Views Bangladesh Logo

বিশ্ব ভূরাজনৈতিক উত্তেজনা কোন দিকে যাচ্ছে

Rayhan Ahmed Tapader

রায়হান আহমেদ তপাদার

বৈশ্বিক শৃঙ্খলা কিছুদিন ধরে ভেঙে পড়েছে। ইতোমধ্যে পশ্চিমা আধিপত্য ক্ষয় এবং বহুপক্ষীয় প্রতিষ্ঠানগুলো আরও বেশি চাপে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বশক্তি বহু ধারার দিকে ধাবিত হচ্ছে। বৈশ্বিক ক্ষমতার ভারসাম্যে পরিবর্তনের পাটাতনে মধ্যপন্থি শক্তিগুলোর ভূমিকা ভূরাজনীতি গঠনে দিন দিন বাড়বে। চলতি সালের জন্য সবচেয়ে বড় প্রশ্নগুলোর মধ্যে একটি হলো সদ্য নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে বৈশ্বিক বিষয়ে আরও অস্থির সময় শুরু হবে কিনা? তার কিছু নীতি-পরিকল্পনা ইতোমধ্যে বিশৃঙ্খল বিশ্বের জন্য আরও বিপর্যয়কর হওয়ার শঙ্কা জাগায়। ট্রাম্পের অধীনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের মিত্র, প্রতিপক্ষ ও প্রতিযোগীদের সঙ্গে কেমন আচরণ করে, তা দিয়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াদির মধ্যে ভূরাজনৈতিক উন্নয়নের ব্যাপার বোঝা যাবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের সম্পর্কের ভবিষ্যৎ গতিধারা আগামী বছরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত দিক। ট্রাম্পের অনাকাঙ্ক্ষিত ও পরিবর্তনপ্রবণ ব্যক্তিত্বের কারণে চীন-মার্কিন সম্পর্কে হয় উত্তেজনা বাড়বে, নতুবা বড় ধরনের দর কষাকষি দিয়ে ট্রাম্পের লেনদেন চালিত হবে।

দক্ষিণ আফ্রিকায় জন্ম নেয়া মাস্ক তার বিশ্বভ্রমণ শুরু করেছেন। তিনি চরম ডানপন্থি মতাদর্শ উসকে দিচ্ছেন এবং যুক্তরাজ্যে তার অনুগত উগ্রপন্থি নেতাদের ক্ষমতায় বসানোর চেষ্টা করছেন। ইলন মাস্ক এখন শুধু প্রযুক্তি ব্যবসায়ী নন, তিনি যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতেও একটি বিতর্কিত চরিত্র হয়ে উঠেছেন। তার কিছু কর্মকাণ্ড ও মন্তব্য নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হয়েছে। যেমন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে তার একটি অঙ্গভঙ্গিকে অনেকেই নাৎসি সালাম বলে মনে করেছিলেন। তিনি মার্কিন উন্নয়ন সংস্থা ইউএসএআইডিকে অপরাধী সংগঠন আখ্যা দিয়ে এটির মৃত্যু হওয়া উচিত বলে মন্তব্য করেছেন।

এ ছাড়া তিনি নতুন সরকারি বিভাগ ডিপার্টমেন্ট অব গভর্নমেন্ট এফিসিয়েন্সির প্রধান হিসেবে কঠোর ব্যয় সংকোচনের নীতি অনুসরণ করছেন যা অনেকের জন্য ক্ষতিকর বলে মনে করা হচ্ছে। তবে মাস্কের রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই সীমাবদ্ধ নেই। তিনি কট্টর ডানপন্থি ট্রাম্প ও তার মেক আমেরিকা গ্রেট অ্যাগেইন আন্দোলনকে ক্ষমতায় আনতে সহায়তা করেছেন। তিনি এখন বিশ্বের অন্যান্য দেশেও একই ধরনের রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করছেন বিধায় বিশ্বজুড়ে পাবলিক প্রতিষ্ঠানগুলো সংকটে পড়েছে। এই প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর থেকে জনগণের আস্থা কমছে। আর মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং তার সহযোগী ও বিশ্বের অন্যতম ধনী ব্যক্তি ইলন মাস্ক এই প্রতিষ্ঠানগুলোকে ধ্বংসযোগ্য শত্রু হিসেবে দেখছেন। তহবিল সরবরাহ কমে যাওয়ায় এবং ভূরাজনৈতিক বিভাজনের কারণে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোও আগের চেয়ে দুর্বল হয়ে পড়েছে। ট্রাম্প ও মাস্ক যেভাবে ইউএসএআইডি বন্ধ করে দেয়ার কথা বলছেন এবং শিক্ষা বিভাগ তুলে দেয়ার পরিকল্পনা করছেন তা সম্ভবত সঠিক সিদ্ধান্ত নয়। এটি বুমেরাং হয়ে তাদের জন্যই বিপদ ডেকে আনতে পারে। তবে এটি আমাদের মনে করিয়ে দিচ্ছে, পাবলিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে আগের মতোই থাকতে হবে- এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই।

আসলে পুরোনো প্রতিষ্ঠানগুলোর সনাতনী কায়দায় টিকিয়ে রাখার পক্ষে কথা বলার দিন শেষ হয়ে আসছে। সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) ব্যবহার, মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার সমাধান, জ্বালানি শক্তির ব্যবহার পরিবর্তন এবং শিল্পনীতি রয়েছে- এগুলো কার্যকর প্রতিষ্ঠান ছাড়া সফলভাবে সামলানো সম্ভব নয়; কিন্তু বর্তমান সরকারি দপ্তর, সংস্থা, কমিশন ও নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো অনেক ক্ষেত্রেই এই নতুন চাহিদার সঙ্গে মানানসই নয়। সরকারের কাজ পরিচালনার জন্য প্রতিষ্ঠান সবসময়ই গুরুত্বপূর্ণ ছিল, আইন প্রয়োগ, শিক্ষা প্রদান, কর সংগ্রহ কিংবা নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য প্রতিষ্ঠান দরকার।

কিন্তু সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে নতুন নতুন প্রতিষ্ঠানও গড়ে তুলতে হয়, যেমন পরিবেশ দূষণ রোধ বা সংঘবদ্ধ অপরাধের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য। বর্তমান বিশ্বে পাবলিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মডেল আগের চেয়ে অনেক আলাদা হতে পারে। বেসরকারি খাতে গুগল, বাইটড্যান্স, অ্যামাজন এবং আলিবাবার মতো প্রতিষ্ঠান ব্যবসার নতুন নতুন মডেল তৈরি করেছে। একসময় কেউ ভাবতেও পারেনি যে উবার বা গ্র্যাবের মতো কোম্পানি নিজেদের কোনো গাড়ি না রেখেও ট্যাক্সি সেবা দিতে পারবে। সরকারি খাতেও উল্লেখযোগ্য কিছু উদ্ভাবন ঘটেছে। ২০০৯ সালে চালু হওয়া ভারতের আধার প্রকল্পের মাধ্যমে এক বিলিয়নের বেশি মানুষ বায়োমেট্রিক পরিচয়পত্র পেয়েছেন যা আর্থিক অন্তর্ভুক্তি বাড়িয়েছে। চীন ২০১১ সালে সাইবারস্পেস প্রশাসন প্রতিষ্ঠা করে। এটি প্রযুক্তি খাতে বিপুল পরিবর্তন এনেছে। তবে বিশ্বের অনেক জায়গায় পাবলিক প্রতিষ্ঠানগুলো এখনো সেই পুরোনো কাঠামোতেই চলছে। বেশিরভাগই পিরামিড মডেলের। সেগুলো অস্বচ্ছ ও সাড়া দিতে দেরি করে।


নতুন কোনো প্রতিষ্ঠান গড়ে তুললেও তা সাধারণত প্রবীণ রাজনীতিক বা আমলারা তৈরি করেন, যা হয় জটিল ও অদক্ষ। বর্তমানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) ব্যবহারের বিস্তৃতি বাড়লেও একে সঠিকভাবে পরিচালনার জন্য কার্যকর প্রতিষ্ঠান এখনো গড়ে উঠেনি। এআই ব্যবহারের সুফল পেতে হলে এবং এর ক্ষতিকর দিক নিয়ন্ত্রণ করতে হলে আমাদের শক্তিশালী নীতিমালা ও নিয়ন্ত্রক সংস্থা প্রয়োজন। কিছু প্রযুক্তি কোম্পানি সরকারকে নিরুৎসাহিত করতে চায়, যাতে সরকার এআই নিয়ন্ত্রণে কঠোর নিয়ম না করে। ২০২৩ সালে মাইক্রোসফটের প্রধান অর্থনীতিবিদ মাইকেল শোয়ার্জ বলেছিলেন, যতক্ষণ না বড় ধরনের ক্ষতি হচ্ছে, ততক্ষণ এআই নিয়ন্ত্রণ করার দরকার নেই; কিন্তু এটি মূলত বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের স্বার্থ রক্ষা করে। অর্থনীতিবিদ দারোন আকেমোগলু ও অন্যরা দেখিয়েছেন, একটি দেশের উন্নতি নির্ভর করে তার প্রতিষ্ঠানের দক্ষতার ওপর।

ভালো প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা না গেলে উন্নতি সম্ভব নয়। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কীভাবে আমরা এমন প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে পারি, যা দ্রুত সাড়া দিতে পারবে এবং জনগণের আস্থা অর্জন করতে সক্ষম হবে। বর্তমানে পাবলিক প্রতিষ্ঠান গঠনের ক্ষেত্রে নতুন নতুন ভাবনা আসছে। যেমন ওয়েলসে ‘ফিউচার জেনারেশন কমিশনার’ নামে একটি পদ সৃষ্টি করা হয়েছে। এটি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কল্যাণ নিশ্চিত করতে কাজ করে। ইউরোপীয় কমিশনেও এমন একটি পদ চালুর কথা ভাবা হচ্ছে। এ ছাড়া বিশ্বব্যাপী নতুন কিছু প্রতিষ্ঠান মিস ইনফরমেশন বা ভুয়া তথ্য প্রতিরোধ, নির্বাচনী হস্তক্ষেপ রোধ, শহরের জ্বালানি খাত সংস্কার, আদিবাসী সম্প্রদায়ের ক্ষমতায়ন ও তরুণদের জন্য কর্মসংস্থানের পথ তৈরি করার জন্য কাজ করছে।

জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস ২০২৩ সালে বলেছিলেন, যদি সমস্যার সমাধান করতে চাও, তবে প্রতিষ্ঠানগুলোকেও বর্তমান বাস্তবতার সঙ্গে মানানসই হতে হবে। যদি প্রতিষ্ঠানগুলো সময়ের সঙ্গে পরিবর্তিত না হয়, তবে তারা সমস্যার সমাধান না দিয়ে বরং সমস্যার অংশ হয়ে উঠবে। আমরা হয়তো বর্তমানে প্রতিষ্ঠান ভাঙার যুগে রয়েছি; কিন্তু ইতিহাস বলছে, এই ধ্বংসের পরই নতুন কিছু গঠিত হয়। যখন পুনর্গঠনের সময় আসবে, তখন আমাদের নতুন ও উন্নত বিকল্পের খোঁজ আগেভাগেই নিতে হবে। ব্রাজিলের সমাজবিজ্ঞানী রবার্তো উঙ্গার বলেছিলেন, ‘এই বিশ্বে কোনো বিকল্প না থাকার অবস্থাই প্রকৃত সমস্যার মূল কারণ। ফলে ট্রাম্প ও ইলন মাস্কের তৈরি করা এই অস্থিরতাই হতে পারে নতুন কিছু উদ্ভাবনের জন্য শক্তিশালী অনুপ্রেরণা। ২০২৫ সাল ইউক্রেন ও মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধ কোন দিকে যাবে তাও নির্ধারণ করবে। ইউক্রেন সম্পর্কে নীতিগত বিষয়ে আমূল পরিবর্তনে ট্রাম্পের পরামর্শ ইউরোপীয় সরকারগুলোকে বিচলিত করে তুলছে বলে মনে হচ্ছে।

ট্রাম্প প্রায়ই দাবি করেন, তিনি এক দিনে যুদ্ধ শেষ করতে পারেন। তিনি ইউক্রেনকে রাশিয়ার সঙ্গে আলোচনায় বসতে ঠেলে দেবেন বলে মনে হচ্ছে, যদিও তিনি সংঘাতের অবসান ঘটাতে কোনো সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা দেননি। ট্রাম্প হয়তো এমন কোনো আলোচনার ফলাফলের বিরুদ্ধাচরণ নাও করতে পারেন, যা মস্কোকে সুবিধা দেয় এবং যার দ্বারা ইউক্রেনকে ভূখণ্ড হস্তান্তর করতে হয়। ট্রাম্প বারবার বলেছেন, তিনি মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধের অবসান এবং গাজায় যুদ্ধবিরতি নিশ্চিত করতে চান। যদিও তিনি সুনির্দিষ্টভাবে বিষয়টি এড়িয়ে গেছেন, তবে এটি প্রায় নিশ্চিতভাবে ইসরায়েলের শর্তে ঘটবে। তিনি বলেছেন, সিরিয়া থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দূরে থাকা উচিত, তবে সেখানে শাসক পরিবর্তনের জটিল আঞ্চলিক প্রভাবের কারণে এটি কীভাবে সম্ভব, তা বুঝতে পারা কঠিন। বিশ্বজুড়ে গণতন্ত্র চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি থাকবে। পূর্ববর্তী বছরগুলো থেকে প্রত্যাশিত প্রবণতা উৎসাহব্যঞ্জক হবে বলে মনে হচ্ছে না। অনেক দেশে চলমান রাজনৈতিক মেরুকরণ এবং ক্রমশ ভেঙে পড়া রাজনৈতিক পরিস্থিতি অস্থির হয়ে উঠছে।

রাজনীতিতে মধ্যপন্থায় ক্ষয় ধরা অথবা এর বিনাশ, দুর্বল হয়ে যাওয়ার প্রবণতা এখন বিশ্বজুড়ে। এটি ডানপন্থি জনতুষ্টিবাদের উত্থানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত, যা ইউরোপের বেশিরভাগ অংশে অব্যাহত ও অন্যত্র স্পষ্ট। চলতি সালে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় অগ্রগতি ঘটার প্রবণতা দেখা যেতে পারে। ব্যবসা, কর্মক্ষেত্র, বিনোদন, মিডিয়া, স্বাস্থ্যসেবা ও ব্যক্তিগত জীবনে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা চালিত সরঞ্জামের ব্যবহার নিত্যদিনের ঘটনায় পরিণত হবে। ইতোমধ্যে এসব ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটেছে। কিন্তু এতে সাইবার নিরাপত্তাসহ প্রযুক্তিগত চ্যালেঞ্জের একটি যুগ শুরু হয়েছে। সামরিক ক্ষেত্রে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহারে আরেকটি চ্যালেঞ্জ দেখা দিয়েছে। আগামী বছর বিশ্ব ভূরাজনৈতিক উত্তেজনা ও অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের সামনে দাঁড়াবে, এতে জাতিগুলোর টিকে থাকার ক্ষমতার পাশাপাশি সর্বজনীন সমস্যার যৌথ মোকাবিলায় এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সক্ষমতা বিচারের মুখোমুখি হবে।

রায়হান আহমেদ তপাদার: গবেষক ও কলাম লেখক।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ