কবে হবে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা
বাংলাদেশ স্বাধীনতার ৫৩ বছরও পেরিয়ে গেল। দুঃখজনক হলেও সত্যি, এতদিনেও বীর মুক্তিযোদ্ধাদের নির্ভুল ও পূর্ণাঙ্গ তালিকা চূড়ান্ত হয়নি! এই না হওয়ার মাশুল যেমন গুনতে হচ্ছে সত্যিকারের মুক্তিযোদ্ধাদের, তেমনি রাষ্ট্রকেও।
যাচাই-বাছাই এবং বীর মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা নির্ভুল করার প্রক্রিয়ায় কখনো কখনো তালিকা থেকেই বাদ পড়ছেন সত্যিকারের বীর মুক্তিযোদ্ধারা। সরকারের ঘোষিত সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন তারা। আর এর ফায়দা নিচ্ছেন যুদ্ধ না করেও প্রভাব খাটিয়ে তালিকাভুক্ত হওয়া ব্যক্তিরা।
সত্যিকারের মুক্তিযোদ্ধা না হয়েও মাসে মাসে বরাদ্দকৃত ভাতা তুলছেন তারা। ভোগ করছেন অন্যান্য সুযোগ-সুবিধাও। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারক আওয়ামী লীগ সরকার যখনই ক্ষমতায় এসেছে, এই সুযোগ-সুবিধা বাড়ানো হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুযায়ী, বর্তমানে একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা মাসে ২০ হাজার টাকা সম্মানী ভাতা, বছরে ১০ হাজার টাকা করে দুটি উৎসব ভাতা, ২ হাজার টাকা বাংলা নববর্ষ ভাতা এবং ৫ হাজার টাকা বিজয় দিবস ভাতা পেয়ে থাকেন।
এ ছাড়া চিকিৎসা, সন্তানদের পড়াশোনা, বিশেষ ঋণ এবং রাষ্ট্রীয় গণপরিবহনে যাতায়াতে বিশেষ সুবিধাও পান তারা। বর্ধিত এই সুযোগ-সুবিধার কারণেই বীর মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় অনেকেই নাম লেখাতে চান। তাদের কেউ কেউ এমনই প্রভাবশালী যে শেষ পর্যন্ত তালিকায় অন্তর্ভুক্তও হয়ে যান তারা!
বীর মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা তৈরির আইনগত কর্তৃত্ব জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের (জামুকা)। তারাও বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সঠিক এবং নির্ভুল একটা তালিকা তৈরি করতে পারেনি। আর পারেনি বলেই তাদের প্রায় প্রতিটি সভায়ই বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে নতুন কারও নাম অন্তর্ভুক্ত হয় কিংবা আগের তালিকা থেকে কেউ কেউ বাদ যান। তাই দেশে বীর মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা নিয়ে স্পষ্ট একটা অস্পষ্টতা রয়েই গেছে।
পরিসংখ্যানও কথাটার সপক্ষে। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুযায়ী বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে মোট ২ লাখ ৩৫ হাজার ৪৬৭ জনের নাম বিভিন্ন সময়ে গেজেটভুক্ত হয়েছিল; কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের বাজেট শাখার তথ্য, গত জানুয়ারিতে ২ লাখ ১৯ হাজার ৭৫৮ জন বীর মুক্তিযোদ্ধার নামে ভাতা (মাসিক সম্মানী) বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। অথচ স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে ২০২১ সালের মার্চ মাসে সরকার বীর মুক্তিযোদ্ধাদের (অপূর্ণাঙ্গ) যে তালিকা প্রকাশ করে, সেখানে বীর মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা দেখানো হয় ১ লাখ ৪৭ হাজার ৫৩৭ জন!
বীর মুক্তিযোদ্ধা যাচাইয়ের জন্য ৩৩ ধরনের প্রমাণক (কাগজপত্র) দেখে জামুকা; কিন্তু কথা হলো, যারা সত্যিকারের বীর মুক্তিযোদ্ধা, এসব প্রমাণক নিয়ে তারা ঘোরেন না! ঘোরেন তারাই, যারা বীর মুক্তিযোদ্ধাদের রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা দেখে তালিকায় নাম লেখানোর জন্য মরিয়া। ফন্দিফিকির করে তারাই জড়ো করেন এসব প্রমাণক।
গত ৫৩ বছরে কম করে হলেও সাতবার বীর মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় সংযোজন-বিয়োজন হয়েছে। বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার বয়স, সংজ্ঞা ও মানদণ্ড পাল্টেছে আরও বেশি, ১১ বার।
১৯৮৪ সালে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা প্রণয়নের লক্ষ্যে এরশাদ সরকার একটি জাতীয় কমিটি গঠন করে। বঙ্গবন্ধু সরকারের সময় গঠিত মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের সংগৃহীত মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা, চট্টগ্রামের ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টারের তালিকা এবং ভারতের প্রাপ্ত তালিকা থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে একটি তালিকা প্রস্তুত করে এই কমিটি, যেখানে মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা দেখানো হয়েছিল ১ লাখ ২ হাজার ৪৫৮।
এরপর যতবারই তালিকা নির্ভুল ও সঠিক করার প্রক্রিয়া হাতে নেয়া হয়েছে, ততবারই বেড়েছে বীর মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা! বীর মুক্তিযোদ্ধার নির্ভুল এবং পূর্ণাঙ্গ একটা তালিকা তৈরি করা না গেলে তা বাড়তেই থাকবে!
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে