Views Bangladesh Logo

যেখানে আমার মন পড়ে রয়

প্তাহে একবার ঢাকার হট্টগোল ছেড়ে আমি বাড়ির পথে রওয়ানা হই। বিমানবন্দরে এসেই গন্ধ পাই জেট জ্বালানির। তুমুল ব্যস্ততা চারদিকে; কিন্তু আমার কাছে এটি শুধু টার্মিনাল নয়, পবিত্র কিছুর কাছে যাওয়ার সূচনাবিন্দু। একা একা ভ্রমণ করি, শখে বা কাজে নয়, প্রাণের টানে। পরিবারের কাছে যাই। এমন এক আকুলতার দিকে ছুটে যাই, যা এই শহর আমাকে দিতে পারে না। বাড়ি।

গত প্রায় আড়াই বছর ধরে আমার এই আসা-যাওয়া চলছে, ঢাকা-যশোর, যশোর-ঢাকা। প্রতি সপ্তাহে। অনেকের কাছে এটা একেবারেই অস্বাভাবিক মনে হতে পারে; কিন্তু এক সপ্তাহ বাড়ি না গেলে আমার দম বন্ধ হয়ে আসে। পড়াশোনার জন্য ঢাকা থাকি। ভবিষ্যৎ নামক অলীক এক স্বপ্নের পেছনে ছুটছি; কিন্তু আমার মন সারাক্ষণ পড়ে থাকে যশোরে। যেখানে আমার বাবা-মা আর আমার প্রাণপ্রিয় নানুমনি অপেক্ষা করেন। তারা অপেক্ষা করেন বুকের সবটুকু আকুলতা আর ভালোবাসা নিয়ে- কখন আমি বাড়ি যাব!

আমার কিছু বন্ধু এ নিয়ে মজা নেয়, বলে, ‘তোর যত ঢং, প্রতি সপ্তাহে বাড়ি যাস!’ ওরা হাসাহাসি করে; কিন্তু ওরা জানে না। ওরা তো আর আব্বুর কণ্ঠস্বর শুনতে পায় না ফোনে, ‘তুই আসবি তো, মা’? আমি বাড়িতে পা দেয়ামাত্র আমার মায়ের চোখ দুটো কীভাবে হেসে ওঠে ওরা তো তা দেখে না। খেলাম কি না, ঘুমালাম কি না মা ছাড়া আর কে দেখে! ওরা আমার নানুমনির হাসিমুখ দেখে না, ধীর পায়ে হেঁটে আসেন আমার কাছে, মুখে কাঁপা কাঁপা হাসি।

আসার সময় নানুমনি হাতে কিছু টাকা গুঁজে দেন, মুখে হাসি নিয়েও কেমন কান্নাভেজা সুরে বলেন, ‘নানুমনি, যা মন চায় কিনো, যা তোমার ভালো লাগে।’
নানুমনির হাতের আঙুলগুলো চিকন চিকন, শুকিয়ে যাওয়া ফুলের মতো পলকা; কিন্তু যে ভালোবাসা ওই আঙুলগুলোতে মাখা, তা একটা পর্বতকে নাড়িয়ে দিতে পারে। আমি কখনোই নানুমনির সঙ্গে তর্ক করি না। চুপ করে টাকাগুলো নেই, মাথা নাড়াই। এমন একটা ভান করি যেন পরে খরচ করব; কিন্তু আমি কখনোই নানুমনির দেয়া টাকা খরচ করি না। ওই নোটগুলো আমার অমূল্য সম্পদ, ভালোবাসার গন্ধমাখা, ওগুলো আমি জমিয়ে রাখি।

আব্বু আমার নীরব আশ্রয়। আমি কী চাই এটা কখনো বলার প্রয়োজন হয়নি আব্বুকে। আমি বলার আগেই আব্বু বুঝতে পারেন। যখন ছোট ছিলাম তখনো যেমন এখনো তেমন, যত যা-ই চাই, যত বায়না থাকুক, আব্বু পূরণ করবেনই। আম্মু বারণ করলেও আব্বু দিবেনই, বলবেন, ‘আহা, থাকুক না, ওর খুশিটাই বড় কথা।’ আব্বু সেই মানুষ যিনি আমার সব কথাতেই সায় দেন, সব সময়ই পাশে থাকেন।

আর আম্মু! খুবই শক্তসামর্থ্য, মায়াভরা, চিন্তাশীল এক নারী। আম্মু খুব বেশি কথা বলেন না; কিন্তু প্রতিটি কাজের মধ্যেই আম্মুর যত্নমাখা হাত লেগে আছে। বাড়িতে ঢুকামাত্রই আম্মু আমার হাত থেকে ব্যাগটা নিবেন, বলবেন, ‘যা, জলদি ফ্রেশ হয়ে আয়। তোর প্রিয় খাবার রান্না করেছি সব।’ আম্মু কোনো প্রশংসা বা ধন্যবাদের জন্যও অপেক্ষা করেন না। আমি ভালো থাকলেই তিনি খুশি। আম্মুর কণ্ঠস্বর ঠিক আছে তো আমাদের বাড়ির সব ঠিক আছে। মা-ই আমাদের আশ্রয়স্থল।

সব ফ্লাইটেই আমি জানালার পাশে বসি। বিমানের নিচে মেঘ ঝাপসা হয়ে আসে; কিন্তু আমার মন হাসতে থাকে ক্রমশ। দুটি জগতের মাঝখানে আমি ছুটতে থাকি- একটা যা আমি নির্মাণ করছি, আরেকটা যা আমাকে নির্মাণ করেছে। এ দুটো মাঝখানের স্থবির নীরবতাকেই আমি সবচেয়ে বেশি অনুভব করি। দূরত্বের বেদনা, ফিরে যাওয়ার আনন্দ, আর বারবার ফিরে আসার বুকভাঙা কষ্ট!

এক বিকেলে ফিরে আসার সময় দেখলাম একজন বয়স্ক মহিলা একাই প্লেনে আসছেন। তাকে দেখেই নানুমনির কথা মনে পড়ল। ছোটখাটো, নরমসরম, ইতস্তত। তার ব্যাগটা ছিল বেশ ভারী। উঠাতে গিয়ে তার হাত কাঁপছিল। কেউই এগিয়ে গেল না। আমিই গেলাম। ব্যাগটা তুলে নিলাম। তাকে ধরে সিটে নিয়ে বসালাম। তিনি আমার দিকে চোখ তুলে একটু চাইলেন, কেমন অশ্রুভেজা, ফিসফিস করে বললেন, ‘একদিন তোমার মেয়েও তোমার জন্য এমন করবে।’ সেই মুহূর্তেই আমার নানুমনির কথা মনে পড়ল। হাতের মুঠোয় একরাশ ভালোবাসা নিয়ে অপেক্ষা করছেন।

যশোর ছেড়ে আসার সময়টা খুবই কঠিন। চোখমুখ শক্ত করে আমি বিদায় নিই; কিন্তু আমার বুকটা যেন ভেঙে যায়। আব্বু গেটের কাছে দাঁড়িয়ে থাকেন। ভান করেন যেন মোবাইল দেখছেন; কিন্তু আমি জানি আমি চোখের আড়াল হওয়ার আগ পর্যন্ত তিনি দাঁড়িয়ে থাকবেন। শেষবারের মতো আম্মু আমার হাত ধরে বলেন, ‘পৌঁছেই ফোন দিস। সময় মতো খাস।’ নানুমনি বিদায় দেন সবার শেষে, আমার গালে হাত দিয়ে বলেন, ‘এর পর কিন্তু অনেক দিন থাকবি, সোনা।’

মুখ ঘুরিয়ে চলে আসার আগ মুহূর্তটির কথাই আমি সারা সপ্তাহ ধরে ভাবতে থাকি। ক্লাস রুমে, বাসভর্তি লোকের মাঝে, লাইব্রেরিতে। ওই মুহূর্তটিই আমাকে এগিয়ে নিয়ে যায়। ওই ভালোবাসাটুকুই আমার চলার পথের শক্তি। যতদূরেই আমি যাই না কেন, আমি জানি, আমার মন কোথায় পড়ে রয়ে!
অনেকেই আমাকে জিজ্ঞেস করে, ‘প্রতি সপ্তাহে বাড়ি যেতে আমার ক্লান্ত লাগে না? এটা কি একটু বাড়াবাড়ি না?’
আমি সবসময় হেসে উত্তর দিই, ‘না, ওখানেই তো আমার টান।’
এই গল্প বিমানবন্দর বা বিমান নিয়ে না। এটা আমার প্রাণের কাছে যাওয়ার গল্প। যদিও এতে সময়, অর্থ, শক্তি যায়, অনেক ঝুটঝামেলা সত্ত্বেও বাড়ি যাওয়াই আমার একান্ত এক গল্প। বাড়ি যাওয়া কোনো বিশেষ দিবস বা অনুষ্ঠানের ওপর নির্ভর করে না, এটা নির্ভর করে প্রাণের টানের ওপর। তাই যখনই পারেন আপনি বাড়ি যান, তাদের কাছে যান, যারা আপনাকে দেখামাত্রই দরজা খুলে দিবে, বুকে জড়িয়ে ধরবে।

তাই আমি উড়ে যাই। প্রতি সপ্তাহে। কাপড় গুছাই, ব্যাগ গুছাই, বিকেলের রোদ্র পেছনে ফেলে যশোর ছুটে যাই। আব্বু-আম্মুর কাছে বসে থাকি, তাদের সারা সপ্তাহের গল্প শুনি। নানুমনির কোলে মাথা রেখে শুয়ে থাকি। নানুমনি তার কোমল আঙুল বোলান আমার চুলে। আর যখন ছুটি শেষ হয়, একটা অদৃশ্য চাদরের মতো তাদের মায়া-মমতা-ভালোবাসা জড়িয়ে আমি ফিরে আসি।

একদিন হয়তো এসব দিন আর থাকবে না। জীবন বদলে যাবে। সময় আর আগের মতো থাকবে না; কিন্তু তার আগ পর্যন্ত আমি সব সময়ই প্রতি সপ্তাহে বাড়ি যাব। তাদের কাছে ছুটে যাব যারা আমাকে বড় করেছে, কোনো শর্ত ছাড়াই আমাকে ভালোবাসে। যাদের প্রতিটা বিদায়ের সঙ্গে মিশে থাকে কেবল ফিরে আসার ডাক।

কতগুলো শহরে আমি থাকি আর কতটা আকাশ উড়ে যাই, আমার সব গল্পের শুরু আর শেষটা যশোরেই- যারা আমার জন্য অপেক্ষা করে, ভালোবাসে আর আমার সবকিছুতেই যাদের গভীর বিশ্বাস। আর এটুকুই আমার সব।


সোহানা আফসানা প্রোমি: শিক্ষার্থী, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ