃষ্টিতেও অবদান রাখে। সব মিলিয়ে লেখক-পাঠক ও প্রকাশকের এটি দারুণ মেলবন্ধন তৈরি করে অমর একুশে বইমেলা- যা সামগ্রিকভাবে দেশের জ্ঞান ও সৃষ্টিশীল জগৎকে প্রভাবিত করে। বইমেলায় প্রতি বছর হাজার হাজার নতুন বই প্রকাশিত হয়। কোটি কোটি টাকার বই মেলায় বিক্রি হয়। ফলে এর একটি অর্থনীতিও রয়েছে।

ধর্ম ও দল-মত নির্বিশেষে বাঙালির সবচেয়ে বড় উৎসব এই অমর একুশে বইমেলা- যেখানে ফেব্রুয়ারি মাসজুড়ে প্রাণের সম্মিলন ঘটে। বহু দল, আদর্শ, মত ও পথের মানুষকে একটি জায়গায় এসে জড়ো হওয়ার সুযোগ পায়। যেখানে একই সঙ্গে আছে জ্ঞান, চিন্তা, দর্শন, বিনোদন। শুধু বই কেনা কিংবা পাঠকের সঙ্গে লেখকের মিথস্ক্রিয়াই নয় বরং শুধু বন্ধু-পরিজনের সঙ্গে একটু সুন্দর সময় কাটানোর জন্যও লাখ লাখ মানুষ এখানে আসেন। যে কারণে এটিকে বলাই হয় প্রাণের মেলা।

২০০৭ সালের বইমেলায় নন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের ‘আজ হিমুর বিয়ে’ উপন্যাসের প্রকাশনা উৎসব। ছবি: সংগৃহীত


দলীয় স্টল থাকবে?
দলীয় সরকারের আমলে অনুষ্ঠিত বইমেলায় বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণের একটি বড় জায়গাজুড়ে থাকে ক্ষমতাসীন দলের বিভিন্ন অঙ্গ ও সহযোগী এমনকি তাদের পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে ওঠা বিভিন্ন সংগঠনের স্টল- যেখানে দলীয় আদর্শের বিভিন্ন বইপত্র থাকে। এসব স্টলে বই বিক্রির চেয়ে সংগঠনের ব্র্যান্ডিংটাই মুখ্য। এবার যেহেতু একটি নির্দলীয় সরকার ক্ষমতায় আছে, ফলে আশা করা যায় কোনো রাজনৈতিক দলের স্টল বা প্যাভিলিয়ন থাকবে না। তবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ কোনো রাজনৈতিক দল বা সংগঠনের স্টল থাকাটা অস্বাভাবিক নয়। যদি এই ধরনের স্টল এবার না থাকে বা আগের চেয়ে অনেক কম থাকে, তাহলে বাংলা একাডেমি চত্বরের অনেকখানি জায়গা চাইলে ফাঁকা রাখা যাবে- যাতে পাঠক-দর্শকের চলাচলে সুবিধা হয়।

১৯৯০ সালের বইমেলায় পুরস্কারপ্রাপ্ত বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের স্টল। ছবি: সংগৃহীত


বঙ্গবন্ধুর বই নিয়ে কী হবে?
অতীতে বিভিন্ন সময়ে বইমেলায় বিভিন্ন লেখকের বই নিয়ে প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানকে নানাবিধ বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হয়েছে। কোনো কোনো স্টল থেকে নির্দিষ্ট লেখকের বই তুলে নেয়া, নির্দিষ্ট কোনো বই বিক্রিতে নিষেধাজ্ঞা, প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানকে নানাবিধ চাপ ও ভয়-ভীতির মধ্যে রাখার ঘটনা ঘটেছে। এবারও কি সেই ধারাবাহিকতা বজায় থাকবে?

আওয়ামী লীগের গত ১৫ বছরের আমলে বইমেলায় বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে যে বিপুল বইপত্র প্রকাশিত হয়েছে, এবার কি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানগুলো সেই বইগুলো মেলায় প্রদর্শন করতে পারবেন নাকি এ ধরনের বই প্রকাশের ব্যাপারে মেলা কর্তৃপক্ষ অলিখিত নিষেধাজ্ঞা দেবে নাকি প্রকাশকরাই নিজেরাই এক ধরনের সেলফ সেন্সরশিপ আরোপ করে এ ধরনের বই মেলায় প্রদর্শন থেকে বিরত থাকবেন? বইয়ের কাভারে বঙ্গবন্ধুর ছবি আছে, এ ধরনের বইয়ের যদি একাডেমিক ঐতিহাসিক মূল্য থাকে, তারপরও কি প্রকাশরা এইসব বই এবার সাচ্ছন্দ্যে প্রদর্শন করতে পারবেন?

শঙ্কাটা এ কারণে যে, সম্প্রতিক একটি অনুষ্ঠানে দেশের একটি খ্যাতনামা প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার বলেছেন, তার প্রতিষ্ঠান একটি বই প্রদর্শনীর আয়োজন করেছিল। তারা যেহেতু বাংলাদেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য ও রাজনীতি সম্পর্কিত বই বেশি প্রকাশ করেন, সংগত কারণেই তাদের কিছু বইয়ের প্রচ্ছদে বঙ্গবন্ধুর ছবি রয়েছে; কিন্তু একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী ওই প্রদর্শনীতে গিয়ে বলেছেন, বঙ্গবন্ধু ছবিসম্বলিত বইগুলো প্রদর্শন করা যাবে না। এ নিয়ে তার সঙ্গে শিক্ষার্থীদের উচ্চবাচ্য হলেও শেষ পর্যন্ত তাকে বইগুলো সরিয়ে ফেলতে হয়। সুতরাং বইমেলায়ও যে এরকম ঘটনা ঘটবে না, তা বলা কঠিন।

বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক মোহাম্মদ আজম


এই প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছিলেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক মোহাম্মদ আজম। সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘জাতি, ইতিহাস ও নীতিবিরুদ্ধ বইয়ের ব্যাপারে সতর্ক থাকবে বাংলা একাডেমি। বঙ্গবন্ধুর বই প্রদর্শন করা যাবে না, এমন কোনো নির্দেশনা নেই। কিন্তু কোনো প্রকাশক যদি নিজে থেকে বঙ্গবন্ধুর বই প্রদর্শন বা বিক্রি থেকে বিরত থাকেন, সেখানে একাডেমি আগ বাড়িয়ে কিছু বলবে না বা তাকে বাধাও দেবে না।’
কোনো প্রকাশক যদি বঙ্গবন্ধুবিষয়ক কোনো বই বিক্রি বা প্রদর্শন করতে গিয়ে নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন, তাহলে একাডেমি তাকে সুরক্ষা দেবে কি না- সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে মহাপরিচালক বলেন, ‘একাডেমি কাউকে সুরক্ষা দেয়ার দেয়ার প্রতিষ্ঠান নয়। তবে সুরক্ষা দেয়ার দায়িত্ব যাদের, তাদের কাছে বাংলা একাডেমি কনসার্ন জানাবে। কেননা বাংলা একাডেমি পুলিশি প্রতিষ্ঠান নয়।’ তিনি বলেন, যেসব সংকট তৈরি হতে পারে বলে তারা ধারণা করছেন, তার সবগুলো নিয়েই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে অনেকগুলো বৈঠক করেছেন। (চ্যানেল আই, ০১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫)।

মহাপরিচালকের এই কথার মধ্যে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ ইঙ্গিত আছে। যেমন তিনি বলছেন, কোনো প্রকাশক যদি নিজেই বঙ্গবন্ধুবিষয়ক বই প্রদর্শন না করেন। অর্থাৎ একধরনের সেলফ সেন্সরশিপ যদি আরোপ করেন, তাহলে সেখানে একাডেমির কিছু করার নেই। তার কথা খুব পরিষ্কার। তিনি বলেছেন, জাতি, ইতিহাস ও নীতিবিরুদ্ধ বইয়ের ব্যাপারে তারা সতর্ক থাকবেন। প্রশ্ন হলো, কোন বইগুলো জাতি, ইতিহাস ও নীতিবিরুদ্ধ- সেটি কে ঠিক করবে বা এর মানদণ্ড কী?

বিগত বছরগুলোয় যেমন বইমেলার একটি বিরাট জায়গাজুড়ে বঙ্গবন্ধু সম্পর্কিত বই ছিল, এবার রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের ফলে যে ঠিক তার বিপরীত হবে, অর্থাৎ বঙ্গবন্ধু সম্পর্কিত বইয়ের ওপর যে এক ধরনের অলিখিত নিষেধাজ্ঞা থাকবে এবং প্রকাশকরা নিজেরাও ভয়ে এ ধরনের বই মেলায় প্রদর্শন করে কোনো ধরনের ঝামেলায় যেতে চাইবেন না- তা চোখ বন্ধ করেই বলে দেয়া যায়। এই শঙ্কাটা আছে আরও একটি কারণে। সেটি হলো, এবার মেলার স্টল বরাদ্দের সময়েই বিগত সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা এবং ওই আমলে সুবিধা নিয়েছেন এই অভিযোগ বেশ কিছু প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানকে স্টল বা প্যাভিলিয়ন না দেয়ার দাবি জানানো হয়েছিল প্রকাশকদেরই একটি অংশের তরফ থেকে। শেষমেশ একটি খ্যাতনামা প্রতিষ্ঠানকে সম্ভবত স্টল বা প্যাভিলিয়ন দেয়া হয়নি। অনেককে বিগত বছরগুলোর তুলনায় ছোট পরিসর দেয়া হয়েছে। এ নিয়ে বাংলা একাডেমির সঙ্গে প্রকাশকদের হট্টগোল হয়েছে বলেও শোনা যায়।

১৯৮৮ সালের বইমেলা প্রাঙ্গনে বক্তৃতা দিচ্ছেন ভাষাসৈনিক গাজীউল হক। ছবি: সংগৃহীত


প্রকাশককে দলীয় কর্মী হতে হবে কেন?
প্রশ্ন হলো, একজন বইয়ের প্রকাশক যেহেতু সৃজনশীল ব্যবসা করেন, জাতির জ্ঞান বিকাশ এবং মেধা ও মনন গঠনে ভূমিকা রাখেন, সেখানে তাকে আওয়ামী লীগ কিংবা আওয়ামীবিরোধী হতে হবে কেন? তিনি একজন প্রকাশক- এই পরিচয়টাই কি যথেষ্ট নয়? বাস্তবতা হলো, বছরের পর বছর ধরে আমাদের পুরো সমাজটি রাজনৈতিকভাবে এতটাই দ্বিধাবিভক্ত হয়ে গেছে যে, এখন একজন প্রকাশককেও তার বইয়ের বিক্রি বাড়ানো জন্য ‘আওয়ামী লীগ’ হতে হয়েছে।

এখন তার উল্টো অনেকেই নিজেদেরকে ‘আওয়ামী লীগবিরোধী’ প্রমাণ করে বাড়তি সুবিধা বা রাষ্ট্রীয় আনুকূল্য নিতে চাইছেন। জাতির জ্ঞান বিকাশ নিয়ে যারা কাজ করেন, সেই ব্যবসাটিও যে দলীয় রাজনীতির প্রভাবমুক্ত থাকতে পারলো না- তার ফলে প্রশ্ন ওঠে, এই যে বছরের পর বছর ধরে বাংলা একাডেমি ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের বিশাল জায়গাজুড়ে মাসব্যাপী অমর একুশে বইমেলা হয়; প্রতি বছর হাজার হাজার বই প্রকাশিত হয় এবং কোটি কোটি টাকার বই বিক্রি হয়- তার মধ্য দিয়ে জাতির মেধা ও মননে, তার চিন্তা ও বোধে কী পরিবর্তন এলো?

আমীন আল রশীদ: সাংবাদিক ও লেখক।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ