রেলের বগি-ইঞ্জিন-জনবল সংকট
শুধু লাইন, স্টেশন দিয়ে কী হবে?
দেড়শ বছরের বেশি সময় ধরে রেলওয়ে এই জনপদের মানুষকে পরিবহন সেবা দিয়ে যাচ্ছে। ব্রিটিশ আমলের ইস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়ে এখন বাংলাদেশ রেলওয়ে, প্রতিষ্ঠানটি এখন রাষ্ট্র-মালিকানাধীন ও রাষ্ট্র পরিচালিত রেল পরিবহন সংস্থা। তবে, স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশ রেলওয়ে সম্পর্কে সুখবর কমই শোনা গেছে। বেশির ভাগ সময়ই শোনা গেছে দুর্ঘটনা আর লুটপাটের খবর। ব্রিটিশ আমলের স্টেশন, রেললাইন, ইঞ্জিন, বগি দিয়েই যুগের পর যুগ ধরে চলেছে এই রেল পরিবহনের সেবা। কদাচিৎ ঠেকায় পড়লে রেল কর্তৃপক্ষ বগি-ইঞ্জিন-রেললাইন ঠিক করেছে।
তারপরও সড়ক ও নৌপথের যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত হওয়ার আগে আশির দশক পর্যন্ত বাংলাদেশের উত্তর ও পূর্বাঞ্চলের পরিবহন ব্যবস্থায় রেলপথই ছিল নির্ভরতার বাহন। কম ভাড়ায় দূরের যাত্রীরা রেলপথেই ভরসা করতেন। তাতে রেলওয়ে বছর বছর লোকসান ও ভর্তুকি দিয়েই চলেছে। এক-দুই কোটি টাকা লোকসান না, শত শত হাজার হাজার কোটি টাকা লোকসান দিয়েছে সংস্থাটি। বাংলাদেশ রেলওয়ের থলের বিড়াল বের করে আনতে সংস্থাটির বিরুদ্ধে প্রতিবাদও কম হয়নি, আইনি প্রচেষ্টাও কম হয়নি। তারপরও সংস্থাটি সব সময় থেকে যায় প্রশ্নবিদ্ধতার মধ্যেই।
সমস্ত প্রতিকূলতার মধ্যেও বর্তমান সরকার ক্ষমতায় এসে রেলওয়ে-উন্নয়নে বেশ কয়েকটি বড় প্রকল্প হাতে নিয়েছিল। এর মধ্যে একটি হচ্ছে ঢাকা-কক্সবাজার রেলপথ চালু, আরেকটি হচ্ছে পদ্মা সেতুর ওপর দিয়ে রেলাইন স্থাপন করে দক্ষিণবঙ্গের সঙ্গে রেলপথ সংযোজন। নিঃসন্দেহে বেশ উচ্চাবিলাসী প্রকল্প। তবে দুঃখের ব্যাপার হচ্ছে, প্রায় পৌনে ১২ হাজার কোটি টাকা খরচায় নির্মিত কক্সবাজার রেলপথে চলছে মাত্র দুটি আন্তঃনগর ও একটি কমিউটার ট্রেন। যাত্রীদের চাহিদা থাকলেও রেলওয়ের ‘হাত-পা বাঁধা’। কারণ, ওই পথে নতুন ট্রেন চালুর মতো অতিরিক্ত কোচ (বগি) রেলের কাছে নেই। আর এ বছর চালু হতে পারে প্রায় ৩৯ হাজার কোটি টাকার পদ্মা রেল সংযোগের ভাঙ্গা-যশোর অংশ। তবে ইঞ্জিন ও বগি না থাকায় নতুন ট্রেন চালুর সম্ভাবনা নেই। এখন স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠতে পারে, হাজার হাজার কোটি টাকার প্রকল্প থেকে যদি যথাযথ সুফল না পাওয়া যায়, তাহলে এত বড় বড় প্রকল্প কেন হাতে নেয়া হলো?
শনিবার (১৮ মে) সংবাদপত্রে প্রকাশিত বিশেষ প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, শেষ পাঁচ বছরে রেলের উন্নয়ন প্রকল্পে সরকার ৬৩ হাজার ৩৮০ কোটি টাকা খরচ করলেও বগি ও ইঞ্জিন সংকটে ধুঁকছে সংস্থাটি। পরিচালন ব্যয়সহ আওয়ামী লীগ সরকার ২০০৯ সালে ক্ষমতায় ফেরার পর রেলের জন্য খরচ করে ১ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকার বেশি। তবু রেলের পরিসংখ্যানে ইঞ্জিনের ৬০ শতাংশ ও যাত্রীবাহী বগির ৪৭ শতাংশ মেয়াদোত্তীর্ণ। এই মে মাসের প্রথম ১৩ দিনে বিভিন্ন স্থানে ইঞ্জিন বিকল হয়েছে ১৭ বার। গত এপ্রিলে ৪৪ বার ইঞ্জিন বিকল হয়ে ট্রেন চলাচলে বিঘ্ন ঘটে।
জনবল সম্পর্কে রেল কর্মকর্তারা সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন, ৪৭ হাজার ৭০৩ পদের প্রায় অর্ধেক শূন্য। আগে থেকেই ট্রেন চলছে জনবল সংকট নিয়ে। নতুন রেলপথ চালুর পর জনবলের প্রয়োজনীয়তা আরও বেড়েছে। রেলের হিসাবে, যাত্রীবাহী বগি আছে ১ হাজার ৯৮০টি। এর মধ্যে গত ১৩ মে চলাচলের উপযোগী ছিল ১ হাজার ৫৯৮টি। বাকি কিছু মেরামতে ছিল, অন্যগুলো বিকল। সারা দেশে যাত্রীবাহী ট্রেন ৩২০টি। তবে আদতে তা চলে ৭৪টি রেকে (ট্রেনের বগির সমন্বয়), অর্থাৎ এক রেকে একাধিক নামে ট্রেন চালানো হয়।
গণপরিবহন বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. হাদীউজ্জামান বলেন, হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ হলেও রেলের সুষম উন্নয়ন হয়নি। সুরম্য স্টেশন হয়েছে; ইঞ্জিন ও বগি কেনা হয়নি। নতুন নতুন রেলপথ হলেও জনবল নেই। এগুলো দূরদর্শিতার অভাব। অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পগুলো অনেকের জন্য আকর্ষণীয়। তাই সেদিকেই মনোযোগ বেশি। এ প্রসঙ্গে রেলমন্ত্রী জিল্লুল হাকিমও সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন, ‘গরিবের সংসার, জোড়াতালি দিয়েই চলে।’
লাখ লাখ কোটি কোটি টাকার প্রকল্পকে গরিবের সংসার আখ্যা দেয়া কেন? অবস্থা দেখে তো মনে হচ্ছে টাকার অভাব নয়, বরং পরিকল্পনার অভাবেই রেল পরিবহন ধুঁকছে। আমরা আশা করব, সঠিক পরিকল্পনার মধ্য দিয়ে রেলওয়ে পরিবহন যথাযথ উন্নয়ন করে সরকার দেশের সম্পদ ও জনসেবায় প্রতিশ্রুতিশীল ভূমিকা পালন করবে
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে