দেশের লিফট ব্যবস্থাপনার করুণ চিত্র বদলাবে কবে?
এক সপ্তাহের ব্যবধানে গাজীপুরের একই হাসপাতালে দুই রোগীর মর্মান্তিক মৃত্যুর ঘটনা সাধারণ মানুষকে উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। সর্বশেষ ১২ মে এক রোগী হাসপাতালের লিফটে প্রায় ৪৫ মিনিট আটকে থেকে মারা গেছেন। এই হাসপাতালেই গত ৪ মে এক রোগী ১০ তলা থেকে দুই ভবনের ফাঁকা স্থান দিয়ে পড়ে গেলে তার মৃত্যু হয়। দুটি ঘটনাতেই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তদন্ত কমিটি গঠন করার কথা জানিয়েছে; কিন্তু ঘটনা দুটি যেভাবে ঘটেছে, তাতে হাসপাতাল পরিচালনায় অব্যবস্থাপনার চিত্র ভয়াবহ আকারে ফুটে উঠেছে।
একটি হাসপাতাল ভবনে বিদ্যুৎ চলে গেলে সঙ্গে সঙ্গে লিফট চালুর বিকল্প ব্যবস্থা থাকবে না কেন? হাসপাতালের এক উপ-পরিচালক সাংবাদিকদের বলেছেন, হঠাৎ বিদ্যুৎ চলে যাওয়ার কারণে যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা দেয়। ‘বিদ্যুৎ চলে যাওয়ার কারণে যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা দেয়ার অর্থ কী?’ এর অর্থ বিদ্যুৎ চলে যাওয়ার পর লিফট চালুর জন্য জেনারেটর কিংবা আইপিএস- কোনো ধরনেরই ব্যাকআপ ছিল না। যে কারণে বিদ্যুৎ চলে যাওয়ার পর আটকে পড়া ব্যক্তিরা বার বার লিফটম্যানকে ফোন করলেও লিফটম্যানরা লিফট চালু করার ব্যাপারে কিছুই করতে পারেননি। একটা হাসপাতালের লিফটের জন্য জেনারেটর কিংবা আইপিএস ব্যাকআপ নেই, এটা কল্পনা করা যায়? বিকল্প ব্যবস্থা না থাকার জন্য লিফটম্যানরা নয়, বরং এই হাসপাতাল পরিচালনায় যুক্ত কর্মকর্তারাই দায়ী- যারা পেশায় চিকিৎসকও বটে!
দেশের বেশিরভাগ হাসপাতালেই দেখা যায়, চিকিৎসকদের জন্য পৃথক লিফট থাকে। সেগুলোর ব্যবস্থাপনা বেশ ভালো এবং সার্বক্ষণিক লিফটম্যানও থাকে; কিন্তু রোগীদের জন্য ব্যবহৃত লিফটগুলো বেশিরভাগের অবস্থাই করুণ। ভুল করে চিকিৎসক সাহেবদের লিফটে উঠলে রোগী কিংবা তার স্বজনদের নামিয়ে দেয়া হয় বেশ অভদ্রভাবে। আবার দেখা যায়, লিফটম্যান যারা থাকেন, তারা ওই চিকিৎসকদের লিফট নিয়েই ব্যস্ত থাকেন, রোগীদের লিফটের বিষয়ে মাসেও একবার খোঁজ নেন না। চিকিৎসকদের জন্য পৃথক লিফট থাকতে পারে; কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে, চিকিৎসকদের লিফটের ব্যবস্থাপনা ভালো হবে, আর রোগী এবং তার স্বজনদের জন্য থাকা লিফটে বিদ্যুৎ চলে গেলে লিফট চালুর জন্য কোনো বিকল্প ব্যবস্থা রাখা হবে না!
এই হাসপাতালের ব্যবস্থাপকরা যে তদন্ত কমিটি গঠন করেছেন, সেই তদন্ত কমিটি নিশ্চিতভাবেই ব্যবস্থাপকদের গাফিলতি বা দুর্বলতা খুঁজে পাবেন না। এ কারণে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে একটি উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করা উচিত এবং হাসপাতালের ব্যবস্থাপকদের দায়িত্বহীনতার বিষয়টিও সামনে নিয়ে আসা উচিত।
এই হাসপাতালের ১২ তলা থেকে ১০ তলায় পড়ে গিয়ে গত ৪ মে আরও একজন রোগী নিহত হয়েছেন। দেখা যায়, ১২ তলায় মেডিসিন বিভাগের বারান্দার সঙ্গে পাশের ভবনের দেয়ালের মধ্যে বেশ বড় ফাঁক। কোনো ধরনের সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেই। একটু অসচেতন হলেই সেই জায়গা দিয়ে যে কেউ পড়ে গিয়ে জীবন হারাতে পারেন। এখানে এটা স্পষ্ট যে, এই হাসপাতালের ভবনটিও ত্রুটিপূর্ণ। এ ধরনের ত্রুটিপূর্ণ ভবনে কীভাবে হাসপাতাল পরিচালিত হচ্ছে, সে বিষয়েও তদন্ত হওয়া উচিত।
বর্তমান প্রযুক্তির দুনিয়ায় ‘এলিভেটর ম্যানেজমেন্ট’ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বিশ্বের অনেক দেশে ৮০ তলা, ১০০ তলার বেশি বড় ভবন রয়েছে। ওইসব ভবনে কখনই লিফট আটকে যাওয়া কিংবা অন্য কোনো ধরনের দুর্ঘটনার কথা শোনা যায় না। কারণ অত্যাধুনিক প্রযুক্তির সাহায্যে এসব ভবনে লিফট পরিচালনা করা হয়, যেখানে বিদ্যুৎ চলে গেলেও লিফট তার গন্তব্যের দিকে পরের ফ্লোরে গিয়ে খুলে যায়। আর আমাদের দেশে একটি হাসপাতালের লিফটেও জরুরি অবস্থার জন্য ন্যূনতম বিকল্প ব্যবস্থা থাকে না!
শুধু গাজীপুরের এই হাসপাতাল নয়, দেশের অধিকাংশ সরকারি-বেসরকারি ভবনেই লিফট ম্যানেজমেন্ট নেই বললেই চলে। নিতান্ত অবহেলায় লিফট ম্যানেজমেন্ট হয়। উত্তরার পাসপোর্ট অফিসে পাঁচ বছর আগে পাসপোর্ট নবায়ন করতে গিয়ে দেখেছিলাম, সেখানকার লিফট নষ্ট। পাঁচ বছর পর আবারও নবায়ন করতে গিয়ে দেখলাম, সেই লিফট একইভাবে নষ্ট। এটাই আসলে আমাদের দেশে লিফট ব্যবস্থাপনার করুণ চিত্র। সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে লিফট ব্যবস্থাপনার বিষয়টিতে জরুরি গুরুত্ব দেয়া উচিত এবং সঠিক লিফট ব্যবস্থাপনা ছাড়া কোনো ভবন ব্যবহারের অনুমতি দেয়া উচিত নয়।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে