ব্যক্তি যখন উন্নয়নের ছায়া খোঁজে
আমাদের সব সময় স্মরণ করিয়ে দেয়া হয় আরও রাষ্ট্রীয় উন্নয়নের জন্য ভ্যাট আর ট্যাক্স দিতে। উত্তম প্রস্তাব! বিশাল বিশাল উন্নয়ন প্রকল্পগুলো মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে, আর আমাদের বলা হয়েছে, এর বেশির ভাগই তৈরি হয়েছে আমাদের অর্থ দিয়ে। মানে সবই করদাতাদের অবদান। ব্যয়বহুল ঋণের ওপর নির্ভর করার চেয়ে এটা ভালো, সেটা যতই কম হোক। আর অগ্রিম ট্যাক্স আদায় করার কী দারুণ পদ্ধতিই না আবিষ্কার করা হয়েছে! ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকে আস্তে করে ট্যাক্স কেটে নেয়া হবে আপনি টেরই পাবেন না। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য ক্রয় করতে গেলে এমনভাবে ট্যাক্স কেটে নেয়া হবে আপনি কিছুই করতে পারবেন না। বাইরে খেতে গেলেও আপনাকে বিলের সঙ্গে ২৫ শতাংশ ট্যাক্স গুনতে হবে। কর প্রদানের আগে আপনি মোবাইল ফোন চালু করতে পারবেন না।
ভয়াবহ ট্রাফিক জ্যাম থেকে মুক্তি পেতে যখন শৈল্পিক অবকাঠামোগুলো তৈরি হয়, বিস্মিত নাগরিককে তখন তার শোধ দিতে হয় টোল পরিশোধ করে। শুধু যে এগুলো তৈরি হওয়ার পেছনে তাকে অর্থ ঢালতে হয়েছে, তা নয়। এগুলো রক্ষণাবেক্ষণের খরচও তাকে জোগাতে হয়। নতুন অবকাঠামোগুলো যখন ভেঙে পড়তে শুরু করে অথচ টোল পরিশোধ তখনো শেষ হয় না, এই দেখে নাগরিকদের বিস্ময় আরও বাড়ে।
গণপরিবহন যারা ব্যবহার করেন তারা খুব কমই নির্দিষ্ট ভাড়া দিয়ে যাতায়াত করতে পারেন। চালকদের অজুহাতের শেষ নেই। সবচেয়ে বড় অজুহাত ট্রাফিক জ্যাম। বিশেষ করে সিএনজিচালিত আটোরিকশা, রিকশাচালক সবাই মিটার ঠিকঠাকই দেখিয়ে বেড়ায়; কিন্তু সেটা শুধু পুলিশের ঝামেলা এড়াতে দেখানোর জন্যই। রিকশাচালকদের মতোই সিএনজি চালকরাও এখন দরাদরি করেই ভাড়া ঠিক করেন। আরও অজুহাত আছে, ‘সবকিছুর দাম যেভাবে বাড়ছে’! এ কথায় সন্দেহ নেই। সুযোগ পেলে যে কেউ যে কারও ওপর এখন কতৃত্ব চালায়। যেমন খুশি তেমন চলছে সব!
নগরের কেন্দ্রস্থলে ময়লা-আবর্জনা জড়ো করে রাখার জন্যই কি আমরা ট্যাক্স দেই? এত সিসিটিভি থাকা সত্ত্বেও কীভাবে বৈদ্যুতিক তার চুরি হয়? বাড়িঘরের ময়লা-আবর্জনা সংগ্রহের জন্য এখন প্রত্যেক এলাকাতেই ছদ্মবেশী সেবা সম্প্রদায় কাজ করে। ব্যয়ের তুলনায় এসবের পরিষেবার মান কীরকম, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। রাস্তার পাশে জায়গা দখল করে যারা দোকান দেয়, বা ভাসমান দোকানদাররা ফুটপাথ দখল করে যেসব ব্যবসা করে তাদের ফেলে যাওয়া ময়লা-আবর্জনা পরিষ্কার করার কোনো ব্যবস্থা নেই। বড় বড় রাস্তা দখল করে ভাসমান বিক্রেতারা সেগুলো প্রায় চিপাগলি বানিয়ে ফেলেছে। এতে কারা লাভবান হয়, তাও জানা যায় না। নির্বাচনের আগে তো তাদের দৌরাত্ম্য আরও বাড়ে। উন্নয়নের প্রচারপত্রগুলো শেষ পর্যন্ত আবর্জনা হয়ে রাস্তার ওপই পড়ে থাকে। কারও এ নিয়ে মাথাব্যথা নেই। কারোরই এতে কিছু যায়-আসে না। এ শহর এখন দূষণে অভিশপ্ত। একটু সতেজ বাতাসের জন্য সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত স্থানগুলো আরেকটু সম্প্রসারিত করতে হবে। যেখানে সেখানে যেন ভাসমান দোকান বসতে না পারে, গাড়ি না রাখতে পারে- এ ব্যাপারে কর্তৃপক্ষকে সচেতন হতে হবে। কঠিন হলেও এটা অসম্ভব নয়।
তাও এটা একেবারেই অন্যরকম হতে পারত। গাড়ি চলাচল ও প্রতিদিনের পথচারী চলাচলের পথ-আগলে যদি ভাসমান দোকানদাররা বসে না থাকত। অবৈধভাবে রাস্তা দখল করে যারা ব্যবসা করে, তাদের যদি জরিমানা করা যায়, তাহলে একদিকে যেমন রাস্তা দখলমুক্ত থাকবে, অন্যদিকে রাজস্ব কোষাগারকেও শক্তিশালী করবে। এ খরচে আরও কার্যকর কমিউনিটি পুলিশের সংখ্যা বাড়ানো যাবে। কোনো জবাবদিহি ছাড়াই ট্যাক্স-প্রদেয় অর্থ এ পাত্র থেকে ও পাত্রে ঢালার চেয়ে এটা বেশি ফলপ্রসূ হবে বলে মনে হয়। যত্রতত্র যানবাহন পার্কিং করার ক্ষেত্রেও এই ব্যবস্থা। বিশেষ করে যেখানে সেখানে বাস-ট্রাক রেখে দিলে তাদের জন্য কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। মেগা শহর ঢাকার জন্য অবশ্যই নির্ধারিত পার্কিং স্থান থাকতে হবে। এর সবই ইচ্ছা ও অভিপ্রায়ের ওপর নির্ভর করে। এ ছাড়া তর্জন-গর্জন করে কিছু হবে না।
মাহমুদুর রহমান: লেখক, সম্প্রচারক, কলামিস্ট ও যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে