আল-জাজিরা থেকে
ক্ষুধা যেখানে বাঘের ভয়কেও হার মানায়
মাহফুজা বেগম। বয়স ৫২। প্রতিদিন দক্ষ হাতে তিনি নৌকা চালিয়ে যান মাঝনদীতে। পেরিয়ে যান গভীর বনজঙ্গল। নদীতে জাল ফেলে তিনি গলদা চিংড়ি ধরেন। স্থানীয় বাজারে বিক্রি করে যা আয় হয় তা দিয়েই তার সংসার চলে।
বছরের পর বছর ধরে এভাবেই চলছে মাহফুজার জীবনসংগ্রাম। সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে সাপের মতো আঁকাবাঁকা নদী দিয়ে তিনি একাই নৌকা চালিয়ে গেছেন অনেক সময়। সুন্দরবন পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বন। বহু ছোটবড় খাল-নদী বয়ে গেছে এই বনের ভেতর দিয়ে। প্রতি পদে পদেই বিপদের আশঙ্কা থাকে। কোথাও কোথাও এমন ঘন বন যে সূর্যের আলোও সেখানে ঠিক মতো পৌঁছাতে পারে না। একজন জেলে হিসেবে বনের ভেতর দিয়ে যাওয়ার সময় আসন্ন বিপদ সম্পর্কে প্রতি মুহূর্তেই তাকে সচেতন থাকতে হয়। তিনি বিপদগুলোর সঙ্গে পরিচিত। জলে থাকে কুমির আর ডাঙ্গায় বাঘ। কুমির ও বাঘের উপস্থিতি মাহফুজা অস্তিত্ব দিয়েই টের পান। জলের একটু কম্পন, গাছের একটু নড়াচড়া দেখেই তিনি বুঝতে পারেন কুমির বা বাঘ আছে ধারেকাছেই। তিনি বলেন, ‘পানি হয়তো শান্ত; কিন্তু সামান্য নড়াচড়া দেখেই বুঝতে পারি কুমির ডুবে আছে কাছেই।’
মাহফুজা বলেন, ‘আগে এত পশুপাখির দেখা পাওয়া যেত না। ওরা থাকত বনের ভেতরেই; কিন্তু বন কমে আসার সঙ্গে সঙ্গে ওরা আমাদের কাছাকাছি চলে আসছে। আমরা ওদের জায়গা দখল করেছি বলে ওরাও আমাদের জায়গা দখল করে নিতে চাচ্ছে।’
কুমির এখন প্রায়ই দেখা যায়, বিশেষ করে পানি যখন কমে আসে। বৈঠা দিয়ে পানি ঠেললে ওরা নৌকার কাছাকাছি চলে আসে, তাই নৌকার কিনারে বসা যায় না তখন। নৌকার সঙ্গে সঙ্গে চলতে চলতে ওরা আক্রমণ করতে চায়। জীবনে মাহফুজা এত বাঘের সাক্ষাৎ পেয়েছেন যে সেগুলো গুনেও রাখা যায়নি। বেশিরভাগ সময়ই বাঘ দেখেছেন একটুখানির জন্য, গভীর জঙ্গলের ভেতর থেকে তাকিয়ে আছে একজোড়া জ্বলন্ত চোখ, দেখলেই গায়ে কাঁপুনি ওঠে!
২০১৯ সালের এক সকাল। মাহফুজা তার জাল টানছিলেন। হঠাৎ খেয়াল করলেন পাখির ডাকাডাকি কমে গেছে। তিনি জানেন, বাঘের উপস্থিতি টের পেলেই পাখিরা চুপ হয়ে যায়। তিনি ঘুরে তাকিয়ে দেখেন কয়েক হাত দূরেই নদীর তীরে এক বাঘ দাঁড়িয়ে আছে, দৃষ্টি তার দিকেই। মাহফুজা একটা ধাতব পাত্র নিয়ে নৌকায় আঘাত করল; কিন্তু বাঘের নড়ার লক্ষণ নেই। ঠায় তাকিয়ে রইল মাহফুজার দিকে, মাহফুজা তাকিয়ে রইলেন। তারপর বাঘটি এক সময় আস্তে আস্তে বনের ভেতরে ঢুকে যায়। মাহফুজা শিখেছেন কীভাবে শব্দ করে, চিৎকার করে, নৌকায় আঘাত করে বাঘকে ভয় দেখাতে হয়; কিন্তু সব সময়ই যে এটা কাজ করে তা না, ক্ষুধার্ত থাকলে বাঘ এসব ভয় পায় না। আর একবার যদি বাঘ আক্রমণ করে কারও কোনো উপায়েই বাঁচা সম্ভব নয়।
১৭ বছর আগে মাহফুজার এক ভয়ানক অভিজ্ঞতা হয়েছিল। এক পড়ন্ত বিকেলে মাহফুজা তার বড় ছেলে আলমগীর, বড় ভাই শাহাদাত আর তার স্ত্রীকে নিয়ে দুটি নৌকায় করে মাছ ধরতে বের হন। জাল ছিঁড়ে যাওয়ায় তারা বাড়ির দিকে রওয়ানা হলেন নতুন জাল আনতে। মাহফুজা আর তার ছেলে তখন একই নৌকায় ছিল, পেছনের নৌকায় ছিল ভাই-ভাবী। বাড়ির কাছাকাছি আসতেই মাহফুজা শুনতে পেলেন বাঘের গর্জন। নৌকা তখন মাত্র তীরে ভিড়ছে। নৌকা ঘুরিয়ে মাহফুজা ও তার ছেলের আবার পেছন দিকে গেল তার ভাইয়ের নৌকার দিকে; কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। শাহাদাতের নৌকাটি ছিল তীরের কাছে, বনের কাছে, তখন একটি বাঘ তাকে আক্রমণ করে। গলায় দাঁত বসিয়ে দেয়। শাহাদাতের স্ত্রী সমানে চিৎকার করতে থাকেন; কিন্তু বাঘ শাহাদাতকে মুখে করে ছুটে যায় বনের দিকে। মাহফুজা এসে দেখেন নৌকায় রক্তের দাগ। ভাবীকে টেনে বাড়ির দিকে আনতে গিয়ে তার প্রাণ বেরিয়ে যায়, কী সান্ত্বনা দিবেন তকে! সেই দুঃখের বর্ণনা দিতে গিয়ে মাহফুজা বলেন, ‘কিছু বোঝার আগেই বাঘ ভাইকে নিয়ে গেল!’
সেই রাতে প্রায় ১৫০ জন গ্রামবাসী মশাল হাতে বনে প্রবেশ করে শাহাদাতের খোঁজে। বাঘ সাধারণত রাতে শিকার করে না এবং আগুন ভয় পায়। তারা শাহাদাতের দেহাবশেষ খুঁজে পায়, হাড্ডি-মাংস কিছু নিয়ে আসে মাহফুজার বাড়িতে।
পরদিন সকালে নদীর তীরে দাঁড়িয়ে মাহফুজা দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন। ভয়ে ও দুঃখে তার শরীর কাঁপতে থাকে। ভয় কোনো বিলাসিতা নয়। ভয়ে ঘরে বসে থাকতে হবে না। তাহলে খাওয়াবে কে? মাহফুজা বলেন, ‘আমার ক্ষুধা বাঘের ভয় পায় না। ভয় কাটিয়ে আমাকে আবার নদীতে যেতে হয়। যদি কপালে থাকে তাহলে আমিও হয়তো একদিন বাঘের মুখে পড়ব।’
মাহফুজার গ্রামে আছে ৮ জন মৎস্যনারী। তাদের বয়স ৪০ থেকে ৬০। পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে তারা মাছ ধরতে যান নদীতে। গাবুরা চরের ৯নং ওয়ার্ডে বেড়ে উঠেছেন মাহফুজা। ৯নং ওয়ার্ডের বাসিন্দারা বেশিরভাগই বনের ওপর নির্ভরশীল। কাঠ আর মধু সংগ্রহ করে তাদের জীবন চলে। লবণাক্ত মাটিতে তারা কৃষিকাজ করতে পারেন না তেমন।
গ্রামের সবচেয়ে দরিদ্র পরিবারগুলোর একটিতে মাহফুজার জন্ম। বাবা ছিলেন দিনমজুর। নৌকা ভাড়া করার মতো যথেষ্ট টাকা থাকলে মাঝে মাঝে মাছ ধরতেন। নিজের জীবনের দুঃখের ইতিহাস বলতে গিয়ে মাহফুজা বলেন, ‘আমার আব্বা গরিবের চেয়েও গরিব ছিল। ছোটবেলায় আমি ভিক্ষা করতাম, মানুষের বাড়ি বাড়ি কাজ করতাম। তাও চলতো না।’
মাহফুজারা ছিলেন ছয় ভাইবোন। ভাইবোনদের মধ্যে মাহফুজা চতুর্থ। এমন লোকদের কাছে ভিক্ষা করতেন যারা নিজেরাই ঠিক মতো খেতে পেত না। সব সময়ই পেটে ক্ষুধা নিয়ে থাকতেন। খাবার বলতে ছিল কেবল পানি আর লবণ কচলে ভাত। মানুষের দেয়া ছেঁড়াফাড়া কাপড় পরতেন। বাবা তাকে কখনো মাছ ধরা শেখাননি। চাইতেন না মেয়ে এই বিপজ্জনক পথে যাক। আট বছর বয়সের গ্রামের এক লোকের কাছ থেকে মাছ ধরা শিখেন মাহফুজা। মাহফুজা শিখেন, মাছ ধরতে হয় স্রোতের টানে। তখন মাছগুলো খাবার খুঁজতে আসে। পানির টান কমে গেলে ওরাও পানির তলে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে।
মাছ ধরা শেখার পর থেকে মাহফুজা অন্তত দুবেলা পেটপুরে খেতে পান। অনেকেই তাকে মাছ ধরতে নিষেধ করেছে, পরামর্শ দিয়েছে; কিন্তু মাহফুজা বলেন, খেতে দাও আমাকে, তাহলে আর মাছ ধরব না। পরিবারও আর আপত্তি করেনি। মেয়ের কারণে ঘরে দুবেলা আহার তো জুটছে। ১২ বছর বয়স থেকেই মাহফুজা পুরো দস্তুর জেলে হয়ে যান। নৌকা চালাতে পারেন, জাল ফেলতে পারেন, মাছ ধরে বাজারে নিয়ে বিক্রিও করতে পারেন। আর তাকে কারও কাছে হাত পাততে হয় না। পরিবারের ভরণপোষণের দায়িত্ব অনেকটা নিজের কাঁধে নিয়ে নেন।
গ্রামের অধিকাংশ মেয়ের মতোই খুব অল্প বয়সে, ১৬ বছর বয়সে এক লোককে বিয়ে করেনি তিনি। স্বামী ছিল এক দিনমজুর। ২২ বছর আগে তিন সন্তান রেখে সে অন্য এক নারীর হাত ধরে চলে যায়। তিন সন্তানকে মাহফুজা একাই বড় করেন। গর্ব করে বলেন, ‘আমি তাদের পেলেপুষে বড় করেছি। বিয়ে দিয়েছি। কিছুই আমাকে আটকে রাখতে পারে নাই।’
‘বাড়িতে যখন পুরুষ থাকে না তখন নারী একাই মা-বাবার দায়িত্ব পালন করতে পারে’, তিনি বলেন; কিন্তু গলা কেঁপে আসে তার। এখন তার দুই ছেলে দিনমজুরি করে। মেয়েটির ছাড়াছাড়ি হয়ে গিয়েছিল আবার বিয়ে করে এখন অন্য জায়গায় থাকে। ছেলেমেয়েরা কেউই তাকে কিছু দেয় না। বিয়ের পর তারা সব ভুলে গেছে। মেয়ের আগের ঘরের নাতিন লাভলুকে নিয়ে এখন মাহফুজার দিন কাটে। নাতিনকে তিনি পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়িয়েছেন; কিন্তু একা মাছ ধরে দুজনের পেট ভরছিল না। তাই দশ বছর বয়স থেকে লাভলুকেও তিনি কাজে লাগিয়ে দিলেন। নাতনিটির বয়স এখন ১৫, একটা ইটভাটায় মাটি টানার কাজ করে। মাহফুজা বলেন, এই নাতিনই এখন তার সব। পুরো দুনিয়া।
মাহফুজা বলেন, ‘আমার কোনো পুরুষের দরকার নাই। ৪৪ বছর ধরে আমি বাঘ-কুমির, ঘূর্ণিঝড় আর ডাকাতের সঙ্গে লড়াই করে টিকে আছি। যখন আমার বাচ্চারা ক্ষুধায় কাঁদতো, বাঘ-কুমির, ডাকাতের ভয় আমাকে ঘরে বসিয়ে রাখতে পারত না।’
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে