আমাদের চিন্তাচর্চা ও বুদ্ধিবৃত্তিক আড্ডাগুলো কেন হারিয়ে যাচ্ছে?
এক সময় আমাদের আড্ডা হতো হাটে-মাঠে-ঘাটে। টিনের চালে বসে পায়রার ঝাঁক যেমন সারা দুপুর বাকবাকুম গান শুনাতো, তেমন করে কাজের অবসরে মানুষরা মেতে উঠতেন গালগল্পে। আড্ডায় বসলে আমাদের মন উড়তে থাকত হাওয়ায় হাওয়ায়। বুদ্ধদেব বসু তার বিখ্যাত ‘আড্ডা’ প্রবন্ধে বলেছিলেন, ‘আড্ডার ঠিক প্রতিশব্দটি পৃথিবীর অন্য কোনো ভাষাতেই আছে কি? ভাষাবিদ না-হয়েও বলতে পারি, নেই; কারণ আড্ডার মেজাজ নেই অন্য কোনো দেশে, কিংবা মেজাজ থাকলেও যথোচিত পরিবেশ নেই। অন্যান্য দেশের লোক বক্তৃতা দেয়, রসিকতা করে, তর্ক চালায়, ফুর্তি করে রাত কাটিয়ে দেয়; কিন্তু আড্ডা দেয় না।’
আসলেই তাই। আড্ডার মতো এমন প্রাণস্পন্দন আর কোথাও পাওয়া যায় না। এখানে সবাই সমান, একটু যদি উনিশ-বিশ হয় তাহলে আর আড্ডা জমে না। আড্ডায় যা খুশি বলা যায়, কেউ কোনো কিছুর বাছ-বিচার করে না। তাই বলে পরিমিতি বোধও যে নেই, তাও নয়, তাও অলিখিত, এবং বেখায়ালেই নির্ধারিত এবং কখনো যদি মাত্রাবোধ ছাড়িয়েও যায় তাও যেন গ্রাহ্য। আর আড্ডায় এমন কোনো বিষয় নেই, যা নিয়ে তর্কে মেতে ওঠা যায় না। মশা-মাছি, হাতিঘোড়া মারা থেকে রাজা-উজির মারা সবই চলতে থাকে সমান তালে। তাই আড্ডাই অনেকেরই শ্রেষ্ঠ স্কুল, শ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয়।
বুদ্ধদেব বসু লিখেছিলেন, ‘ছেলেবেলা থেকে এই আড্ডার প্রেমে আমি আত্মহারা। সভায় যেতে আমার বুক কাঁপে, পার্টির নামে দৌড়ে পালাই, কিন্তু আড্ডা! ও না-হলে আমি বাঁচি না। বলতে গেলে আড্ডার হাতেই আমি মানুষ। বই পড়ে যা শিখেছি তার চেয়ে বেশি শিখেছি আড্ডা দিয়ে।
একেক বয়সি একেক পেশার মানুষের আড্ডার অভিজ্ঞতা একেক রকম। ছোটদের, তরুণদের আর বুড়োদের আড্ডা যেমন একরকম নয়, কৃষক-শ্রমিক-তাঁতি-কামার-কুমোর আর ছাত্র-শিক্ষক-বুদ্ধিজীবী-কবি-সাহিত্যিক-শিল্পীদের আড্ডাও একরকম নয়।
কালে কালে আড্ডার রূপ ও স্থান বদলে গেছে অনেক। পঞ্চাশ-ষাট দশকে ছাত্র-শিক্ষক, কবি-সাহিত্যিক, শিল্পী, রাজনীতিবিদরা আড্ডা দিতেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনে। দেশভাগের পর রাজধানী ঢাকার শিল্প-সাহিত্য ও রাজনীতির তীর্থকেন্দ্র হয়ে উঠেছিল মধুর ক্যান্টিন। অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম লিখেছেন, ‘১৯৪৮-এর ১১ মার্চ এবং ১৯৫২-এর ২১ ফেব্রুয়ারির কার্যক্রমের সব পরিকল্পনা এবং প্রস্তুতি এই মধুর ক্যান্টিনে বসেই নেয়া হয়েছিল। স্বাভাবিকভাবেই পুলিশ এবং ইপিআর বাহিনীর চোখে পড়ে যান মধু। এদের আক্রমণে বহুবার মধুর ক্যান্টিনে ধ্বংসযজ্ঞ চলেছে।’
স্বাধীনতার পর পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য আড্ডাস্থল হয়ে দাঁড়ায় শরিফ মিয়ার ক্যান্টিন। শরীফ মিয়ার ক্যান্টিন নিয়ে লেখক আফসান চৌধুরী এক লেখায় লিখেছেন, ‘শরিফ মিয়ার ক্যান্টিন আমাদের যা দিয়েছে, তা নিয়ে আজ কোথাও কোনো কিছু উচ্চারিত হয় না। আজকের সময়ে দাঁড়িয়েও সগর্বে বলতে পারি, আমি শরীফ মিয়ার ক্যান্টিন থেকে যা শিখেছি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও তা শিখিনি।’
শুধু কবি-সাহিত্যিক-শিল্পী-ছাত্র-শিক্ষক নয়, আড্ডায় মেতে উঠতেন খেটে-খাওয়া সাধারণ মানুষও। সারা দিনের কাজ শেষে গাছের ছায়ায়, পাড়ার চায়ের দোকানে বসে তারা সারা দিনের কর্মভার লাঘব করতেন অবিরল কলকাকলিতে। কী ছিল তাদের আড্ডার বিষয়? দৈনন্দিন সুখ-দুঃখ, প্রাত্যহিক টানাপোড়েনের কথা, কখনো একটু-আধটু পরনিন্দা-পরচর্যা। রাজনৈতিক আলাপও ছিল। যদিও আশির দশকের পর বিভিন্ন চায়ের দোকানে, হোটেলে, এমন কি বাসেও এই সতর্কবাণী লক্ষ্য করা যায়- ‘রাজনৈতিক আলাপ নিষিদ্ধ’।
আড্ডার কথা মনে হলেই সবার প্রাণের ভেতর বেজে উঠবে মান্না দের সেই বিখ্যাত গান, ‘কফি হাউসের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই... আজ আর নেই… কোথায় হারিয়ে গেল সোনালি বিকেলগুলো সেই...’ কফি হাউস কলকাতার বিখ্যাত আড্ডাস্থল। বিখ্যাত সব কবি-সাহিত্যিক সেখানে আড্ডা দিয়ে কাটিয়েছেন। বাংলাদেশের অনেকেরই হয়তো সেখানে এখন পর্যন্ত যাওয়ার সৌভাগ্য হয়নি; কিন্তু নব্বই-দশক পর্যন্ত এমন কোনো শহুরে শিক্ষিত তরুণ-তরুণী পাওয়া যাবে না, এই গান শুনে যিনি হাহাকার করেননি, বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে ওঠেনি। আজকের প্রজন্মের অনেকে হয়তো এই গানের মর্ম ঠিক বুঝবে না। কারণ, তাদের জীবনে কোথাও বসে আড্ডা দেয়ার অভিজ্ঞতা নেই। তাই বলে কি এখনকার তরুণ-তরুণীরা কি আড্ডা দেয় না? বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস, ক্যাফেটেরিয়া, চায়ের দোকান আর রাস্তার মোড়গুলো কি ফাঁকা পড়ে থাকে?
যাদের চোখ-কান খোলা আছে, তারা নিশ্চয়ই ইতোমধ্যে লক্ষ্য করেছেন যেখানেই পাঁচ-সাতজন তরুণ একসঙ্গে বসে থাকে, তাদের সবার হাতে ধরা থাকে অদ্ভুত একটা যন্ত্র (মোবাইল), কাছে ডাকার বদলে যা আসলে আমাদের সম্পর্কগুলোকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে, ওই আজব যন্ত্রে আজকের ছেলেমেয়েরা ভিডিও গেমস খেলে! সে যাই হোক, সবাই নিশ্চয়ই এরকম নয়। কোথাও কোথাও নিশ্চয়ই এখন খুব আড্ডা হয়। সাধারণ মানুষের সাধারণ আড্ডাগুলো এখনো আছে নিশ্চয়ই; কিন্তু আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক আড্ডাগুলো কি আর কোথাও আছে?
একসময় ঢাকার আজিজ সুপার মার্কেট ছিল চিন্তাচর্চা ও আড্ডার অন্যতম কেন্দ্রস্থল। আশির দশক থেকে এই আড্ডা গড়ে ওঠে বইয়ের দোকানগুলো কেন্দ্র করে। শিল্প-সাহিত্য অঙ্গনের এমন কেউ নেই এই আড্ডায় শরিক হতেন না। সারা দিন ধরেই আড্ডা চলত, সন্ধ্যা হলে আজিজ মার্কেটের প্রথম তলা আর দ্বিতীয় তলা গমগম করত। সিনিয়ররা বইয়ের দোকানগুলোতে বসার জায়গা পেতেন, জুনিয়দের বেশির ভাগই দাঁড়িয়েই থাকত হতো, দলবেঁধে কেউ কেউ বসে পড়ত দুতলা-তিনতলার সিঁড়িতে। আজিজ মার্কেটের নিচতলায় কয়েকটি গানের ক্যাসেট-সিডি বিক্রির দোকান ছিল। এর মধ্যে একটি ছিল ‘সুরের মেলা’। সুরের মেলায় সারাক্ষণই বাজতে থাকত ক্ল্যাসিক বা হালের কোনো জনপ্রিয় গান।
তারপর এক সময় আজিজ মার্কেটে গড়ে উঠতে থাকে কাপড়ের দোকান। বইয়ের দোকানগুলো উঠতে শুরু করে আর কাপড়ের দোকানে ভরে যেতে থাকে। সেই সঙ্গে আড্ডাও কমে যেতে থাকে। কবি-সাহিত্যিক-শিল্পীদের আড্ডা তখন গড়ায় চারুকলার সামনে ছবির হাটে। সন্ধ্যা হলেই ছবির হাটে শত শত আড্ডাবাজ উপস্থিত। এই আড্ডাটি নষ্ট করে দেয় পরিকল্পনা করেই। ছবির হাটের দোকানগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়, গেটও বন্ধ করে দেয়া হয়। ওখানে অবশ্য খুব গাঁজা খাওয়ার ধুম ও ধোঁয়াও বেড়ে গিয়েছিল।
অনেকে হয়তো জানেন না ফকিরাপুলের কাসেম চত্বরে বিনোদন সাংবাদিকদের ছোট্ট একটি সুন্দর আড্ডা হতো এক সময়। এই আড্ডাটাই শূন্য দশকের মাঝামাঝি গড়ায় শান্তিনগর মোড়ে। বিনোদন সাংবাদিকদের সঙ্গে সেখানে যুক্ত হতেন উঠতি নাট্য-পরিচালক আর নবাগত অভিনেতারাও। এই আড্ডাটি এখন আর নেই। শান্তিনগর থেকে সরে তাদের কিছু অংশ চলে গেছে শিল্পকলা একাডেমি প্রাঙ্গণে, আর বড় অংশটি জায়গা দখল করেছে এখন মগবাজার মোড়ে।
আর কবি-সাহিত্যিকের আড্ডাটি আজিজ মার্কেট ও ছবি হাট থেকে বিতাড়িত হয়ে এখন গিয়ে বসেছে কাঁটাবনের কনকর্ড টাওয়ার চত্বরে। সেখানেও গড়ে উঠেছে বড় একটা বইয়ের মার্কেট। মোটামুটি এই আমাদের ঢাকা শহরের বর্তমান বুদ্ধিবৃত্তিক আড্ডার চিত্র। এর পাশাপাশি টিএসসিতে যে আড্ডাটি হয়, সেটি আসলে ভাসমান, বিশৃঙ্খল। সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা থেকে শুরু করে বাইরের লোকজন অনেকে এসে আড্ডা দেয়, ফলে তাদের আলাদাভাবে চিহ্নিত করা কঠিন।
এক সময় ঢাকার কবি-সাহিত্যিকদের বিখ্যাত আড্ডাস্থল ছিল পুরোনো ঢাকার বিউটি বোর্ডিং। মূলত ষাট-সত্তরের কবি-সাহিত্যিকরাই এই আড্ডাস্থলটিকে জনপ্রিয় করেন কবি শহীদ কাদরি, শামসুর রাহমানকে ঘিরে। বিউটি বোর্ডিং এখনো আছে, পুরোনো হলুদ বিল্ডিংয়ের সামনে সুন্দর সবুজ গোল চত্বর নিয়ে, তরুণ-তরুণীরা সেখানে যায় ঘুরে বেড়াতে; কিন্তু আগের আড্ডা আছে এ কথা আর বলা যাবে না।
আড্ডা মানে শুধু দেখা-সাক্ষাৎ নয়, কলরব নয়, নিয়ম না থাকলেও সেখানে অলিখিত কিছু নিয়ম আছে, খাপছাড়া কথা বললেও সেখানে কিছু বিষয়ভিত্তিক আলোচনাও থাকে, শিল্প-সাহিত্য-রাজনীতি নিয়ে সিরিয়াস তর্ক-বিতর্ক থাকে। এটা এখন কিছুটা কনকর্ডে হয়ে থাকে।
দেশের অন্যান্য আড্ডাস্থলগুলো নিয়ে রাজধানীবাসীর জানার তেমন উপায় নেই। বিভিন্ন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসগুলোতে এখনো নিশ্চয়ই খুব আড্ডা হয়। কিন্তু কী সেসব আলোচনার বিষয়? বইপত্র ছাড়া, কোনো লিটল ম্যাগ, বা সিনেমা-আন্দোলন ছাড়া সৃজনশীল আড্ডা কীভাবে হতে পারে? সেসবে খবর কই?
বিশ্বসাহিত্যকেন্দ্রের পুরোনো বিল্ডিংয়ে এক সময় খুব আড্ডা হতো। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র এখন বিশাল বিল্ডিং হয়েছে। ৯ তলার ছাদে বিকেলে গেলে বসার জায়গা পাওয়া যায় না; কিন্তু আড্ডা তেমন চোখে পড়ে না। লোকজন এসে সেখানে খায়, গল্পসল্প করে; কিন্তু আড্ডার আমেজ দেখা যায় না। মাঝে মাঝে কিছু আড্ডা জমে নিচের রাস্তায়, বিশেষ করে সন্ধ্যার পর, কয়েকজন কবি-সাহিত্যিক তখন এক হন সারা দিনের কর্মব্যস্ততা শেষে।
এ লেখার মূল কেন্দ্রস্থল মূলত ঢাকার আড্ডাকে ঘিরে। ঢাকার আড্ডাগুলো হারিয়ে যাওয়ার পেছনে অনেক সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-প্রযুক্তিগত কারণ আছে। একটা বড় কারণ হিসেবে অনেকে দায়ী করেন ঢাকার তীব্র জ্যাম এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সহজলভ্যতা। জ্যামের কারণে এখন আর ঢাকার আশপাশের কবি-সাহিত্যিকরা চাইলেই কোথাও এক হতে পারেন না। আর ফেসবুকে তো সবার সঙ্গে সবার দেখা হচ্ছে প্রতি মুহূর্তে। তাই আর সরাসরি দেখা করার তাগিদটা বোধ করেন না অনেকে; কিন্তু ফেসবুকে দেখাদেখি, কিছু কথা চালাচালি হলেও আড্ডা তো ঠিক জমে না।
অথচ, পঁচিশ-ত্রিশ বছর বছর আগে আজিজে আসতো সবাই কোন বন্ধু কখন আসবে না জেনেই। তখন তো আর সবার হাতে হাতে মোবাইল ছিল না। টিঅ্যান্ডটি ফোনেও কল করার সামর্থ্য ছিল না অনেকের। অনেকে আন্দাজেই আসতো, নিছক ভাগ্যের ওপর নির্ভর করে, অথবা বন্ধুর ওপর হৃদয়ের বিশ্বাস নিয়ে, সাক্ষাতের একমাত্র জায়গাই ছিল আজিজ, আজিজে না এলে তার খোঁজ পাওয়ার আর কোনো ঠিকানাও জানা ছিল না কারও।
সারা দুপুর হয়তো কারও খাওয়াও হয়নি, পকেটে টাকা নেই, আজিজের বারান্দায় শুকনো মুখ ঘুরছে, এমন ঘনিষ্ঠ বন্ধুর সঙ্গে দেখাও হচ্ছে না, যার কাছে একটা সিগারেট বা এক কাপ চা চেয়ে খাওয়া যায়। তখন হয়তো প্রাণের বন্ধুটির সঙ্গে দেখা, আহা, সেই অনুভূতি কি ভাষায় প্রকাশ করা যায়, চাইতে হতো না, বন্ধুটি তো মুখ দেখেই বুঝতো, কীরে, কিছু খাসনি এখনো? আয়, আগে ভাত খেয়ে নেই।
মাত্র ২০ টাকা দিয়ে তিন বন্ধুর ভাগাভাগি করে ভাত খাওয়া অভিজ্ঞতা যে বন্ধুদের নেই, তারা ওই সময়টিকে ঠিক বুঝবে না। অনেক সময় জুনিয়র কবি-সাহিত্যিকরা অপেক্ষা করত সিনিয়র কবি সাহিত্যিকদের দেখা পাওয়ার জন্য। তা শুধু জ্ঞানগর্ভ আলাপ শোনার জন্যই নয়, সিনিয়র লেখকরাও বুঝতেন, এসব তরুণ কবি-সাহিত্যিক দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে ঢাকায় এসেছে সাহিত্য করার জন্য, অনেকেরই চাকরি-বাকরি নেই, তাদের শুধু দু-একবেলা খাইয়েই তারা শান্ত হতেন না, অনেক সময় বাড়ি ফেরার বাসভাড়া দিয়ে দিতেন।
কোথায় হারাল সেইসব দিন! সেইসব আড্ডা? এখন সবাই ব্যস্ত। কথা বলেন মেপে মেপে। প্রাণখোলা অনুভূতিটা কোথাও নেই। তারপর আছে দলবাজি, দলদলি আগেও ছিল; কিন্তু এমন রেষারেষিটা ছিল না।
আড্ডা হারিয়ে যাওয়ার মূল কারণ কিন্তু স্থানের অভাব নয়। আড্ডাবাজদের জন্য স্থানের অভাব হয় না। মূল কারণ আসলে বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চারই অভাব। অনেকে হয়তো কর্মব্যস্ততা, ট্রাফিক জ্যাম, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেরই বেশি দোষ দেবেন। আসলে ওগুলো নিছকই দোষ চাপানো, এড়িয়ে যাবার প্রবণতা। মূল কারণটি আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক দৈন্য।
এখনো ঢাকায় শিল্প-সাহিত্য হয়। এখনো ঢাকা শিল্প-সাহিত্যের রাজধানী; কিন্তু শিল্প কোথায়? সংখ্যা দিয়ে হয়তো শত শত বই, নাটক, সিনেমা গোনা যায়; মানের দিক দিয়ে কতগুলো ভালো বই, নাটক, সিনেমা খুঁজে পাওয়া যায় বছর শেষে? এত যে শিল্প-সাহিত্য উৎপাদন হচ্ছে সেগুলো নিয়ে আলোচনা কোথায়?
যে যার জায়গা থেকে কাজ করছেন, সবাই যেন বিচ্ছিন্ন, কোথাও যুথবদ্ধতা নেই। বাংলাদেশের বিখ্যাত অভিনেতা সুবর্ণা মোস্তফা তার এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, এক সময় তারা ফুটবলারদের চিনতেন, সাংবাদিক-সাহিত্যিকদের সঙ্গে তাদের বন্ধুত্ব ছিল, তাদের সঙ্গে নিয়মিত আড্ডা হতো। এখন কি কোনো অভিনেতা বলতে পারবেন তার একজন সাহিত্যিক বন্ধু আছেন। হালের কজন অভিনেতা সাম্প্রতিক সময়ের কজন কবি-সাহিত্যিকের নাম বলতে পারবেন আল্লা মালুম।
এ দূরত্বের কারণ বুদ্ধিবৃত্তিচর্চার অভাব। এই বুদ্ধিবৃত্তি চর্চার অভাব কেন হচ্ছে তার কারণ খতিয়ে দেখতে হবে। বুদ্ধিবৃত্তি চর্চার অভাবে যেমন একদিকে আড্ডা কমছে, বিপরীত দিকে আবার এ কথাও সত্য আড্ডার অভাবে বৃদ্ধিবৃত্তি বাড়ছে না। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে, ঘরে বসে বই পড়েই কেবল বুদ্ধিবৃত্তিক সৃজনীশক্তি বিকাশ হয় না। উন্মুক্ত, উন্মুক্ত আড্ডার অভিজ্ঞতা যার নেই, তাকে এটা বোঝানোও কষ্ট।
উপযুক্ত লোকজনের সঙ্গে আড্ডায় বসলে এক মুহূর্তে সেখানে হাজির হয় পুরো দুনিয়া, সমগ্র বিশ্বব্রহ্মাণ্ড। জাদুবাস্তববাদ, পরাবাস্তববাদ থেকে শুরু করে মার্কসবাদ, নব্য উদারনীতিবাদ আপনি আর কোথায় শিখবেন হলুস্থূল আড্ডা ছাড়া? আর যদি শিখেই বসে থাকে তাহলে দুদিনেই ভুলে যাবেন, আপনাকে শেখাতেও হবে, বিনেমাগনায় ছাত্র পাবেন কোথায়? আপনাকে কোনো আড্ডাতে গিয়েই নিজের জায়গা খুঁজে নিতে হবে।
আড্ডা শুধু প্রাণের আনন্দ, সৃজনীশক্তির বিকাশেই কাজে লাগে তা-ই নয়, আড্ডার অনেক সামাজিক-রাজনৈতিক-মনস্তাত্ত্বিক তাৎপর্য আছে। আড্ডা থেকে অনেক বড় বড় বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের জন্ম হয়েছে, অনেক বিদ্রোহের আগুন জ্বলেছে। আধুনিক রাষ্ট্র চায় না বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা হোক, কয়কটি সৃজনী মাথা একসঙ্গে হোক। তারা বরং চায় একটা বিচ্ছিন্নতাই সৃষ্টি করতে। যেন রাষ্ট্রের অন্যায়ের বিরুদ্ধে কোনো প্রতিবাদ-প্রতিরোধ শক্তি গড়ে না ওঠে। তাই আপনি যে আড্ডা দিচ্ছেন না, আপনি ভাববেন না এটা আপনার ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত। আপনাকে আড্ডা দিতে দেয়া হচ্ছে না, এবং এর বিরুদ্ধে খুব বড় ধরনের রাজনৈতিক পরিকল্পনাই বিরাজমান। আপনাকে যত একলা করে দেয়া হবে তত পুঁজিবাদের লাভ, রাষ্ট্রীয় অনাচারের বিরুদ্ধে আপনি তত দুর্বল থাকবেন। প্রতিষ্ঠানের দানবীয় হাতে তত বন্দি থাকবেন। আবার এই রাষ্ট্র (এখানে রাষ্ট্র বলতে কেবল বাংলাদেশ বা কোনো নির্দিষ্ট দেশের কথা বলা হচ্ছে না, সামগ্রিক প্রশাসনিক ব্যবস্থা, যে রাষ্ট্রযন্ত্র আসলে এখন বড় বড় করপোরেশনের হাতে বন্দি, সমগ্র পৃথিবীই তো আসলে আজ এক বৃহৎ বেনিয়াশক্তি, আরও ভালো করে বললে অসংখ্য শাইলকের হাতে বন্দি) আপনাকে জোটবাঁধার সুযোগ দেবে বটে; কিন্তু সেটা কোথায়? পার্টিতে, ফাস্ট ফুডের দোকানে, সিনেপ্লেক্সে, যেখানে জমায়ত আছে, রঙ-তামাশা আছে; কিন্তু আড্ডা নেই।
আড্ডা দিতে গেলে আপনাকে যেতে হবে এমন একটা জায়গায়, যেখানে দাঁড়াবার ঠিক মতো জায়গা নেই, আশপাশে ভালো খাবার নেই; কিন্তু হাত বাড়ালেই পাওয়া যাবে এমন এক বন্ধুকে যে এক ফুয়ে আপনাকে নিয়ে যাবে মহাবিশ্বের এমন কোনো প্রান্তে, যে প্রান্তের সঙ্গে আপনার কোনো পূর্ব-পরিচয় ছিল না। আর একবার যদি আপনি সে প্রান্তে যান, আপনার আগের দুনিয়ায় আর নাও ফিরতে পারেন!
লেখক: কথাসাহিত্যিক
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে