সাংবাদিকরা কবে ‘শ্রমিক’ থেকে ‘গণমাধ্যমকর্মী’ হবেন?
যিনি শ্রম দেন, সাধারণ অর্থে তিনিই শ্রমিক। সেই অর্থে একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, সরকারের সচিব, পুলিশের বড় কর্তা এমনকি কোনো করপোরেট প্রতিষ্ঠানের সিইও- সবাই শ্রমিক। কেননা সবাই শ্রম দেন; কিন্তু তারপরও সবাইকে শ্রমিক বলা হয় না।
একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপককে শ্রমিক বললে তিনি হয়তো মন খারাপ করবেন। একজন আমলা বা পুলিশ অফিসারকে শ্রমিক বললে তিনি হয়তো এটা মেনে নেবেন না। কেননা তারা মনে করেন এবং সমাজের মানুষও এটা মনে করে যে, ‘শ্রমিক’ মানে যারা অফিসের আরামদায়ক পরিবেশের বাইরে অথবা কখনো অফিসের ভেতরেই মূলত শারীরিক পরিশ্রমের কাজ করেন; যেখানে মেধা ও শিক্ষার চেয়ে শারীরিক সক্ষমতা এবং কিছু স্কিল বা দক্ষতাই বিবেচ্য। এর বাইরে যারা বিশেষ করে বুদ্ধিবৃত্তিক কাজ করেন, তারা শ্রমিক নন।
পরিহাসের বিষয় হলো, সবচেয়ে বেশি বুদ্ধিবৃত্তিক কাজ করতে হয় যে সাংবাদিকদের; এমনকি শিক্ষকদের চেয়েও যাদের অনেক বেশি অগ্রসর থাকতে হয় চিন্তা ও জ্ঞানে- সেই সাংবাদিকদের পরিচয় এখনো ‘শ্রমিক’! সাংবাদিকদের অধিকার লঙ্ঘিত হলে বা কোনো সমস্যার সৃষ্টি হলে এখনো তার সুরাহা হয় শ্রম আইনে। যে আইনে সাধারণ শ্রমিকদের বিষয়গুলো দেখভাল করা হয়।
গণমাধ্যমকে রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ (সংসদ, আদালত, নির্বাহী বিভাগের পরেই) বলা হলেও এবং গণমাধ্যমকে রাষ্ট্র এগিয়ে নেয়ার প্রধান সহযোগী বলে বিবেচনা করা হলেও বাংলাদেশ রাষ্ট্র গঠনের বায়ান্ন বছর পরেও সাংবাদিকদের পরিচয় নির্ণয়ের জন্য একটি সময়োপযোগী আইন প্রণয়ন করা সম্ভব হয়নি।
প্রসঙ্গত, একসময় গণমাধ্যমকর্মীরা চলতেন ‘দ্য নিউজপেপার এমপ্লয়িজ (চাকরির শর্তাবলি) আইন-১৯৭৪’ এর আওতায়। এর সঙ্গে শ্রম আইনের কিছু বিষয় সাংঘর্ষিক হচ্ছিল বলে সাংবাদিকদের শ্রম আইনের আওতায় নিয়ে যাওয়া হয়। ফলে আইনত সাংবাদিকরা এখনো ‘শ্রমিক’।
এটা ঠিক যে, সাংবাদিকদের শ্রমিক বললে তাতে তাদের জাত যায় না; কিন্তু একটি রাষ্ট্র ও তার জনগোষ্ঠী কোনো একটি বিশেষ পেশার মানুষকে কী বলে সম্বোধন করে বা কোন চোখে দেখে- সেটি খুব জরুরি। বাংলাদেশের সরকাররা শুরু থেকেই গণমাধ্যম ও গণমাধ্যমকর্মীদের ‘প্রতিপক্ষ’ হিসেবে বিবেচনা করছে। এটি শুধু বাংলাদেশ নয়, মোটামুটি সারা পৃথিবীর অনুন্নত, উন্নয়নশীল ও স্বল্পোন্নত এবং উঠতি গণতন্ত্রের দেশ, বিশেষ করে যেসব দেশের রাষ্ট্রপরিচালনায় কর্তৃত্ববাদই প্রধান নিয়ামক এবং রাজনৈতিক অসহিষ্ণুতা তীব্র-সেসব দেশে সাংবাদিকরা বরাবরই ক্ষমতাবানদের প্রতিপক্ষ; কিন্তু যেসব দেশ জ্ঞান-বিজ্ঞান ও অর্থনৈতিকভাবে উন্নত; যেসব দেশের রাজনীতিতে প্রতিপক্ষ দমন তথা কর্তৃত্ববাদ প্রধান অস্ত্র নয়, সেসব দেশে সাংবাদিকদের শত্রুজ্ঞান করা হয় না। বরং গণমাধ্যমকে উন্নয়ন, গণতন্ত্র ও নাগরিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় রাষ্ট্রের প্রধান সহযোগী হিসেবে বিবেচনা করা হয়। সেটি অন্য তর্ক।
আসা যাক সাংবাদিকের পরিচয় প্রসঙ্গে। কেন এখনো বাংলাদেশের সাংবাদিকদের অধিকার ও অন্যান্য সমস্যা সমাধানের জন্য শ্রম আইনই ভরসা? গণমাধ্যমকর্মীদের জন্য একটি স্বতন্ত্র ও আধুনিক আইন প্রণয়ন করা সম্ভব হচ্ছে না কেন? আবার শ্রম আইনের আলোকে সাংবাদিকরা শ্রমিক হলেও সাংবাদিকরা সেই শ্রমের মর্যাদাটুকু পাচ্ছেন কি না, সেটিও বিরাট প্রশ্ন।
বাস্তবতা হলো, অন্যের অধিকার লঙ্ঘিত হলে সবার আগে সোচ্চার হন যে সাংবাদিক বা গণমাধ্যমকর্মীরা, তারা নিজেরাই যে নিজেদের পেশায় নানাভাবে বঞ্চনার শিকার; তাদের নিজেদের অধিকারই যে পদে পদে লঙ্ঘিত; হাতেগোনা কিছু প্রতিষ্ঠান বাদ দিলে অধিকাংশ গণমাধ্যমপ্রতিষ্ঠানের কর্মীরাই যে মাসের পর মাস বেতন পান না; বেতন পেলেও সেটি যে তাদের যোগ্যতা ও পরিশ্রমের তুলনায় যথেষ্ট কম; বেতনের বাইরে অন্যান্য আর্থিক সুযোগ-সুবিধা যে নেই বললেই চলে; তাদের ছুটিছাঁটা ও অন্যান্য অধিকারের প্রশ্ন যে বরাবরই উপেক্ষিত-সেটি এখনো একটি নির্মম বাস্তবতা।
বাংলাদেশের সংবাদপত্রগুলোয় সাংবাদিকদের বেতন-ভাতার জন্য নবম মজুরি বোর্ড অনুসরণ করার কথা থাকলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সেটি মানা হয় না। বরং চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তর (ডিএফপি) থেকে দেশের সংবাপত্রের যে প্রচারসংখ্যা এবং তার সঙ্গে বিজ্ঞাপন রেট প্রকাশ করা হয়, সেখানে দেশের প্রথম সারির সব পত্রিকা তো বটেই, এমনো অনেক পত্রিকা অষ্টম ও নবম ওয়েজবোর্ড বাস্তবায়ন করে বলে উল্লেখ করা হয়, যা শুধু অবিশ্বাস্যই নয়, বরং হাস্যকরও বটে। সেইসঙ্গে ওইসব পত্রিকার যে প্রচারসংখ্যা উল্লেখ করা হয়, সেটিও যে জ্বলন্ত মিথ্যা, সেটি একজন সাধারণ পাঠকও বোঝেন। একটি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান কেন নিয়মিত এই ধরনের মিথ্যা তথ্য প্রচার করে জাতিকে বিভ্রান্ত করে, সেটি বিরাট প্রশ্ন।
এ তো গেল সংবাদপত্রের অবস্থা। অনলাইন পোর্টাল ও টেলিভিশন চ্যানেলের অবস্থা আরও করুণ। কেননা সেখানে মজুরি বোর্ড বলে কোনো শব্দই নেই। একেকটি টেলিভিশন চ্যানেল তাদের নিজস্ব বেতন কাঠামোয় চলে। যে কারণে একই যোগ্যতা নিয়ে একজন রিপোর্টার একটি টেলিভিশন চ্যানেলে ৪০ হাজার টাকা বেতন পেলে আরেকটি টিভির রিপোর্টার পান ২০ হাজার টাকা! অর্থাৎ মানা হোক বা না হোক, পত্রিকায় যেমন একটা কাঠামো আছে, টেলিভিশন ও অনলাইন পোর্টালের জন্য সেরকম কোনো কাঠামোও নেই এবং এই বিষয়টি নিয়ে খুব বেশি আলোচনা হয় না।
শ্রম আইনে আট ঘণ্টা কাজ করার কথা থাকলেও গণমাধ্যমকর্মীদের অনেককেই, বিশেষ করে রিপোর্টারদের আট ঘণ্টার বেশি কাজ করতে হয়; কিন্তু এই বাড়তি শ্রমের জন্য তারা কি বাড়তি মজুরি পান? না পেলে তারা কি চ্যালেঞ্জ করতে পারেন? চ্যালেঞ্জ করলে কি পরদিন তার চাকরিটা থাকবে? যদি চ্যালেঞ্জ করার কারণে কোনো সাংবাদিক চাকরিচ্যুত হন তাহলে তার পাশে কি রাষ্ট্র দাঁড়াবে?
অনেক সময় কোনো ধরনের প্রতিবাদ না করেও বিনা কারণে অথবা ঠুনকো অজুহাতে গণহারে সংবাদকর্মীদের ছাঁটাই করা এবং ছাঁটাইয়ের পরে তাদের পাওনাটুকু পর্যন্ত না দেয়ার উদাহরণও ভুরি ভুরি। যে কারণে এই সময়ের বাংলাদেশে গণমাধ্যমকর্মীরাই সম্ভবত সবচেয়ে অনিশ্চয়তার মধ্যে কাজ করেন। সাংবাদিকতা এখন একটি দীর্ঘশ্বাসের নাম!
প্রতি বছর ঈদের আগে বেতন-ভাতার দাবিতে পোশাক শ্রমিকরা রাস্তায় নেমে এলে সাংবাদিকরা সেই ঘটনা কাভার করার জন্য ছুটে যান। টেলিভিশন চ্যানেলগুলো সরাসরি সম্প্রচার করে। সেখান থেকে রিপোর্টাররা লাইভে যুক্ত হয়ে শ্রমিকের অধিকারের পক্ষে কথা বলেন। অথচ ওই রিপোর্টারেরই হয়তো বেতন হয় না ছয় মাস! এ রকম পরিহাস মাথায় নিয়ে যারা প্রতিনিয়ত কাজ করেন, তাদের নাম সাংবাদিক, গণমাধ্যমকর্মী।
গত বছর ব্রডকাস্ট জার্নালিস্ট সেন্টার-বিজেসি যে সম্প্রচার সাংবাদিকতা সুরক্ষা প্রতিবেদন প্রকাশ করে, সেখানে বলা হয়েছে, শ্রম আইন অনুযায়ীও গণমাধ্যম কর্মীদের মৌলিক পাওনা দিচ্ছে না প্রতিষ্ঠানগুলো। প্রতিবেদনে বলা হয়, আইনে বাধ্যবাধকতা থাকলেও বর্তমানে দেশে চালু থাকা টেলিভিশনগুলোর মধ্যে মাত্র চারটি টেলিভিশন তার কর্মীদের গ্র্যাচুইটি দেয়। আর মাত্র ৭টিতে চালু আছে প্রভিডেন্ট ফান্ড। বিনা নোটিশে কর্মী ছাঁটাই করা হয় ১৩টি টেলিভিশনে। প্রতিবেদনে আরও তুলে ধরা হয়, মাত্র আট শতাংশ স্টেশনে মাসের ১০ তারিখের মধ্যে নিয়মিত বেতন হয়। আর উৎসব ভাতা পায় ৫০ শতাংশে। ১৮টি টেলিভিশন সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে আহত হলে ব্যয় বহন করে না। ১১ ভাগ টেলিভিশনে সাপ্তাহিক ও সরকারি ছুটি দেয়া হয় না। অর্জিত ছুটি দেয় না বেশিরভাগ বেসরকারি টেলিভিশন প্রতিষ্ঠান। (একাত্তর টিভি, ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৩)।
এই যখন পরিস্থিতি তখন ২০১৮ সালে সাংবাদিকদের জন্য একটি আইন করার উদ্যোগ নিয়েছিল সরকার। পত্রিকা, টেলিভিশন, অনলাইন পোর্টালসহ সব ধরনের গণমাধ্যমকর্মীর জন্য চাকরির শর্ত ঠিক করে ‘গণমাধ্যমকর্মী (চাকরির শর্তাবলি) আইন ২০১৮’ এর খসড়ায় নীতিগত অনুমোদনও দিয়েছিল মন্ত্রিসভা। যে আইনে সাংবাদিকদের আগের মতো ‘শ্রমিক’ হিসেবে বর্ণনা না করে ‘গণমাধ্যমকর্মী’ হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে।
প্রস্তাবিত আইনে বলা হয়েছে, গণমাধ্যমে কর্মরত পূর্ণকালীন সাংবাদিক, কলাকুশলী, প্রশাসনিক কর্মকর্তা, কর্মচারী বা নিবন্ধিত সংবাদপত্রের মালিকানাধীন ছাপাখানা এবং বিভিন্ন বিভাগে নিয়োজিত কর্মীরা ‘গণমাধ্যমকর্মী’ হিসেবে সংজ্ঞায়িত হবেন। আর সম্প্রচার কাজে সার্বক্ষণিক নিয়োজিত গণমাধ্যমের কর্মীরা সম্প্রচারকর্মী এবং প্রযোজক, পাণ্ডুলিপি লেখক, শিল্পী, ডিজাইনার, কার্টুনিস্ট, ক্যামেরাপারসন, অডিও ও ভিডিও এডিটর, চিত্র সম্পাদক, শব্দধারণকারী, ক্যামেরা সহকারী, গ্রাফিকস ডিজাইনারসহ যে পেশাজীবীরা এ কাজের সঙ্গে জড়িত, প্রস্তাবিত আইনে তাদের বলা হয়েছে ‘কলাকুশলী’। (যুগান্তর, ১৫ অক্টোবর ২০১৮)।
এই বিলটি পাসের জন্য এখনো সংসদে উত্থাপন করা যায়নি। বরং এখনো সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর্যায়ে আছে। মূলত প্রস্তাবিত এই আইনের বেশ কিছু ধারার সঙ্গে সাংবাদিকদের দ্বিমত ও ভিন্নমত আছে। যে কারণে আইনের খসড়া সংসদে তোলার পর থেকে সাংবাদিকদের বিভিন্ন সংগঠন ও সংবাদপত্রের মালিকদের সংগঠন আইনের বেশ কিছু ধারা নিয়ে আপত্তি জানিয়ে আসছে। বিবৃতিতে সম্পাদক পরিষদ দাবি করেছে, প্রস্তাবিত আইনের ৫৪টি ধারার মধ্যে ৩৭টি ধারাই সাংবাদিকবান্ধব নয়। সার্বিকভাবে এই আইন গণমাধ্যম ও গণমাধ্যমকর্মীদের স্বার্থের বিরুদ্ধে। এ ধরনের আইন চূড়ান্ত করার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের সঙ্গে আলোচনা সাপেক্ষে সিদ্ধান্ত নেয়া প্রয়োজন। যেমন কাউকে গণমাধ্যমকর্মী আবার কাউকে কলাকুশলী বলার যে বিধান, সেটির বিরোধিতা আছে। কেননা সাংবাদিকরা মনে করেন, গণমাধ্যমে যিনি যে পর্যায়ে কাজ করুন না কেন, তাদের সবাইকে গণমাধ্যমকর্মী বলা উচিত।
তবে দ্বিমত, ভিন্নমত ও বিরোধ যাই থাকুক- সাংবাদিক তথা গণমাধ্যমকর্মীদের জন্য একটি স্বতন্ত্র ও আধুনিক আইন প্রণয়ন এখন সময়ের দাবি। এ নিয়ে কালক্ষেপণের সুযোগ নেই। সাংবাদিকদের শ্রম আইনের আওতায় না রেখে তাদের চাকরি, আর্থিক ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করার জন্য এমন একটি আইন প্রণয়ন করা জরুরি, যেখানে সংবাদপত্র, অনলাইন পোর্টাল, টেলিভিশন, রেডিওসহ সব ধরনের গণমাধ্যমে কর্মকর্তা আশ্রয় নিতে পারবেন। তবে সেটি না হওয়া পর্যন্ত অন্তত সাংবাদিক তথা গণমাধ্যমকর্মীরা শ্রম আইনের আলোকেও তার ন্যায্য পাওনাটুকু পাচ্ছেন কি না- সেটি নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব।
আমীন আল রশীদ: সাংবাদিক ও লেখক।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে