এই ‘টেকসই নবায়নযোগ্য জ্বালানি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ’ নিয়ে আমরা কী করব!
দেশে নবায়নযোগ্য শক্তির বিকাশে সরকার ‘টেকসই ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ’ (স্রেডা) গঠন করেছে। এই প্রতিষ্ঠানটি নবায়নযোগ্য জ্বালানির বিকাশ নিয়ে কাজ করছে। গত ১১ মার্চ সংস্থাটি একটি গবেষণাপত্র উপস্থাপন করে। সেই গবেষণায় বলা হয়েছে, দেশের জীবাশ্ম জ্বালানি এবং বিদ্যুৎচালিত সেচ পাম্পগুলো সৌরচালিত সেচ পাম্পে রূপান্তরের জন্য ৬৬ বিলিয়ন ডলারের প্রয়োজন। পরিকল্পনায় দেখানো হয়েছে ২০৩১ সালের মধ্যে ১৭ লাখ পাম্পকে সৌর বিদ্যুৎচালিত করার পরিকল্পনা করছে স্রেডা।
দুর্ভাগ্যজনক বিষয় হচ্ছে, স্রেডার সৌর সেচ পাম্প বসানোর এই পরিকল্পনা কি আদতে টেকসই? এক ডলার সমান ১৩০ টাকা হলে এক বিলিয়ন ডলার টাকার অঙ্কে দাঁড়ায় ১৩ হাজার কোটি টাকা। এখন ১০০ মেগাওয়াট সৌর বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করতে গড়ে ১ হাজার কোটি টাকা প্রয়োজন। অর্থাৎ এক বিলিয়ন ডলার দিয়ে ১ হাজার ৩০০ মেগাওয়াট সৌর বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ (উৎপাদন?) সম্ভব। আর যদি পুরো ৬৬ বিলিয়ন ডলারের হিসাব করা হয়, তাহলে ৮৫ হাজার ৮০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব।
আমাদের দেশে গ্রীষ্মকালে সর্বোচ্চ বিদ্যুতের চাহিদা ১৬ হাজার মেগাওয়াট। এই ১৬ হাজার মেগাওয়াটের মধ্যে আবার ২ হাজার মেগাওয়াট সেচের বিদ্যুৎ রয়েছে। অর্থাৎ আমরা যদি শতভাগ বিদ্যুৎ নবায়নযোগ্য জ্বালানি দিয়ে উৎপাদন করি, তাহলেও ৬৬ বিলিয়ন ডলার প্রয়োজন পড়বে না। তবে এ মুহূর্তে শত ভাগ বিদ্যুৎ নবায়নযোগ্য জ্বালনি থেকে উৎপাদনের চিন্তা করা মোটেই উচিত নয়। এর জন্য শুধু বাংলাদেশ নয়, কোনো দেশই প্রস্তুত নয়। হয়তো প্রযুক্তির উৎকর্ষ আগামী সময়ে মানুষকে নবায়নযোগ্য উৎস থেকে শতভাগ বিদ্যুৎ উৎপাদনে বাধ্য করবে। অথবা জীবাশ্ম জ্বালানির অপর্যাপ্ততায় মানুষের আর উপায় থাকবে না।
স্রেডা নানারকম পরিকল্পনা করে প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি উপদেষ্টা ড. তৌফিক ই ইলাহী চৌধুরী বীরবিক্রম এবং বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদের কাছে উপস্থাপন করল। স্রেডার এই পরিকল্পনা মন দিয়ে শোনার পর উপদেষ্টা এবং মন্ত্রী দুজনই বলেছেন, এ টাকার সংস্থান করা সম্ভব না। তবে এই পরিকল্পনার দুর্বল দিকগুলো নিয়ে কেউ কথা বলেননি।
পরিকল্পনা ঐকিক নিয়মের অঙ্ক কষে করা যায় না। স্রেডা এই পরিকল্পনা করতে গিয়ে তাই করেছে, যা মোটেই উচিত হয়নি। গবেষণাপত্রটি দেখে যা মনে হয়েছে, স্রেডা চিন্তা করেছে একটি পাম্প বসাতে কত খরচ হয়, তাহলে এতগুলো পাম্প বসাতে কত খরচ হবে? একেবারে গুণের নামতা পড়েই এই ৬৬ বিলিয়ন ডলার আবিষ্কৃত হয়েছে।
বিষয়গুলো একটু তলিয়ে দেখা প্রয়োজন। এখন কৃষক জমিতে সেচ পাম্প দিয়েই পানি দেন। এ জন্য শুধু পাম্প নয়, পানি সরবরাহের জন্য একটি ব্যবস্থা তাদের নিশ্চয় রয়েছে। যুগ যুগ ধরে কৃষক সেচ ব্যবস্থায় যে বিনিয়োগ করেছে, স্রেডা এখন সৌর পাম্প বসাতে গিয়ে তার পুরোটা বাতিল করে দিতে পারে না। নাকি বাদ দিয়ে দেয়া উচিত?
কৃষক পাম্প বসাতে গিয়ে বোরিং করেছে। অর্থাৎ মাটির নিচে পানির নির্দিষ্ট স্তর পর্যন্ত পাইপ বসিয়েছে। সেখানে পাম্প কিনে বসিয়েছে। এখন সৌর পাম্প বসাতে গিয়ে কি তিনি আবারও একই কাজ করবেন?
স্রেডার ঐকিক নিয়মের অঙ্কে বলা হচ্ছে, ৪ কিলোওয়াট আওয়ার থেকে ২৫ কিলোওয়াট আওয়ার বিদ্যুৎ ব্যবহারের পাম্পগুলো বসাতে ৩ হাজার ৩০০ ডলার থেকে ৪ হাজার ৭০০ ডলার পর্যন্ত অর্থ ব্যয় হবে। তাহলে এ ধরনের ১৭ লাখ পাম্প বসাতে খরচ হবে কত? উত্তর ৬৬ বিলিয়ন ডলার। যে প্রতিষ্ঠানের নামের আগে ‘টেকসই’ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে, সেই প্রতিষ্ঠানের জন্য এভাবে অঙ্ক কষে উত্তর বের করে পরিকল্পনা করা কি সাজে?
সেচের সব বিদ্যুৎ যদি সৌরশক্তি থেকে উৎপাদন করাকেই শ্রেয় মনে করা হতো তাহলে স্রেডা সরকারকে পরামর্শ দিতে পারতো ২০০০ মেগাওয়াট সৌর বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের জন্য। এখন যেহেতু দেশের সব এলাকায় বিদ্যুৎ পৌঁছে গেছে তাই গ্রিড থেকেই বিদ্যুৎ নিয়ে দিনেরবেলা সেচ কাজ চালানো সম্ভব ছিল। সেক্ষেত্রে এসব বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে সর্বোচ্চ ব্যয় হতো দেড় থেকে দুই বিলিয়ন ডলার।
স্রেডা এই পরিকল্পনা করতে গিয়ে বলছে, ৬৬ বিলিয়ন ডলারের মধ্যে সরকার ঋণ বা অনুদান হিসেবে কৃষককে ৩৩ বিলিয়ন ডলার দেবে। বাকি ৩৩ বিলিয়ন ডলার কৃষক নিজের পকেট থেকে দেবে। এ ধরনের সেচযন্ত্র বসাতে সোলার প্যানেল, পাম্পসহ যেসব যন্ত্রাংশ প্রয়োজন, তার পুরোটা আমদানিনির্ভর। অর্থাৎ সরকার এবং কৃষকে এই অর্থ পরিশোধ করতে হবে। আর বাংলাদেশ ব্যাংককে এই অর্থ ডলারে রূপান্তর করে দিতে হবে।
স্রেডা বলছে ২০২৩ থেকে ২০৩১ সাল পর্যন্ত, অর্থাৎ ৯ বছরে এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হবে। অর্থাৎ স্রেডার হিসাব ধরলে বছরে ৭ দশমিক ৩৩ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ প্রয়োজন হবে। যখন সরকার ডলার সংকটে জ্বালানি আনতে হিমশিম খাচ্ছে ঠিক এই সময়ে এমন পরিকল্পার অর্থ কী?
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে