প্রথম বর্ষপূর্তি সংখ্যা
রাষ্ট্র যখন বৈষম্যের সন্তান এবং বৈষম্যের প্রতিপালক
আপনি, রবীন্দ্রনাথ, রাষ্ট্রে বিশ্বাস করতেন না; বিশ্বাস করতেন সমাজে। ভারতবর্ষে সমাজই বড়, রাষ্ট্র এখানে একটি উৎপাত বিশেষ- এ আপনার ধারণার অন্তর্গত ছিল। রাষ্ট্র ছিল বাইরের। সমাজ আমাদের নিজস্ব। এই সমাজকে আমরা নিজের মতো গড়ে তুলব, এই আস্থা আপনার ছিল; কিন্তু রাষ্ট্রের উৎপাত কমেনি, ক্রমাগত বৃদ্ধি পেয়েছে। রাষ্ট্র হয়ে দাঁড়িয়েছে শোষণ ও লুণ্ঠনে অতিশয় বিশ্বস্ত যন্ত্র। যন্ত্র সে শাসকদের হাতে। শাসকরা অধীন সাম্রাজ্যবাদের হাতে। আমরা দেখছি রাষ্ট্র আগের যে কোনো সময়ের তুলনায় অধিক দক্ষ ও সর্বগ্রাসী হয়ে দাঁড়িয়েছে। পাশাপাশি আছে এনজিও। এরা অনেকটা মিশনারিদের মতো। নতুন ধর্ম প্রচার করছে, সেটি হলো পুঁজিবাদ। রাষ্ট্র নিজে পুঁজিবাদী ও আমলাতান্ত্রিক; এনজিওদের সাহায্য দানও পুঁজিবাদী; তাদের লক্ষ্য মানুষকে বিশ্ব পুঁজিবাদের অংশ করে ফেলা। রুশ বিপ্লবের পর, রবীন্দ্রনাথ, আপনি সোভিয়েত ইউনিয়নে গিয়েছিলেন। গিয়ে মনে হয়েছিল আপনার যে আপনি তীর্থ দর্শনে এসেছেন। মানব-মুক্তির নব আয়োজন আপনাকে অভিভূত করেছিল। সেই সোভিয়েত এখন আর নেই। ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে। এখন সেখানে বিদেশি বণিক ও স্বদেশি মতলবীদের দানবীয় পদচারণায় নতুন মানুষ সৃষ্টির সমস্ত উদ্যমসহ সবকিছুই লন্ডভন্ড।
আপনি আবার ফিরে এলে ব্যথা পেতেন। তখনও, সেই ১৯৩০-এ স্ট্যালিন যখন অবিচ্ছেদ্য ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত, সেই সময়েই আপনি একটি কালো ছায়া দেখেছিলেন ব্যাপারটার ভেতরে; সেটি যান্ত্রিকতার। ছায়াটি কায়া ধরেছে, প্রচণ্ড ও প্রকাণ্ড হয়েছে এবং আমলাতন্ত্রের রূপ নিয়ে বিদেশি পুঁজিবাদের সহায়তায় আঘাত করেছে রুশ বিপ্লবের অর্জনগুলোকে। রাষ্ট্রকে আপনি ভয় করতেন, ভয় তাকে সমাজ বিপ্লবীরা সবাই করেন, তারা চান রাষ্ট্র ক্রমশ শক্তি হারিয়ে অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়ুক, মানুষ মুক্তি পাক, আপনি যাকে সমাজ বলতেন সেখানে; কিন্তু রাষ্ট্রকে খাটো করা যায়নি, কেননা শোষণের শেকড়গুলো উপড়ে ফেললেও গোড়া ভেতরে রয়ে যায় এবং বাইরে থেকে পুঁজিবাদীরা তাতে জলসিঞ্চন করেছে। রাষ্ট্র বৈষম্যের সন্তান এবং বৈষম্যের প্রতিপালক। অর্থাৎ কিনা সন্তানও বটে, অভিভাবকও বটে। পৃথিবী জুড়ে বৈষম্য যে তীব্রতর হচ্ছে, তার প্রমাণ রাষ্ট্রের ক্রমবর্ধমান দৌরাত্ম্য। এ বড় মারাত্মক বাস্তবতা আজ পৃথিবীজুড়ে।
আপনি বলেছিলেন, রেখেছো বাঙালি করে, মানুষ করোনি। জননীকে বলেছিলেন ও কথা। বাঙালি মানুষ হয়েছে কি, এখনো? কতটা? মানুষ হবার প্রথম শর্তই হচ্ছে বাঙালি হওয়া। বাঙালি হলেই যে মানুষ হবে তা নয়, ‘রেখেছো বাঙালি করে মানুষ করোনি’- এতো আপনারই কথা; কিন্তু বাঙালি না হলে কিছুতেই সে মানুষ হতে পারবে না। বাঙালি হওয়ার অর্থ কী? না, কেবল বাংলা ভাষা বলা বা ব্যবহার করা নয়। সেটা বিদেশিরাও করতে পারে, যদি তারা ইচ্ছা করে। বাঙালি হওয়ার অর্থ হচ্ছে একদিকে যেমন বাংলা ভাষা ব্যবহার করা, অন্যদিকে তেমনি বাঙালির জন্য সহানুভূতি বোধ করা। অন্য বাঙালির দুর্দশায় যে বিপন্ন বোধ করে এবং তাকে সাহায্য করতে চায় সেই বাংলাভাষীকেই বাঙালি বলি। বাঙালি সম্পন্ন হবে; কিন্তু সংলগ্নও হবে, পরস্পরের। আপনি শ্রেষ্ঠ বাঙালি, কেননা একদিকে আপনি বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠ কবি, অন্যদিকে বাংলার দুঃখে সর্বাধিক পরিমাণে কাতর একজন মানুষ।
কিন্তু এই যে একাধারে সম্পন্ন ও সংলগ্ন হওয়া, এটা নেই আজ বাঙালির মধ্যে। সম্পন্নরা তো বটেই, দরিদ্ররাও পরস্পর-বিচ্ছিন্ন। আপনি উন্নতির অনেক হাম্বড়াই দেখতে পেতেন চতুর্দিকে; কিন্তু বিচ্ছিন্নতা দেখতেন সঙ্গে সঙ্গে এবং পীড়িত হতেন। আপনি চেয়েছিলেন বঙ্গ সন্তানরা সবাই গৃহছাড়া লক্ষ্মীছাড়া হোক। তারা ঘরকুনো থাকবে না, বেরিয়ে পড়বে, জয় করবে সারা বিশ্ব। গৃহছাড়া সে-ই হতে পারে যার গৃহ আছে- নইলে সে ছাড়বে কি? কেমন করে? অধিকাংশ বাঙালির আজ গৃহ নেই। মন্বন্তর, বঙ্গভঙ্গ, স্বাধীনতা যুদ্ধ, সাম্প্রদায়িকতার নীরব উৎপাত ও শ্রেণি-নিপীড়ন- সবকিছুই গৃহহীন করেছে বিপুলসংখ্যক বাঙালিকে। ভূমিহীন উপেনের সংখ্যা আজ একটি-দুটি নয়, কোটি কোটি; তাদের মধ্যে হিন্দু-মুসলমান ভেদ নেই, দলে দলে তারা গৃহহীন হচ্ছে, চলছে শহরে, সেখানে বাসিন্দা হচ্ছে বস্তির। এই স্রোতধারা দেখলে বড় পীড়িত হতেন রবীন্দ্রনাথ।
আপনি বলেছিলেন, আপনার গান বাঙালিকে গাইতে হবে। তা তারা গায় বৈকি! আপনার গানই তো জাতীয়সংগীত- বাঙালি রাষ্ট্রের, ভারতীয় রাষ্ট্রের, এমন কী শ্রীলংকারও; কিন্তু আপনার গান আজ কতভাবে যে বিপদগ্রস্ত তার তো কোনো ইয়ত্তা নেই। ব্যান্ড মিউজিকের জঙ্গি আওয়াজ তাকে চাপা দিতে চাচ্ছে পদে পদে, দ্রুতগামী ট্রাক যেমন করে চাপা দেয় নিরীহ পথযাত্রীকে ঠিক তেমনিভাবে। বাঙালি সংস্কৃতির নিজস্বতা আজ নানাভাবে আক্রান্ত। লোকে আন্তর্জাতিক হচ্ছে, যার অর্থ দাঁড়ায় নিজের ঘরেই সে পরবাসী হয়ে পড়েছে। বাঙালির জন্য বড়াই করার একটা বিষয় ছিল তার সাহিত্য। ঈশ্বর গুপ্তের যুগ পার হয়ে বাংলা সাহিত্য এগিয়েছিল অনেকটা দূর। আপনি তাকে হাত ধরে পার করে নিয়ে এসেছিলেন একটা লম্বা পথ; কিন্তু সেই সাহিত্য আজ আবার পিছু হটা শুরু করেছে, ঈশ্বর গুপ্তের সময়ের অভিমুখে।
কিন্তু রবীন্দ্রনাথ আবার আসবেন না, আসা সম্ভব নয়। রবীন্দ্রনাথ সেজে যদি আজ কেউ আসেন তবে ধরে নিতে হবে তিনি আসল নন, মেকি। কেননা ইতিহাসে অগ্রগমন আছে, প্রত্যাগমন নেই। নায়ক একবারই আসেন, বার বার নয়; কিন্তু তাকে আমাদের খুবই প্রয়োজন। প্রয়োজন আমাদের মানুষ হবার শিক্ষা দেয়ার জন্য। তিনি এলে বলবেন সংলগ্ন হতে। জোর দেবেন শিক্ষার ওপর- যেমন বুদ্ধির তেমনি হৃদয়ের। রাজনীতিকে তিনি বাদ দেবেন না। তার দৃষ্টি কখনোই এ সত্যটি দেখতে ভুল করবে না যে, বাঙালির শত্রু কেবল বাইরে নেই, রয়েছে ভেতরেও; ভেতরে তার শত্রু হচ্ছে বৈষম্য। এই বৈষম্য দূর করতে হলে জনগণকে রাষ্ট্রক্ষমতা করায়ত্ত করতে হবে। শেষ জীবনে বঙ্কিমচন্দ্র রাজনীতিবিমুখ হয়ে পড়েছিলেন এবং আশ্রয় খুঁজেছিলেন ধর্মে। শেষ জীবনে বিদ্যাসাগর চলে যেতে চেয়েছিলেন সাঁওতাল পরগনায়। রবীন্দ্রনাথ কোনোটিই করেননি; করতেনও না। তিনি জনপদেই থাকতেন, নিজের অবস্থানে থেকে অংশ নিতেন রাজনীতিতে, রাষ্ট্রকে যাতে দুর্বল করা যায় সেই লক্ষ্যে এবং এগিয়ে যেতেন সামনের দিকে, যেমনটি তিনি সারা জীবন করে গেছেন।
রবীন্দ্রনাথ আজ নেই, তবু তিনি আছেন এবং থাকবেন। তিনি তার সাহিত্য রেখে গেছেন, রেখে গেছেন তার জীবনকেও। আমরা কেউই রবীন্দ্রনাথ হব না; তার মেধা আমাদের কারও নেই; কিন্তু তার পথে আমরা অবশ্যই অগ্রসর হতে পারি। সেই পথটি হচ্ছে বাঙালি হবার পথ। বিচ্ছিন্নতা কাটিয়ে সংলগ্ন হতে বলেছেন তিনি; বলেছেন তিনি একই সঙ্গে হৃদয়বান ও বুদ্ধিমান হতে, বলেছেন উদারচিত্ত ও সাহসী হতে। উন্নতি মানে শুধু দালানকোঠা নয়; দালানকোঠা অবশ্যই দরকার হবে, তবে আরও বেশি করে যার দরকার হবে সেটি হচ্ছে মানুষ হিসেবে প্রসারিত ও উন্নত হওয়া। অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথ না হয়েও রবীন্দ্রনাথের মতো হওয়া।
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে